কেউ বলে না, আমি মানুষ হতে চাই

নহাটাবাসী হতে চাও? মাগুরাবাসী হতে চাও? বাংলাদেশি হতে চাও? বিশ্ববাসী হতে চাও? নাকি সবকিছুর সমন্বয়ে মানুষের মতো মানুষ হতে চাও? নাকি যেমন আছ, তেমন থাকতে চাও? এই চাওয়াটাও কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। শিশু জানে না তার ভালো-মন্দ, তাই তো শুরু থেকে মা–বাবা এই বিশেষ গুরুদায়িত্বটি পালন করেন ভালোবাসার বন্ধনে।

মা–বাবা পাওয়া আমাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, এটা জন্মগত পাওয়া। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে। কারণ, এখানে আমরা প্রভাব বিস্তার করতে পারি।

একইভাবে জন্মগ্রহণ করা আমাদের ক্ষমতার বাইরে, যার ফলে আমরা ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি জন্মগ্রহণ করতে পারি না। তবে জন্মের পরের সময়কে পরিবর্তন করার ক্ষমতা কিন্তু আমাদের হাতে।

এটা পরিবর্তন করার জন্য আমাদের সার্বিকভাবে চেষ্টা করা দরকার এবং তা পেতে হলে স্মার্ট হতে হবে জীবনের শুরু থেকে। আমি এর আগে লিখেছি, বিশ্ব নাগরিক হতে হলে কী কী দরকার। তার আগে ভাবতে হবে, ব্যক্তির চিন্তাধারা কী? আদৌ কি আমি বিশ্ব নাগরিক হতে চাই? নাকি মা–বাবা চান, তাই আমি এটা করছি! জীবনের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে আমাদের সিদ্ধান্তে আসতে হবে, ব্যক্তিগতভাবে আমি কী চাই।

যখনই এই সিদ্ধান্ত পরিষ্কার হয়ে যাবে, তখন কীভাবে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, সেটাই হবে প্রশ্ন। কিছুটা ফিল্ড স্টাডি করতে হবে। কী সুযোগ-সুবিধা বা বাধাবিঘ্ন আছে, তা জানতে হবে।

ক.

এখন যদি আমার গোলস অ্যান্ড অবজেক্টিভস হয় যে বিদেশে পড়তে যেতে চাই, তাহলে শুরু থেকে মাইন্ডসেট করতে হবে যে আমি প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে যাব।

খ.

কেন দেশের লেখাপড়া বাদ দিয়ে বা প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করে হঠাৎ বিদেশে পড়াশোনা করার প্রবণতা এল? দেশে কি সেই শিক্ষার অভাব, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই যে বাইরে গিয়ে তা অর্জন করতে হবে? নাকি মা–বাবার আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং একধরনের ফ্যাশন, তাই বাইরে পড়তে হবে? এখন ক এবং খ—দুটি ভিন্ন ধরনের গোলস অ্যান্ড অবজেক্টিভস। ক গ্রুপের শিক্ষার্থীরা সব সময় কোনো না কোনোভাবে জীবনের সঠিক পথ খুঁজে বের করে সফল হয়ে থাকে, যা খ গ্রুপের ক্ষেত্রে তেমনটি নজরে পড়ে না।

আজ বর্ণনা করব ইউরোপে পড়াশোনা করার জন্য কী কী প্রয়োজন এবং কখন বা কোন লেভেলে পড়াশোনা করার জন্য কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

বাংলাদেশ থেকে সুইডেনে পড়াশোনা করতে হলে TOEFL বা IELTS করতে হবে।

প্রতি মাসে কী পরিমাণ সুইডিস ক্রোনার (১ ক্রোনা=বাংলা ১০ টাকা) দেখাতে হবে, Swedish migration Agency’s Website–এ গেলে সব বিষয়ে জানা যাবে এবং গুগলের মাধ্যমে বেশির ভাগ তথ্য জানার ব্যবস্থা রয়েছে।

