কানাডার হ্যালিফ্যাক্সে সরস্বতীপূজা
বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন অব আটলান্টিক, কানাডা (বিএএসি) তাদের প্রথম সরস্বতীপূজার আয়োজন করেছিল বেশ সাড়ম্বরে। এ বছর হ্যালিফ্যাক্স শহরে সরস্বতীপূজা হয়েছিল তিনটি। প্রথম দুটি ১ ফেব্রুয়ারিতেই অনুষ্ঠিত হয়। বিএএসির পাশাপাশি শারদীয় সোসাইটি ও ইস্ট কোস্ট সোসাইটিও পূজার আয়োজন করেছিল।
আমাদের পূজার স্থান ধার্য করা হয় বেদান্ত আশ্রম সোসাইটির হ্যালিফ্যাক্স হিন্দুমন্দিরে। দিনটি ছিল শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারি। পঞ্জিকা অনুযায়ী মূল পূজা হয়েছিল শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে—৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, প্রবাসে ভক্তিই মুখ্য, এখানে ওইভাবে পাঁজি অনুযায়ী দিনক্ষণ মেপে সবকিছুর আয়োজন ক্ষেত্রবিশেষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এর আগের দিন ঈশিতাদি জানতে চাইলেন, মা ওনাদের সঙ্গে পূজার উপাচার সাজাতে একটু হাত লাগাবেন কি না। আমাকে মা অনেক আগেই ওনার আগ্রহের কথা জানিয়ে রেখেছিলেন। মূল যোগাযোগ দেবীদির মাধ্যমে হলেও মোটামুটি সবাই খুদে বার্তা আদান-প্রদান করেছি। জীবনদা, সুস্মিতাদি, অরূপদা—সবাই। জীবনদা তো কয়েকবার মুঠোফোনে কথাও বলেছেন। আমার বন্ধুদের ভেতরে অপু আর জয়শ্রীকে আগেই বলা ছিল। ওরা সেচ্ছাসেবী হিসেবেও কাজে আগ্রহী ছিল।
নির্ধারিত দিনে আমি আর মা সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। ঘড়িতে বাজে ৮টা ১৫ মিনিট। বরফে বেশ পিচ্ছিল হয়ে যায় রাস্তাঘাট। বরফের আস্তরণ জমে গিয়ে যখন কাচের আকৃতি ধারণ করে, তখন সেটায় পা দেওয়া মানেই নির্ঘাত চিতপটাং! কোনো জুতা এতে কাজে আসে না। মাকে নিয়ে বের হব। ট্যাক্সি কিছুটা দূরে আছে। কিন্তু কিছুটা পথ আমাদের হেঁটে যেতে হবে। এর মধ্যেই ঘটল বিপত্তি! মাকে বললাম আমাকে ধরে চলতে। মুখে বলছিলাম, পড়ে যাবে! বলতে বলতে ঘটনা ঘটে গেল। পুত্রের মুখনিঃসৃত বাণীকে মহাসত্য প্রমাণিত করে মা আমার পিছলে গেলেন পড়ে।
ভাগ্য ভালো যে সরস্বতী কৃপা করেছেন। পড়েছেন বরফের চাঁইয়ের মাঝে। তারপরও আমি ভীষণ বাজে আশঙ্কা করেছিলাম! কারণ, ওনার ডান পায়ে অপারেশন হয়েছিল বছর কয়েক আগে। সব দুর্ভাবনা মিথ্যা করে দিয়ে মা মহানন্দে কাজে লেগে গেলেন মন্দিরে পৌঁছেই। মন্দির দ্বিতল ভবন। ওপরের তলায় পূজা হয় আর নিচের তলায় প্রসাদ বিতরণ। বেজমেন্টেও সবকিছুর ব্যবস্থা আছে। কচিকাঁচারাসহ সবার অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ওখানে।
মাকে নিয়ে যখন ওপরে পৌঁছেছি, তখন দেখি কেউই তেমন আসেননি। নিচে রান্নাঘরে ওরা হাঁড়ি–বাসন নিয়ে ব্যস্ত। নিবেদিতার জামাইকে দেখলাম, দিব্যি একটা কিচেন অ্যাপ্রোন গলায় ঝুলিয়ে কাজে নেমে গেছে। সঙ্গে শাগরেদরাও রয়েছেন।
