আমাদের মানসিকতা, চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির কি পরিবর্তন হবে না

শিক্ষার্থী
ফাইল ছবি

বাংলা সাহিত্যে মোতাহার হোসেন চৌধুরী এক অবিস্মরণীয় নাম। মূলত একজন গদ্যকার হিসেবে তাঁর নাম বিশেষভাবে উচ্চারিত হয়। মোতাহার হোসেন চৌধুরীর লেখায় সব সময় মননশীলতা ও চিন্তার স্বচ্ছন্দের প্রকাশ ঘটত এবং এই একটি কারণে তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও তিনি আলাদাভাবে পরিচিতি পেয়েছেন।

আমরা যখন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী, তখন আমাদের বাংলা প্রথম পত্রের পাঠ্যবইয়ে ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ নামক একটি প্রবন্ধ ছিল। এ প্রবন্ধের মাধ্যমে মোতাহার হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। সত্যি কথা বলতে গেলে, ওই সময় আমরা মূলত পরীক্ষায় পাস করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পড়াশোনা করতাম। আজকের দিনেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী কেবল পরীক্ষায় পাস করার জন্য পড়াশোনা করে। প্রকৃতপক্ষে আমরা কেউই জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়াশোনা করি না। আমাদের মা–বাবা কিংবা আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা আমাদের জোরপূর্বক কিছু বিষয় গলাধঃকরণ করান আর আমরা ওই সব চর্বিত চর্বণকে পরীক্ষার খাতায় উপস্থাপন করি। এভাবে এ দেশে মূল্যায়ন করা হয় কে পাস কিংবা কে ফেল। আমাদের মা–বাবা কিংবা শিক্ষকেরা কখনো কোনো বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে শেখান না। স্লোভেনিয়াতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সব সময় চিন্তার গভীরতা প্রসারের জন্য উৎসাহ দেন। ক্লাসের শুরুতে কিংবা ক্লাসের শেষে প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষিকার একটাই জিজ্ঞাসা, ‘ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি কোয়েশ্চেন?’ যদি কোনো কারণে কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রশ্ন না আসে, তাহলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকা মনে করেন, তিনি ওই দিন সঠিকভাবে ক্লাস পরিচালনা করতে পারেননি। অথচ আমাদের দেশে এমন অনেক শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকা আছেন, যাঁরা প্রকাশ্যে আমাদের কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করেন। এ ছাড়া দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের মধ্যে অন্যের মতামতকে শ্রদ্ধা করার প্রবণতা খুবই কম। সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন এ ধরনের দৃশ্য এখন খুবই সাধারণ। কেউ কোনো একটি বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখল, কারও কাছে সে পোস্ট মনঃপূত হলো না।

এ পর্যন্ত সবই স্বাভাবিক, সবার কাছে সবকিছু ভালো লাগবে না এবং প্রত্যেক ব্যক্তির স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করার অধিকার রয়েছে। তবে যখন দেখি ওই ব্যক্তি মন্তব্য সেকশনে গিয়ে পোস্টদাতাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করছেন, তখন সত্যি হতাশ হতে হয়। মাঝেমধ্যে এমন কিছু মন্তব্যও দেখা যায়, যেগুলো পোস্টের মূল প্রসঙ্গের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পর্কিত নয় এবং এসব মন্তব্য এতটা দৃষ্টিকটু হয় যে সেগুলোর বিপরীতে কোনো উত্তর দেওয়ার মতো স্বাভাবিক অবস্থা থাকে না। স্কুল কিংবা কলেজজীবনে দেখতাম, যখন আমার কোনো সহপাঠী কোনো প্রশ্ন করত, কিন্তু সেটা কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক বা শিক্ষিকার কাছে ভালো লাগত না, তখন ওই সহপাঠীকে বিভিন্নভাবে ভর্ৎসনার শিকার হতে হতো। এ ছাড়া ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন সময় তাকে নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করত। এ কারণে ভয় ও শঙ্কার জায়গা থেকে অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ক্লাসে প্রশ্ন করার সাহস পেত না।

ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি, পলাশীর যুদ্ধে সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলা লর্ড ক্লাইভ সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হয়েছিলেন। আমরা কি কখনো একবার নিজেদের প্রশ্ন করেছি, আমাদের যা শেখানো হচ্ছে, তা আদতে কতটুকু সঠিক? কিংবা মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা কীভাবে শেষ পর্যন্ত নবাবের পরাজয় রচিত করেছিল, সে বিষয়ে আমরা কখনো গভীরভাবে চিন্তা করি না। প্রকৃত ইতিহাস হচ্ছে, ওই সময় সারা পৃথিবীতে গ্রেট ব্রিটেন এক দুর্দমনীয় পরাশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ছিল এমন এক সাম্রাজ্য, যে সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যেত না। নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে এশিয়া ও আফ্রিকা, এমনকি উত্তর আমেরিকা পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে তাদের উপনিবেশ ছিল। এমনকি আধুনিক ফ্রান্স রাষ্ট্রের স্থপতি নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, যিনি জীবনে এর আগে কখনো যুদ্ধে হারেননি, তিনিও ওয়াটার লুর যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হাতে পরাজিত হয়েছিলেন।

পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার অধীন সৈন্যসংখ্যা ছিল ৬৫ হাজারের মতো। অন্যদিকে রবার্ট ক্লাইভের পক্ষে সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৩ হাজার। যুদ্ধের ময়দানে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর ও তাঁর অনুসারী প্রায় ৪৫ হাজার সেনাসদস্য নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তারপরও নবাবের অবশিষ্ট ২০ হাজার সৈন্য কেন রবার্ট ক্লাইভের ৩ হাজার সৈন্যকে পরাজিত করতে পারেননি? সত্যি কথা বলতে, গ্রেট ব্রিটেনের সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত প্রশিক্ষিত। তাদের কাছে ওই সময়ের অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল। অন্যদিকে নবাবের সেনারা সে অর্থে পেশাদার ছিলেন না। বেশ কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে এমনটিও জানা যায় যে নবাবের সেনাবাহিনীতে এমন অনেক সেনাসদস্য ছিলেন, যাঁরা মূলত কৃষিকাজ বা অন্য কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন, কিন্তু প্রয়োজনের সময় প্রতিরক্ষার স্বার্থে নবাবের সেনাসদস্য হিসেবে কাজ করতেন।

এ ছাড়া ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন, অর্থাৎ যেদিন পলাশীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়, ওই দিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক দাবি করেন, বৃষ্টির কারণে নবাবের পক্ষে থাকা সেনারা কামান ব্যবহার করতে পারেননি। কামানের সাহায্যে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য আগুনের গোলা সৃষ্টি করতে বারুদের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ওই দিন বৃষ্টির কারণে বারুদ পানিতে ভিজে যায় এবং ব্যবহারের অনুপযোগী পড়ে। এ কারণে নবাবের সেনারা কামান চালাতে পারেননি। রবার্ট ক্লাইভের সেনাবাহিনী এ বিষয়ে আগের থেকে সতর্কতা অবলম্বন করেছিল। পলাশী যুদ্ধের সাত বছর পর, অর্থাৎ ১৭৬৪ সালে বিহারের বক্সার নামক স্থানে মীর কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও শেষ মুঘল সম্রাট শাহ আলম সম্মিলিতভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ যুদ্ধেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের জয় হয়। বক্সারের যুদ্ধে মীর জাফরের মতো কোনো বিশ্বাসঘাতক ছিল না।

তারপরও মীর কাশিম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও শেষ মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সেনাসদস্যরা এক হয়েও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদের হারাতে পারেননি। আসলে ওই সময় গ্রেট ব্রিটেনের উন্নত ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য পৃথিবীর কোনো দেশের কাছে ছিল না। আর এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তখন ইংরেজরা উপনিবেশ স্থাপন করছিল।

ক্লাসে আমাদের যা শেখানো হচ্ছে কিংবা এত দিন পর্যন্ত আমরা যেসব বিষয় জেনে এসেছি, সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা জরুরি। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এতটা দূরের পথ পর্যন্ত ভাবতে শেখায় না। এ ছাড়া আমরা যেমনিভাবে অপরের মতামতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে বিবেচনা করতে চাই না, ঠিক একইভাবে নতুন করে কোনো কিছু জানতে পারার মধ্যে যে আনন্দ, সেটিকেও আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি না। আমরা কেবল পরীক্ষায় পাস করি, কিন্তু শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য আমরা অর্জনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। এ কারণে ক্লাস সেভেনে আমরা যা পড়ি, ক্লাস এইটে এসে সেটা বেমালুম ভুলে যাই।

মোতাহার হোসেন চৌধুরীর প্রবন্ধ ক্লাস নাইনে পড়েছি, কিন্তু লেখক আমাদের তাঁর এ প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, সেটা বুঝতে আমাকে আরও ১১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।

