২০১৮ থেকে ২০২৪: বদলে যাওয়া স্বপ্ন, একই সংকট
২০১৮ সালে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ততকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলাম। তখন আমার এই চিঠি গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে অনেকে ভয় পেয়েছিল। শেষমেশ সাহসিকতার সঙ্গে একটি অনলাইন পোর্টাল ২ জুন, ২০১৮-তে এটি প্রকাশ করে। চিঠির মূল বিষয় ছিল গণতন্ত্রের চর্চার অভাব, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অদক্ষতা নিয়ে। আমি লক্ষ্য করেছিলাম, গণতন্ত্রের নামে দেশে মূলত ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি ও ক্ষমতার দখল চলছে। রাজনৈতিক দুর্নীতি, ঘুষ এবং প্রশাসনিক অদক্ষতার ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছিল। আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম যে দেশের প্রকৃত গণতন্ত্র বিলীন হতে চলেছে এবং স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা করতে পারিনি।
উদ্বেগ, হতাশা ও অসহায়ত্বের মধ্যে আমি একটি খোলা চিঠি লিখেছিলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে। আমার চিঠিটি ছিল আমার মনের গভীরে জমে থাকা কষ্টের প্রকাশ, যা প্রকাশ করতে হয়তো অন্য কেউ সাহস পায়নি, কিন্তু আমি নির্ভয়ে তা প্রকাশ করেছিলাম। আমি চাইছিলাম সেই বার্তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাতে, কিন্তু জানি না আদৌ তা পৌঁছেছিল কিনা।
চিঠিতে আমি বলেছিলাম, আমাদের গণতন্ত্র আর বাক্স্বাধীনতা কি কেবল নামেই আছে? কেন আমরা এত বছর পরেও আমাদের স্বাধীনতার আসল সুফল পেতে ব্যর্থ? দেশের সাধারণ মানুষ প্রতিদিন দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির জালে আটকে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদেরা নিজেদের স্বার্থে জনগণকে ভুল পথে চালিত করছে। আমি তখনই অনুভব করেছিলাম, এ অরাজকতার মধ্যে আমরা কেবল বেঁচে আছি, কিন্তু প্রকৃত স্বাধীনতা থেকে আমরা অনেক দূরে।
দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে আমি সব সময়ই দেশের অন্যতম সম্পদ হিসেবে দেখেছি। কিন্তু কেন তারা ব্যারাকে বন্দী থাকবে? কেন তারা দেশের উন্নয়নে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে না? কেন তাদের কেবল জাতীয় উৎসবের দিনে দেখা যায়? তাদের সক্রিয়ভাবে কাজে লাগালে দেশের কত উপকার হতে পারত, কত সমস্যা সমাধান হতে পারত। তখনো আমি বিশ্বাস করতাম, আজও বিশ্বাস করি—দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি নাগরিক যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে, তবে আমরা সোনার বাংলা গড়তে পারি।
আজ ২০২৪ সালে এসে আমি সেই সময়ের দিকে ফিরে তাকাই। কিছু উন্নতি হয়তো হয়েছে, কিন্তু আজও দুর্নীতির সেই জাল ছিন্ন হয়নি। আজও আমাদের রাজনীতিতে স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার চলছেই। আমার কষ্ট তখনো ছিল, আজও আছে। কষ্ট এই জন্য যে, আমরা হয়তো আরও ভালো করতে পারতাম, আরও আগেই পরিবর্তন আনতে পারতাম। কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে, এসবের হিসাব কে রাখবে?
