তুলনাহীন এক নারীর নাম মা

সন্তানের সঙ্গে মা। ছবি: এআই/প্রথম আলো

সময়ে অসময়ে প্রায়ই মায়ের কথা মনে পড়ে। যত দিন মা পাশে ছিলেন, তখন কি এমন করে মায়ের কথা মনে পড়ত? মাকে জড়িয়ে ধরে কখনো বলি নাই, মা আপনাকে ভালোবাসি। আমাদের সময়ে উচ্চারণ করে বাবা-মাকে ভালোবাসার কথা বলার প্রচলন ছিল না। তেমনি তারাও বাক্য বিনিময় করে আমাদের ভালোবাসার কথা বলেন নাই। যুগের পরিবর্তন হয়েছে, এখন আমার ছেলে-মেয়ে তাদের মাকে ও আমাকে আলিঙ্গন করে বলে, আই লাভ ইউ। তাদেরও একই কথা বলতে হয়।

পিতা অন্তঃপ্রাণ মায়ের কাছে শুনেছি, গ্রামে শিশু অবস্থায় তাঁর বিয়ে হয়েছিল। মা শৈশবে গ্রামে প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত পড়েছিলেন। আব্বা মাকে নতুন কয়েনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে মা কয়েনটি মনে রাখার জন্য আঁচলে বেঁধে রাখতেন কিছু দিন। তেমনি করে নতুন বিল নোটটি স্মৃতিতে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। মা গ্রামে ছিলেন শ্বশুরের সংসারে। ষাটের দশকের শেষে গ্রাম ছেড়ে শহরবাসী হন। শহরে আসার পর বাসায় আত্মীয়দের আসা-যাওয়া ছিল অনেক। খালা, মামা, চাচা, ফুপু, খালাতো ভাই, ফুপাতো ভাই সবাই আসতেন নিয়মিত। তাদের সেবার প্রতি ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং তাঁদের জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।

আব্বার ছিল পাটের ব্যবসা। প্রতিদিন খুব ভোরে আব্বা ব্যবসার কাজে চলে যেতেন। মা ভোর রাতে ঘুম থেকে উঠে আব্বার জন্য ভাত রান্না করতেন। স্বাধীনতার পূর্বে তখন ছিল মাটির চুলা। এরপর এসেছে কেরোসিনের চুলা। ঈদের দিন ভোর হবার পূর্বেই (আগের রাতে) মা সব খাবার রান্না করতেন। ঈদের নামাজে যাবার পূর্বেই মা আমাদের খিচুড়ি, পোলাও, মাংস, সেমাই পরিবেশন করতেন। নামাজে যাওয়ার পূর্বে সকালে সবাই খেয়ে বের হতাম। এটাই ছিল রীতি। প্রতি বছর শীত ঋতুতে দিনের বেলায় বড়দা, মেজদা কাহাইল-ছিয়ায় চাল গুঁড়া করে দিলে মা ভাপা পিঠা, কুলই পিঠা, পাটিশাপটা পিঠা বানাতেন। মা সারা রাত জেগে কুলই পিঠা গুড় দিয়ে ঘন দুধে ভেজাতেন। চিতই পিঠা বানিয়ে দুধে ভেজাতেন যখন, সে সময়েও বিনিদ্র রাত ছিল তাঁর একান্ত আপন। ভোররাতে জেগে দেখেছি মাটির মানুষের মতো মা নিঃসঙ্গ বসে আছেন জ্বলন্ত মাটির চুলার পাশে।

