আর কত প্রাণ গেলে একটি নিরাপদ নৌ রুট পাবে সন্দ্বীপবাসী

চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ। সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম নৌপথ। চার লাখ বাসিন্দার জন্য এই দ্বীপে একদিকে যেমন নেই উন্নত চিকিৎসা, অন্যদিকে নেই যাতায়াতের উন্নত ব্যবস্থা। এখানে আবহাওয়া একটু খারাপ হলেই নৌযান বন্ধ করে দেওয়া হয়। দিনে আসা-যাওয়া সম্ভব হলেও রাতে তা প্রায় অসম্ভব।

দ্বীপের অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখা গেলেও অনুন্নত রয়ে গেছে যাতায়াতব্যবস্থা। যে কারণে প্রতিনিয়ত ভোগান্তিতে পড়তে হয় এই জনপদের বাসিন্দাদের। স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক না পাওয়ায় রোগী নিয়ে ছুটতে হয় বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও উন্নত সরঞ্জাম না থাকায় মেলে না সুচিকিৎসা। তাই একমাত্র মাধ্যম নৌপথ পেরিয়ে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে হয়। আর সেখানে নিতে গেলেই যত ভোগান্তির স্বীকার হন দ্বীপবাসী।

সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার ছয়টি ফেরিঘাট থাকলেও সচল কুমিরা-গুপ্তছড়া ঘাট। এখানে দ্রুততম সময়ে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম স্পিডবোট। অন্যথায় সার্ভিস বোট কিংবা স্টিমারে যাতায়াত করতে হয়। স্পিডবোটে যেখানে নৌপথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ২০ মিনিট, সেখানে অন্য নৌযান দিয়ে পাড়ি দিতে সময় লাগে ১ ঘণ্টার বেশি। তা–ও ওঠানামার নেই কোনো সুব্যবস্থা। কোমরসমান পানিতে নেমে কাদামাটি পেরিয়ে উঠতে হয় এসব নৌযানে। আবহাওয়া একটু খারাপ হলেই বন্ধ করে দেওয়া হয় স্পিডবোট।

২০০৮ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি সি অ্যাম্বুলেন্স দিলেও চালক এবং জ্বালানির অভাবে পড়ে থাকে এটি। ২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আরেকটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়। আগেরটির মতো এটারও চালক এবং জ্বালানি তেলের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এ কারণে রোগীদের জন্য সি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও এক দিনের জন্যও সেটি ব্যবহার করা যায়নি। বর্তমানে কোটি টাকার দুটি সি অ্যাম্বুলেন্স পরিত্যক্ত অবস্থাই পড়ে আছে সড়কের পাশে। একদিকে যেমন সি অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে রোগী পারাপার করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে গুপ্তছড়া ঘাট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় প্রাণ গেছে অনেকের।

ঘটনা ১.

ঘাট কর্তৃপক্ষের অবহেলায় গত ২২ আগস্ট মারা যায় সন্দ্বীপে জন্মগ্রহণ করা ২৭ দিন বয়সী শিশু আলিফা। আলিফার চাচা ইকবাল হোসাইন জানান, মৃত্যুর দুই দিন আগে আলিফার শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে আমরা তাকে স্বর্ণদ্বীপ ফাউন্ডেশন হাসপাতালে ভর্তি করাই। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বাড়তে শুরু করলে চিকিৎসক দেড় ঘণ্টার মধ্যে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে বলেন। দ্রুত সময়ে চট্টগ্রাম না নিতে পারলে শিশুকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যাবে।

আমরা একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করে শিশুটিকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে গুপ্তছড়া ঘাটে যাই। সেখানে সব কাগজপত্র দেখিয়ে শিশুটিকে দ্রুত চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘাটের লোকদের কাছে একটা স্পিডবোট দেওয়ার অনুরোধ করি। নদী শান্ত থাকার পরও ঘাট কর্তৃপক্ষ সরাসরি জানায় স্পিডবোট দেওয়া সম্ভব নয়। আধঘণ্টা পর সার্ভিস বোট ছাড়বে, ওটাতে যেতে হবে। কান্না করেও তাঁদের রাজি করাতে পারলাম না।

এরপর একজন পরামর্শ দেন, ইউএনও থেকে অনুমতি আনলে স্পিডবোট ছাড়বে। দেরি না করে আমার ভাইকে ইউএনওর কাছে যাওয়ার জন্য পাঠাই। গুপ্তছড়া বাজার পর্যন্ত গেলে সে মুহূর্তে আরেকজন রোগী আসে। ওই রোগীর পরিবারসহ ঘাটের লোকদের সঙ্গে যাত্রীদের বাগ্‌বিতণ্ডার একপর্যায়ে তাঁরা স্পিডবোট দিতে রাজি হন। তখন ওই রোগী এবং শিশুটিকে নিয়ে চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করি।

এসব করতে করতে হাসপাতালে পৌঁছাতে আমাদের এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে গেছে। এতে শিশুটির হার্ট ব্লক হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আর আলিফাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। চিকিৎসক বললেন, সময় নষ্ট করে হাসপাতালে নিয়ে আসছেন। যদি এক ঘণ্টা আগে নিয়ে আসতেন, তাহলে হয়তো শিশুটি বেঁচে যেত।

ঘটনা ২.