স্লোভেনিয়া ও বাংলাদেশ—এ দুই দেশকে যখন একই সময়ে একসঙ্গে দেখার চেষ্টা করি, বুকফাটা আর্তনাদে আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ি। স্লোভেনিয়াতে সব শিক্ষার্থী উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য ইউনিভার্সিটিতে আসেন, তেমনটি হয়। স্কুলজীবনের পাঠ চুকিয়ে হাতেগোনা অল্প কিছু শিক্ষার্থী ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। অথচ বাংলাদেশে ইন্টারমিডিয়েট শেষ হতে না হতেই সবাই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন। যদি কোনো শিক্ষার্থী কোনো কারণে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাস করার পর ব্যাচেলর প্রোগ্রামে ভর্তি হতে না পারেন, তাহলে সমাজ তাঁকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। স্লোভেনিয়াতে কেউ কোনো কাজের জন্য আবেদন করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর দক্ষতা যাচাই করা হয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এমন কিছু গৎবাঁধা জিনিস যাচাই করা হয়, যেটা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। এমনকি চাকরির ইন্টারভিউতে এমন অনেক প্রশ্ন করা হয়, যেগুলো সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে কোনোভাবে যায় না। ইউরোপের দেশগুলোয় কারিগরি শিক্ষাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা বেশ অবহেলিত।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা সার্টিফিকেট একজন মানুষকে মূল্যায়ন করার জন্য কোনো ধরনের চাবিকাঠি হতে পারে না। রোনাল্ড রিগ্যান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রোনাল্ড রিগ্যান কোনো দিন কোনো ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেননি। অথচ রিপাবলিকান শিবিরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্টদের একজন হিসেবে সম্মানিত হন। তাঁর চতুরতার কাছে গর্বাচেভ হেরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন, যার পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সে অর্থে আহামরি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিন্তু তাঁকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অতিথি করার জন্য স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড কিংবা ইয়েলের মতো বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব সময় প্রচেষ্টা চালাত। স্টিভ জবস সব সময় একটা কথা বলতেন, ‘থিংক ডিফারেন্ট’। এসব বিশ্ববিদ্যালয় স্টিভ জবসকে সম্মান জানিয়েছে তাঁর কাজ ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে। স্টিভ জবসের একাডেমিক যোগ্যতাকে এসব বিশ্ববিদ্যালয় কখনো বিবেচনায় আনেনি।

মোটামুটিভাবে এটা বলা যায়, বাংলাদেশে যাঁরা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পদে চাকরির সুযোগ পান, তাঁরা সবাই মেধাবী। কিন্তু তারপরও এ দেশের প্রশাসনে কেন অদক্ষতা চোখে পড়ার মতো? ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে ইন্টারমিডিয়েট, এমনকি অনেকে অনার্স বা মাস্টার্সও ইংরেজি মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকেন। তারপরও ইংরেজিতে কেন আমাদের আশানুরূপ দক্ষতা নেই? এমনকি অনার্স ও মাস্টার্স পাস করার পরও আজকের দিনে বাংলাদেশে এমন অনেক নাগরিক রয়েছেন, যাঁরা সঠিকভাবে নিজের মাতৃভাষা লিখতে পারেন না। শিক্ষার মান উন্নয়নে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনকি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নিজ অধিকার আদায়েও সচেতনতা নেই।

ঘুরেফিরে আবারও প্রমথ চৌধুরীর ওই একই কথা। আমাদের শিক্ষা দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা—তিনটির কোনোটিই আমরা খুঁজতে শিখিনি। মা–বাবা ও শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে এ সমাজের সব মানুষ আমাদের এ জীবনকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপের জন্য সমষ্টিগতভাবে দায়ী। স্লোভেনিয়াতে একবার এক পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন করার চেষ্টা করেছিলাম। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক সেটি দেখে ফেলেন। তিনি আমাকে আলাদাভাবে তাঁর রুমে নিয়ে যান এবং আমাকে তিনি বলতে থাকেন, ‘হয়তোবা তুমি আজকের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে পাস করে যাবে, কিন্তু নিজের বিবেককে একটি প্রশ্ন করো। পরীক্ষায় পাস করার জন্য তুমি যে অসদুপায় অবলম্বন করেছ, সেটা কি ঠিক হয়েছে?’ অধ্যাপক আমাকে বললেন, ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত একজন সৎ মানুষ হওয়া, তোমার জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করা। একজন মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে সফল হতে পারেন, কিন্তু তিনি যদি সৎ না হন, তাহলে তাঁর এ সফলতা সমাজে লাভের চেয়ে বরং ক্ষতি বয়ে আনে। কিন্তু একজন সৎ মানুষ আহামরি কিছু না করলেও তিনি অন্তত কারও ক্ষতি করেন না। একদিন তিনি কোনো না কোনোভাবে সম্মানিত হবেন।’