তবুও, আমি আশা ছাড়িনি। আমি তখনও লিখেছিলাম, আজও বলছি—‘Never too late to change your mind.’ এই পরিবর্তনের জন্য আমাদের সবার একসাথে কাজ করতে হবে। আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। আমি জানি, আমরা পারি। শুধু প্রয়োজন সাহস, সততা এবং ঐক্যের।
আজ আমি সেই শিক্ষার্থীদের বলতে চাই, যারা দেশের জন্য লড়ছে—তোমরা থেমে যেয়ো না। তোমাদের লড়াইয়ে আমি আছি, আমি থাকব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের সোনার বাংলা সত্যিকার অর্থে সোনার মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, ততক্ষণ তোমাদের মিশন চালিয়ে যাও। আমরা একদিন ঠিকই সফল হবো।
একই সাথে আমি অন্তবর্তী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলতে চাই, যদি আমরা সত্যিই সোনার বাংলা গড়তে চাই, তবে আমাদেরকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। এগুলো শুধু একটি ধারণা নয়, বরং আমাদের প্রতিদিনের কর্মপন্থার অংশ হতে হবে—
১. দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা: দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে হলে, প্রথমে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক সব স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য দরকার সঠিক আইনি কাঠামো ও সুশাসন।
২. স্বজনপ্রীতির অবসান: ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নেতৃত্বের পজিশন দখল বন্ধ করতে হবে। যোগ্যতা এবং সততার ভিত্তিতে সব গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে হবে, যেন সঠিক মানুষ সঠিক দায়িত্ব পায়।
৩. সুশাসন প্রতিষ্ঠা: প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে, যাতে জনগণের আস্থা ফিরে আসে। এর জন্য প্রশাসনিক দক্ষতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
৪. শিক্ষা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি: শিক্ষার মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে, যেন তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। আধুনিক ও সৃজনশীল শিক্ষার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে, যারা সত্যিকার অর্থে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে।
৫. সশস্ত্র বাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যকর ব্যবহার: সশস্ত্র বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর হুমকি মোকাবিলায় আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। উন্নয়নমূলক কাজেও তাদের ভূমিকা আরও বাড়াতে হবে।
৬. নাগরিকদের সম্পৃক্তকরণ: জনগণকে দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে। জনমতের গুরুত্ব দিতে হবে এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। গণতন্ত্রের প্রকৃতচর্চার মাধ্যমে জনগণের সম্মিলিত শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে।
৭. উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা: নতুন উদ্যোক্তা তৈরি এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে হবে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা যাবে এবং নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।
৮. পরিবেশ সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন: পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রেখে উন্নয়নের পরিকল্পনা করতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে সংযম এবং পুনঃচক্রায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
৯. সামাজিক ন্যায়বিচার ও সমতা: সমাজের সব শ্রেণির মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তারা সঠিকভাবে দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে পারে।
১০. প্রবৃদ্ধির জন্য পরিকল্পিত বিনিয়োগ: অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য পরিকল্পিত বিনিয়োগ করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো এবং প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হয়।
পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সুশোভিত করেছেন। এর মধ্যে অনেক কিছু আকারে বড়, আবার অনেক কিছু আকারে ছোট। কিছু জিনিস মূল্যবান, আবার কিছু জিনিস তুচ্ছজ্ঞান করা হয়। মানুষ সাধারণত বড় বা মূল্যবান জিনিসের প্রতি মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ে এবং ছোট ও নগণ্য জিনিসকে তুচ্ছ মনে করে অবহেলা করে। কিন্তু এ অবহেলা ঠিক নয়, কারণ, অনেক ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বস্তুর মধ্যেও মূল্যবান কিছু লুকিয়ে থাকতে পারে। বাইরের অবয়ব বা আকৃতি দেখে কোনো জিনিসের সঠিক মূল্যায়ন করা যায় না। বাহ্যিকভাবে কেউ কুৎসিত বা কদাকার হলেও সে সুন্দর মন বা হৃদয়ের অধিকারী হতে পারে। সব ঝলমলে পাথর মূল্যবান নয়। মাকাল ফলের বাইরের অংশ যতটা সুন্দর, ভেতরের অংশ ততটাই অসুন্দর। সুতরাং, সঠিকভাবে অনুসন্ধান করলে, অনেক তুচ্ছ ও নগণ্য জিনিসের মাধ্যেও মহামূল্যবান রত্নের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তাই তো কথায় বলে—যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার, অমূল্য রতন।
*রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
*দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]