গত ১১ মে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে মারা যান পৌরসভা ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাইফুল ইসলামের স্ত্রী কুলসুমা বেগম। সাইফুল ইসলাম বলেন, হঠাৎ প্রসববেদনা উঠলে রাত সাড়ে ১২টার সময় সন্দ্বীপ মেডিকেল সেন্টারে আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাই। হাসপাতালে তখন চিকিৎসক ছিলেন না। নার্সরা স্যালাইন, ইনজেকশন দিয়ে অবস্থার অবনতি দেখে ভোররাত চারটার সময় দ্রুত চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার জন্য বলেন।

রাতে নৌযান বন্ধ থাকাতে গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছাই সকাল ছয়টায়। ঘাটে গিয়ে জরুরি রোগী পারাপার করার জন্য কোনো নৌযান আছে কি না জানতে চাইলে টিকিট কাউন্টার থেকে নেই বলে জানানো হয়।

থাকলেও এখন দেওয়া যাবে না। স্টিমার ছাড়লে নিয়ে যেতে হয়। এদিকে স্টিমার সকাল সাতটায় ছাড়ার কথা থাকলেও সাড়ে আটটার দিকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাট থেকে কুমিরার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

এদিকে প্রসববেদনায় আমার স্ত্রীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায় কুমিরা ঘাটে পৌঁছাতে। পরে গাড়িতে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী মারা যায়।

ঘটনা ৩.

সন্তান নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় ঘাট কর্তৃপক্ষের হয়রানির স্বীকার হন আনিকা নাজরিন নূরা। তিনি বলেন, দুই মাস আগে স্বর্ণদ্বীপ ফাউন্ডেশন হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে আমার মেয়ের জন্ম হয়। আমি ভালো থাকলেও মেয়ে ভালো ছিল না। সে গর্ভে থাকাকালীন ময়লা খেয়ে ফেলে। তাই তার ফুসফুসে ইনফেকশন হয়। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সে খুব অসুস্থ ছিল। সারা রাত গিয়ে দিনের ১২টা বাজে, আমার মেয়ের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।

এদিকে হাসপাতালের কোনো চিকিৎসকই আমাদের চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার জন্য ছাড়পত্র দিচ্ছিলেন না। পরে আমার পরিবার থেকে চাপ দিলে তাঁরা ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হন। আমরা দেরি না করে চট্টগ্রাম যাওয়ার উদ্দেশ্যে গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছালাম। আবহাওয়া ভালো থাকায় স্পিডবোট ছেড়েছিল। কিন্তু যখন আমাদের কাছে অক্সিজেনের সিলিন্ডার দেখল, তখনই বলল স্পিডবোট ছাড়বে না। ঘাট কর্তৃপক্ষের তো আবার মানুষ মৃত্যুশয্যা হলেও কিছু যায় আসে না। এদিকে মেয়েকে না নিয়ে যেতে পারলে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। পরে তাদের হাতে পায়ে ধরে সাত হাজার টাকায় স্পিডবোট রিজার্ভ করে আমরা চট্টগ্রাম যাই।

সেদিন মনে হয়েছিল, এ কোথায় বাস করি আমরা! না আছে ভালো হাসপাতাল, না আছে ভালো চিকিৎসক, না আছে নিরাপদ যাতায়াতের ব্যবস্থা। মনে হচ্ছে, নরকে আছি। উন্নয়ন! উন্নয়ন! উন্নয়ন! কিসের উন্নয়ন? আমি তো সেদিন দেখিনি। সেদিন মনে হয়েছিল, এ দেশে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয়। সন্দ্বীপে চিকিৎসার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার মেটাতে ব্যর্থ জনপ্রতিনিধিরা।

ঘটনা ৪.