মা যখন দূর্বাঘাসের ত্রিপত্র ঘটের জন্য, পূজার পানের খিলি সুপারিসহ সাজিয়ে দেওয়ার কাজে ব্যস্ত, তখন অন্যরাও এসে যোগ দিলেন। শ্রাবন্তীকেও মিষ্টি, ফল উপাচার সাজিয়ে দেওয়ার কাজে লেগে পড়তে দেখছি। তাঁরা সবাই একসঙ্গে কাজ এগিয়ে নিতে লাগলেন। আর আমি কখনো ঘটের জল আনা, নিচের রান্নাঘর থেকে বড় থালা জোগাড় করে আনা, পুষ্পার্ঘ্যের ফুলের জন্য বড় বেশ কিছু ট্রেও চাওয়া হয়েছে। ঈশিতা দিদি প্রতিমার সাজগোজের কাজ সামলাতে ব্যস্ত। আমরাও লেগে গেছি। দূরে ফুল দিয়ে একটা সজ্জা করেছেন তিনি। সেটা গুছিয়ে দিয়ে চলে গেলাম মূল দেবী প্রতিমার পেছনের দিকের সাজসজ্জায় তদারকির দায়িত্ব নিতে। চিকন বাঁশের টুকরা দিয়ে তৈরি করা হবে প্রতিমার পেছনের সজ্জা। আরও ছেলেপুলেদের গ্রুপ জড়িত রয়েছে এসব কাজে। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছি।
সবাই কাজে ব্যস্ত, এরই মধ্যে অপু আর তার সহধর্মিণী জয়শ্রী উপস্থিত হয়েছে। স্বাগতদা এসেছেন সস্ত্রীক, সঙ্গে তাঁদের পুঁচকে বালক। তিনজনেই আকাশি নীলাভ বর্ণের বেশভূষায় সজ্জিত হয়ে এসেছেন। একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না, তা হলো ওনারা সবাই একই রঙের কাপড় পরিধান করেন। দুর্গাপূজার সময় গোলাপি পাঞ্জাবির সঙ্গে একই রঙের শাড়ি পরেছিলেন বউদি। আর পিচ্চিও একই সাজ! বেশ আমুদে পরিবার বলতে হবে। আমার মা অবশ্য দূর্বাঘাসের রঙে রাঙানো একটা শাড়ি বেছে নিয়েছেন।
যেহেতু সরস্বতীপূজায় প্রেম, পয়লা ফাল্গুন—এসবের আমেজ জড়িয়ে আছে, তাই সবার সাজে হরিদ্রা বর্ণের আধিক্য লক্ষ করা যাচ্ছে। কানাডার নোভাস্কোশিয়ার রাজধানীতেও তার কোনো বৈপরীত্য নেই! বাঙালি সবখানেই তার চিরায়ত ভাবগাম্ভীর্য বজায় রেখে উৎসব উদ্যাপন করেছে।
দেবীদি সবখানেই দৌড়াদৌড়ি করছেন। জীবনদা এসেই মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চলে গেলেন। সুস্মিতাদিকে কিছুক্ষণ পরেই দেখছি। বীথিকাদি আর ঈশিতাদি মিলে মাকে একটা টুলের ওপর বসিয়ে দিলেন। প্রথমে আমি বললেও তা কর্ণপাত করেননি, পরবর্তীকালে দিদিরা মিলে আমার কাজটা সারলেন। জয়শ্রীর কোলে বেশ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে স্বাগতদার পিচ্চি। কিছুক্ষণ আগেও সে সজাগ দৃষ্টি রাখছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, টেরই পাইনি।
যথাসময়ে পণ্ডিত মশাই সৌভিকদা মাইকে ঘোষণা দিলেন পুষ্পাঞ্জলির। সবাই গুটি গুটি পায়ে দেবীর সামনে উপস্থিত হয়েছেন। পণ্ডিত মশাই মনে করিয়ে দিলেন, তিনবার অঞ্জলির পর প্রণামমন্ত্র রয়েছে। সবাই প্রথমে বসে পুষ্পার্ঘ্য দিচ্ছিল। পণ্ডিত মশাই সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘বসে বসে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া যায় না!’ বেশ সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে সবাই অঞ্জলি দিলাম।