আমাদের দেশের চিত্র সম্পূর্ণভাবে উল্টো। এমনকি মা–বাবা বা শিক্ষক-শিক্ষিকারাও পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের পরামর্শ দেন। আমরা ফলাফলকে গুরুত্ব দিই, কিন্তু ফলাফল কোনো প্রক্রিয়ায় অর্জন করা হচ্ছে, সেদিকে আমাদের মাথাব্যথা নেই। সবার একটাই চিন্তা, সমাজ কী বলবে। আমাদের দেশের বাবা-মায়েদের কাছে সন্তানেরা হচ্ছে শো অফের বস্তু। সন্তান ডাক্তার হবে কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হবে অথবা বিসিএস ক্যাডার বা আর্মির অফিসার হবে এবং মা–বাবা সমাজের আর দশজন মানুষের কাছে এ বিষয় বলে বেড়াবেন। এটাই এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রবণতা, এ দেশের বাবা-মায়েরা তাঁদের ইচ্ছাকে জোরপূর্বক সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেন। সন্তানের কোনো আকাঙ্ক্ষার মূল্য তাঁদের কাছে নেই। ‘ফেইলর ইজ দ্য পিলার অব সাকসেস’—এই প্রবাদ বাক্য এ দেশে খাটে না। এ দেশের সমাজ ব্যর্থদের ছুড়ে ফেলে দেয়, এ কারণে বাংলাদেশে একজন আব্রাহাম লিঙ্কনের জন্ম হয় না।

একবার এক পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম। শিক্ষক আমাকে তাঁর রুমে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কি এ কোর্সের বিষয় বুঝতে কোনো সমস্যা হয়?’ আমি বললাম, আমার এ কোর্সের কোনো বিষয় বুঝতে সমস্যা হয় না, তবে এ কোর্সের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। কেননা, পুরো কোর্স আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর মনে হয়। আমার কথা শুনে প্রফেসর বললেন, ‘মানুষের জীবনের প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রকৃত সুখ অন্বেষণ করা। তোমার জীবনে সব থাকতে পারে, কিন্তু যদি সুখ নামক বিশেষ জিনিসটি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে জীবনে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ থাকে না।’ প্রফেসর আরও বলেন, ‘তোমার যদি এ সাবজেক্টে মাথা ঘামাতে ইচ্ছা না করে, আমি তোমাকে কয়েকটি টপিক দিয়ে দেব পরীক্ষায় পাস করার জন্য। তারপরও তুমি কখনো দুশ্চিন্তা কোরো না। এতে তুমি শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে।’

ওই দিন ওই প্রফেসরের এ কথা শোনার পর আমি অঝরে কেঁদেছিলাম। আমি দেশের কোনো মা–বাবা কিংবা কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকাকে এভাবে কথা বলতে শুনিনি। আমাদের গুরুজনদের কেউই কখনো সুখী হওয়ার শিক্ষা দেন না, আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের কেউ কখনো ভালো মানুষ হওয়ার পরামর্শ দেন না। সবাই শুধু প্রাপ্তি খোঁজে। আমরা সততার মূল্য দিতে জানি না। এ কারণে রুই-কাতলাদের মাঝে অনেক লোক ঘুরে বেড়ায়, যারা নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ, কিন্তু সবকিছু প্রকাশ্য থাকার পরও এ দেশের সাধারণ মানুষের কাছে তাদের সম্মানের ভাটা পড়ে না এবং তাদের সান্নিধ্য লাভের জন্য আমরা চাতক পাখির মতো প্রহর গুনি। অর্থচিন্তার নিগড়ে আজও আমরা সবাই বন্দী।

মোতাহার হোসেন চৌধুরী ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ নামক প্রবন্ধটি রচনা করেছেন গত শতাব্দীর ত্রিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশের দশকে। এত বছর পর আজকের এই দিনে তাঁর প্রবন্ধের প্রতিটি লাইন প্রাসঙ্গিক, বরং ওই সময়ের সঙ্গে আজকের সময়কে তুলনা করা মানে ফুটন্ত কড়াইয়ের সঙ্গে জ্বলন্ত উনুনের তুলনা করা। অবকাঠামোগতভাবে বাংলাদেশ আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন সে অর্থে হয়নি। দিন শেষে একটা প্রশ্ন, আমরা কি চিন্তার স্বাধীনতা, বুদ্ধির স্বাধীনতা অথবা আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতার যেকোনো একটিকে খোঁজার চেষ্টা করেছি? নাকি এ তিন বিষয়ে আমাদের ধারণা নেই? মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধনে আমরা কতটুকু সচেষ্ট? সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে আমরা কি আদৌ কোনো উদ্যোগ নিতে পেরেছি? এ প্রশ্নগুলো নিয়ে আরও একবার ভাবার সময় এসেছে। সব উন্নয়নের পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, সব সম্ভাবনার রাস্তা একে একে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে। সেই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে, যদি না আমরা আমাদের মানসিকতা, চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে সমর্থ হই।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।