স্বচক্ষে দেখা এক বিভীষিকাময় মুহূর্ত বর্ণনা করতে গিয়ে স্বর্ণদ্বীপ ফাউন্ডেশন হাসপাতালের মিডওয়াইফ নাসরিন জাহান জানান, ১৮ জুন ৯টা ৩০ মিনিটে সামিয়া নামের এক মা সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছেলেসন্তানের জন্ম দেন। প্রসবপরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হলে চিকিৎসক সব ধরনের ওষুধ, ইনজেকশন দিয়েও যখন রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারেনি, তখন রোগীকে রেফার করা হয় চট্টগ্রামে।
দুর্যোগকালীন এই আবহাওয়ায় রোগী আমাদের কাছে আসেন। রোগীর গায়ে হাত দিয়ে যখন দেখি এই রোগীর জরুরি অপারেশন দরকার এবং সন্দ্বীপে এই অপারেশন সম্ভব নয়, তখনই রোগী এবং রোগীর স্বজনকে বলে দেওয়া হয় যে আমাদের কিছুই করার নেই, আপনারা চট্টগ্রাম নিয়ে যান। কিন্তু ওই যে যোগাযোগব্যবস্থা, একদিকে মাঝরাত অন্যদিকে অতিবৃষ্টি বাধা হয়ে দাঁড়াল।

অনেক চেষ্টা করেও রোগীকে চট্টগ্রাম পাঠানো সম্ভব হলো না।

যত রাত যায় রোগী ততই খারাপ হয়, আর আমরা ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকি তাকে বাঁচানোর। ভোররাত ৪টা ৩০ মিনিটে রোগীকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের হাসপাতাল থেকে বের করা হলেও চট্টগ্রাম যাওয়ার আগেই প্রাণ হারান তিনি।

আমার এখনো কানে বাজে তাঁর চিৎকার, ‘আল্লাহ আমি তোমার কাছে জীবন ভিক্ষা চাই, আমাকে জীবন ভিক্ষা দাও।’ আমার হাত ধরে বলেন, ‘ও আফা, আফা গো, আমি বাঁচব তো, বলেন না সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে তো? আপনি আমার ব্লিডিং বন্ধ করে দেন, আমি সুস্থ হয়ে যাব। আপা বলেন না, আমি বাঁচব তো?’
আর আমার দেওয়া সেই মিথ্যা আশ্বাস, ‘সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে, আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশা আল্লাহ।’
অথচ কিছুই ঠিক হয়নি, তাঁকে বাঁচানো যায়নি।

আজ যদি সন্দ্বীপের যাতায়াতব্যবস্থা উন্নত হতো অথবা চিকিৎসাব্যবস্থা ভালো হতো, তবে এভাবে কোনো মায়ের মৃত্যু আমাদের দেখতে হতো না। চিকিৎসাজীবনে প্রথমবার এমন মুহূর্তের সাক্ষী হলাম। জানি না, এই সন্দ্বীপে আর কতবার সাক্ষী হতে হবে এমন মুহূর্তের। সন্দ্বীপের মতো উপজেলায় জন্ম নেওয়াই আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল।

এ রকম শত শত ঘটনার সাক্ষী দ্বীপের বাসিন্দারা। একটি সি অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে প্রতিনিয়ত এভাবে প্রাণ হারাচ্ছে দ্বীপের অসহায় মানুষ। চিকিৎসক ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় জরুরি অবস্থাই প্রতিনিয়ত ছুটতে হয় চট্টগ্রাম। টাকার অভাব না থাকলেও যাতায়াতের এই করুণ পরিস্থিতি মৃত্যু ডেকে আনছে। অথচ দেখার কেউ নেই! গত ৫ বছরে গুপ্তছড়া উপকূলে সাগরে পড়ে লাশ হয়েছে ২৩ জন। যার একটিরও বিচার হওয়া তো দূরের কথা, তদন্ত প্রতিবেদন পর্যন্ত আসেনি। সন্দ্বীপে জন্ম নেওয়াই যেন এখন আজন্ম পাপ।

সন্দ্বীপ টিভির কর্ণধার খাদেমুল ইসলাম বলেন, আধুনিক যুগে এখনো রোগী পারাপারের কোনো নিরাপদ বাহন নেই। অন্ধকার সন্দ্বীপে বিদ্যুতের আলো পৌঁছালেও আলো আসেনি রোগী পারাপারে। সন্দ্বীপে নেই সরকারিভাবে প্রসূতি নারীর অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা, তাই জরুরি প্রয়োজনে নারীদের সন্দ্বীপ থেকে নিয়ে যেতে মৃত্যুর মুখে পড়তে হয়। এ পর্যন্ত সাগরপথেই অনেক নারীর সলিলসমাধি হয়েছে, গর্ভপাত হয়েছে অনেকের। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীদের সন্তানও নষ্ট হয়েছে অনেক।

সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মাহফুজুর রহমান মিতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে যে দুটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে, এগুলো উত্তাল সাগরে চলার অনুপযোগী। এগুলো হাওর এলাকার জন্য প্রযোজ্য। আমি বারবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সাগরে চলার উপযোগী সি অ্যাম্বুলেন্সের জন্য দাবি করে আসছি। তারাও আমাকে আশ্বাস দিয়েছে। ওঠানামার যে কষ্ট, সেটা লাঘবে শিগগিরই ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হবে।’

  • লেখক: জিসান মাহমুদ, কুয়েত থেকে