মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি

ফাইল ছবি

ইদানীং শীত আসি আসি করেও আসছে না যেন। সবুজ বসে আছেন তাঁর বাড়ির সামনে উঠানে। গত বছরও শীতের সময় চাদর জড়িয়ে উঠানে বসে রোদ পোহানো তাঁর ভীষণ পচ্ছন্দের ছিল। এ বছর শীতটা কেন যে এত দেরি করে আসছে। ডিসেম্বর মাসটা এলেই মন এমনিতেই চনমন করে আনন্দে। বিজয়ের মাস। আর ১৬ ডিসেম্বরের প্রাক্কালে যত গান তিনি শোনেন, মনে হয়, সব গানের আনন্দের উৎস তো তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধারাই। সবুজ যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এ মাসে সকালবেলাতেই সবুজের বউমা সেই চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত গানগুলো শোনে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল’ বা ‘নোঙ্গর তোলো তোলো, সময় যে হলো হলো নোঙ্গর তোলো তোলো’। সবুজ যে একজন গর্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাঁর ছেলের বউয়ের এ আনন্দটুকুর ভাগ প্রতিবেশীরাও নেন। কেউ না কেউ আসেন যুদ্ধের গল্প শুনতে। সবুজও গান শুনতে শুনতে ফিরে যান অতীতে।

বয়স তখন তাঁর ১৮ বছর। ভয়াল ২৬ মার্চের তাণ্ডবের পর মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবেন বলে মনস্থির করে ফেলেন তিনি। খুব সাদামাটা পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি, তাই মা–বাবার মনে তাঁকে নিয়ে অনেক আশা ছিল। পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরবেন তিনি। কিন্তু রক্তে তখন তাঁর ভালোবাসার জোয়ার এসেছে দেশের জন্য কিছু করার। তাই পালালেন একরাতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল পুরো দেশকে ১১টা সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। সুশিক্ষিত একদল আর্মির বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আক্রমণ ছাড়া এ যুদ্ধে জেতা যাবে না বুঝে গেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছেন মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১
ছবি: সংগৃহীত

সবুজ ছিলেন সেক্টর ২ (ঢাকা, নোয়াখালী, ফরিদপুর ও কুমিল্লার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত এ সেক্টর) মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে একজন যোদ্ধা। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মেঘালয়ে এর সদর দপ্তর ছিল। ভারতে অস্ত্র আর যুদ্ধ শিখে নিয়ে খেয়ে না–খেয়ে যুদ্ধ করেছেন তাঁরা, বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন। বাঁ হাতের কিছু অংশ খোয়ানো ছাড়া তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি তাঁর হয়নি কিন্তু তাঁর জীবনের যুদ্ধটা সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। হয়েছিল শুরু।

ছবি: লেখক

যুদ্ধ জয়ের আনন্দ নিয়ে যখন বাড়ি ফিরেছেন সবুজ, তখন তাঁর বাবা কিছুতেই বাড়িতে ঢুকতে দিতে চাননি। খেয়ে না–খেয়ে মুক্তিযোদ্ধার বাবা হিসেবে এ কয়েক মাস নিপীড়নের জীবন কেটেছে তাঁর। এখন আহত ছেলে এসেছে তাঁর বোঝা হতে? কিন্তু সবুজের মা একমাত্র সন্তানকে দূরে ঠেলে দিতে পারেননি। মায়ের সেবায় সুস্থ হয়ে আর উৎসাহে আবার পড়াশোনার জগতে ফিরেছিলেন তিনি। একহাতে লাঙল ধরে আর খেয়ে না–খেয়ে নবীন গ্রামের আঞ্চলিক কলেজে পড়ে বিএ পর্যন্ত পাস করে ফেলেন তিনি। বহুবার যুদ্ধে জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ তাঁকে লড়াকু মানুষে পরিণত করেছে। শারীরিক কোনো বাধা পথের কাঁটা হয়ে থাকেনি।

পাস করার পর থেকে পয়সার বিনিময়ে মানুষের চিঠি লিখে দিয়ে, মানুষকে পড়িয়ে, পয়সা জমিয়ে ছোট্ট ভাতঘর করেছিলেন তিনি। শুধু ভাত–ডালের ছোট্ট ছাপরা ঘর। প্রথম প্রথম মা রান্না করে দিতেন, পরে নিজেই শিখে নিয়েছিলেন সবুজ। হাতে একটু পয়সা জমতেই নিজের জমি বর্গা দিয়ে, ব্যবসা বাড়িয়ে সেই টাকাতেই টিনের চালের বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। রহিমার মতো লক্ষ্মী বউ ঘর আলো করে এসেছে আর চার–চারটি সন্তান উপহার দিয়েছে তাঁকে। শেষ বয়সে তাঁর মা–বাবা সুখের মুখ অবশ্যই দেখেছেন। কখনো অনেক বেশি কিছুর স্বপ্ন তাঁর ছিল না কিন্তু ছেলেমেয়েদের দুধে–ভাতে রাখার আজন্ম স্বপ্ন তাঁর ছিল। পূর্ণ হয়েছে সে স্বপ্ন দেশের মাটিতে সৎভাবে ব্যবসা করে।

ছোট ছেলেটা তাঁর দুবাইয়ে পাড়ি জমিয়েছে। ছেলের মা রহিমার প্রবল আপত্তি ছিল তাতে, ছেলে সদ্য বিয়ে করেছে তখন, বউ সন্তানসম্ভাবা, এ সময়ে চলে যাবে সে? সবুজ ছেলের চোখে–মুখে নিজের ছায়া দেখেছেন। তিনি ‘না’ করেননি। ছয় বছর পর আজ ছেলে তাঁর রেমিট্যান্স যোদ্ধা হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে তার অবদান সবুজের বৃদ্ধ জীবনের আনন্দ।

কচি কণ্ঠের ‘দাদু দাদু, খেতে আসো’ শুনে বাস্তবে ফিরলেন তিনি। ছেলে বছরে একবার দুবাই থেকে দেশে এসে মাসখানেক থাকে। তাই ছেলের বউ তাঁর আর রহিমার সঙ্গেই থাকে। চাঁদের হাট তাঁর মাটির ঘরে। ছোট্ট দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হলো

‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’