রমজান মাসের ভোররাতে মাটির চুলায় ভাত রান্না করতেন। রান্না শেষ হলে আমাদের ডেকে তুলতেন। দুপুরে সবার খাবার শেষে তিনি খেতেন। রাতে কখনোই মা ভাত খেতেন না। স্বামী, সংসার, সন্তানের সেবা, ঈদ উৎসবের রান্না এসবে রাত জাগার ফলে মা হয়তো সঠিকভাবে ঘুমাতে পারেননি। শৈশবে আমার জ্বর হলে রাত জেগে মাথায় পানি ঢেলে দিতেন। আমার সম্পূর্ণ শরীর থাকত মশারির ভেতর। একহাতে বদনার নল দিয়ে ধীরগতিতে মাথায় পানি ঢেলে অপর হাতে আমার সারা মাথায় পানি ছড়িয়ে দিতেন মা। অপর দিকে আবার মশা তাড়াতেন। নিজে মশার অত্যাচার সহ্য করে আমাকে রক্ষা করতেন। সত্তরের দশকে হাম ও লুনতি আক্রমণ করত প্রায় সবার। সে সময়ে মা নিমপাতার ডাল নিয়ে আমার পাশে বসে থাকতেন দিনমান। নানি মাকে বলতেন, রসগোল্লা খেতে দিস। অসুখ সেরে গেলে ফলি মাছ রান্না করে ভাত দিতেন। মেয়ের বিয়েতে হাতে তৈরি রকমারি মজার মজার হরেক রকমের পিঠা ও বিভিন্ন রকমের হালুয়া বানিয়ে বিয়ের দিন বরকে উদ্দেশ্য করে পরিবেশন করা হতো তখন। এই উপস্থাপনটির নাম সাগরানা (সাগর+আনা)। বিক্রমপুরের এই ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তপ্রায়। আপার বিয়েতে দেখেছি মা সাগরানা বানিয়েছিলেন।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মা খুব সুন্দর মাটির চুলা বানাতে পারেতেন। অনেকেই মার কাছ থেকে চুলা নিয়ে যেতো। কাঁথা বানানোর জন্য মা তাঁর পুরাতন শাড়ি ব্যবহার করতেন। মায়ের সঙ্গে কাঁথা সেলাই করেছি। গুঁড়া হলুদ পানিতে গুলে সুতা রঙ করে কাঁথায় দাগ দিতেন। হলুদ রঙে ভেজা সুতার অপর প্রান্ত আমাকে দিয়ে বলতেন, সুতাটা আমার সঙ্গে ধর। শাড়ির পাড় থেকে সুতা তুলে কাঁথা সেলাই করতেন। সুঁচ দিয়ে বলতেন, সুতাটা ঢুকিয়ে দে। মা পান খেতেন সব সময়। স্বর্ণালংকার ব্যবহার করলেও কাজল, আলতা, লিপস্টিক, নেলপলিশ ব্যবহার করেননি কখনো। দুই চোখে সুরমা নিতেন। সুর তুলে পুঁথি পাঠ ছিল তাঁর সখ। দুই ঈদের পূর্বেই অ্যালুমিনিয়ামের বড় হাঁড়ি-পাতিলে মাটির প্রলেপ দিয়ে শুকিয়ে নিতেন। মাটির চুলার আগুনে রান্নার পর পাতিল ধুয়ে পরিষ্কারর করার পর রোদে শুকালে দেখা যেতো পাতিলগুলো আগের মতোই ঝকঝকে ও চকচকে। মায়ের কাছে শিখেছি কীভাবে গাছের বীজ রোপণ করে গাছের পরিচর্যা করতে হয়।

সংসারে বিরামহীন, নিরলস সেবাদানকারী মাকে সময় হঠাৎ একদিন চিরস্থায়ী অবসরের ব্যবস্থা করে দেয়। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হবার পর লাঠি হাতে এক পা টেনে হাঁটতেন মা। রান্না ঘরের দরজার কাছে চেয়ারে বসে ভাবির রান্না দেখেন। বিছানায় বসে নামাজ পড়েন। আমি অসুস্থ হলে নিজের বেডরুম থেকে লাঠি হাতে পা টেনে শব্দ করে হেঁটে দেখতে আসতেন আমাকে। আমি আজও অসুস্থ হলে শুনি মায়ের পা টেনে হেঁটে আসার শব্দ। জ্বর হলেও দেখি মা মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছেন। উপর্যুপরি স্ট্রোকে মা কোমায় ছিলেন দীর্ঘদিন। রাইস টিউবের মাধ্যমে খাবার ও ঔষধ দিতেন আব্বা। নাক দিয়ে রাইস টিউব দেয়াটা ছিল এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। প্রায় দেড় যুগ অসুখে ভুগে এক মধ্যরাতে নীরবে নিশ্চুপে অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন মা। নিরলস ক্লান্তিহীন সেবাদানকারী স্বামীকে চিরতরে দিয়ে গেলেন মুক্তি। মাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অজস্র গান, কবিতা। কোনো কিছু দিয়ে মায়ের কোনো তুলনা হয় না। তুলনাহীন এক নারীর নাম মা। প্রতিদিন হোক মা দিবস।