এরপর প্রসাদ বিতরণের ধুম পড়ে গেল। পূজা শেষ হয়নি যদিও; মা আপন মনে বসে রয়েছেন। উপোস করেছেন। যতক্ষণ ঘট বিসর্জন না হবে, তিনি অন্নজল গ্রহণ করবেন না। আমি তো নিচে চলে এসেছি; সঙ্গে অপু, জয়শ্রী, স্বাগতদা, বউদি, পিচ্চি—সবাই রয়েছে। আরও নতুন দুই মুখের সঙ্গে পরিচয় হলো আজ—ওরা একজন সিলেটের, আরেকজন নোয়াখালীর। অপু বেশ খোশমেজাজে গল্প জুড়ে দিয়েছে প্রথমে বউদির সঙ্গে। মূলত তারা দুজনেই শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্তন ছাত্রছাত্রী, এক জায়গায় এসেছেন। অতএব পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করা। এই ডিপার্টমেন্ট, ওই ডিপার্টমেন্ট, ওই মুখ, এই বন্ধু, বান্ধবী। এসব চলতে লাগল।
বেশ মজার প্রসাদ রয়েছে—আপেল, বরই, কলা, মিষ্টি, আঙুর, কমলা, খিচুড়ির সঙ্গে বাঁধাকপি, আলু। সবাই বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি। এরপর ভাবতে লাগলাম, এখনই পেট ভরে গেছে, তাহলে একটু পরে দুপুরের খাবার খাব কী করে? উদরে জায়গা খালি আছে তো?
আমি প্রসাদ শেষ করে ওপরে মায়ের কাছে ফিরে গেছি। তখন পণ্ডিত মশাই বেশ ব্যস্ত। ঈশিতাদি শঙ্খ বাজাচ্ছেন। বিদায়ের সময়ের শঙ্খ বাজছে। ঘট বিসর্জন হয়ে গেল। মা শঙ্খের সঙ্গে তাল রেখে উলুধ্বনি দিলেন। পূজার আনুষ্ঠানিকতার সমাপ্তি ঘটল।
এরপর মায়ের ফল প্রসাদ নেওয়ার পালা। নিচে নিয়ে গিয়েছি তাঁকে। সবার সঙ্গে বসে প্রসাদ নিলেন। ওদিকে মাইকে বলা হলো, কচিকাঁচাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আমরা এরপর দল বেঁধে চলে গেলাম গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ঈশিতাদি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছেন।
কিছুটা অংশ তুলে ধরেছি—‘মন কী শক্তি’ (সমবেত সংগীত) পরিবেশায় ছিল সানভি সরকার, প্রিশা বন্দ্যোপাধ্যায়, অবণী বিষ্ণু, ‘সরস্বতী মাতা জয়তে জগজ্জননী’ গেয়েছে অনুস্রিতা চক্রবর্তী, প্রিশা বন্দ্যোপাধ্যায়। গানের পাশাপাশি তারা সরস্বতীবন্দনার নাচেও অংশ নিয়েছে। শ্রুতি চক্রবর্তী গেয়েছে ‘মধুর মধুর ধ্বনি’, জীবনদা নিজের লেখা গানে সুর করেছেন নিজেই—‘মা সরস্বতী’। ‘জয় জয় হে ভগবতী’ সমবেত নৃত্যে অংশগ্রহণ করেছিল আরশী, সুভাঙ্গী, রাইনি, সিলভিয়া, রিদ্ধিমা ও সিন্ধুজা।
শুধু ছোট্টরা অংশ নিয়েছে তা নয়, কিছুটা হাসি–মজার ছলে ‘কর্তাগিন্নির বাগ্যুদ্ধ’ শ্রুতিনাটকে ছিলেন অনিন্দ্য ও দীপা। দেবপ্রিয়ার নৃত্যে সবাই দেখেছে ‘মধুর ধ্বনি’। এ ছাড়া আরও কবিতা, গান ও নৃত্যে ভরপুর ছিল পুরো অনুষ্ঠান। প্রাণবন্ত একটা উপস্থাপনা করেছে সবাই মিলে।
এবার বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পালা।
সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বাড়ির পথে ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম মা-ছেলে।
**‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: dp@prothomalo.com