সাধারণত বিদেশি শিক্ষার্থীরা যখন গেস্ট স্টুডেন্ট হিসেবে সুইডেনে আসে, প্রাথমিক পর্যায়ে তারা সুইডিস হোস্ট ফ্যামেলি পেয়ে থাকে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ই ব্যবস্থা করে।

সুইডিস হোস্ট ফ্যামিলির সমন্বয়ে এদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার যথেষ্ট সুযোগ হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা খুবই সুন্দর এবং সুইডিস ছাত্রছাত্রীরা সব সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে থাকে।

সুইডেন ছাড়াও ইউরোপের অনেক দেশে ওয়ার্ক পারমিটের সুযোগ রয়েছে, যার কারণে কাজ খুঁজে পেলে পড়াশোনা বা থাকা-খাওয়ার খরচ জোগাড় করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে লেখাপড়া ম্যানেজ করা সম্ভব। যারা সত্যিকারে মোটিভেটেড, তাদের পক্ষে এটা সম্ভব।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ইউরোপে আসার পরও আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেলে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ লাভ করতে পারছে না। বিধায় তাঁরা কর্মের সমন্বয়ে কোনোরকম লেখাপড়া করে বিদেশে সেটেল হবার চেষ্টায় কঠিন পরিশ্রম করে চলেছে এবং কোনো না কোনোভাবে তারা ম্যানেজ করছে। আন্ডার গ্র্যাজুয়েট লেভেলে যারা পড়াশোনা করতে এসেছে, তাদের মধ্যে খুব কম শিক্ষার্থীই বলতে হবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হতে পেরেছে। বাংলাদেশ থেকে মাস্টার্স শেষ করে যাঁরা স্কলারশিপ বা বৃত্তি পেয়ে বিদেশে পড়াশোনার জন্য এসেছে, তাদের বেশির ভাগই প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরেছে বা এখানে থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্ম নিয়ে। কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে, তা হলো যদি কারও আত্মীয় বা ভালো গার্ডিয়ান থাকে বিদেশে এবং তারা যদি স্পন্সর করে সঙ্গে গাইড দিতে পারে শতভাগ, তখন আন্ডার গ্র্যাজুয়েটেও পড়া সম্ভব।

এ ছাড়াও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ পাওয়া যেতে পারে। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। আমার লেখাতে আমি নির্দিষ্টভাবে ইউরোপের শিক্ষার নিয়মকানুনগুলোই তুলে ধরেছি। এখানে আমেরিকা বা কানাডার বিষয় কিছু উল্লেখ করিনি, যা হয়তো পরের লেখাতে জানাব।

বাংলাদেশ থেকে সাত সাগর আর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে যদি কেউ সত্যিকারে স্বপ্ন দেখে থাকে যে সুশিক্ষার জন্য বিদেশে গিয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে, তবে সে স্বপ্ন যেন সে জাগ্রত অবস্থায় দেখে, তাহলে তা বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হবে। মাতৃভূমি ছেড়ে অন্য দেশেই যখন থাকব, তা যদি মাতৃভূমির চেয়ে ভালো না হয়, তাহলে মাতৃভূমি ছাড়া ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ, বিদেশে ভালো থাকতে না পারলে দেশের কথা ভাবা বা দেশের জন্য ভালো কিছু করা সম্ভব হবে না। শুধু মনকে বোঝানো যাবে যে কারও ক্ষতি না করে বিদেশে এসে পাড়ি জমানো হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য।

আগের তুলনায় বর্তমানে বিশ্বায়নের অর্থনীতিতে অনেক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, সাহসী নেতৃত্ব ও কৌশলে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলছে। কিন্তু নারী নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি, বিভিন্ন অজুহাতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বা সরকারের সার্বিক উন্নয়ন প্রশ্নবোধক চিহ্নের সামনে আজ দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষমতাসীন এ সরকার একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সপরিবার জাতির পিতাসহ জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, বাংলাদেশের নাগরিক হিন্দু ও আদিবাসীদের ওপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে এই সরকার পারবে।

বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে কাজটি জটিল ও কঠিন হলেও তা করতে হবে। একটি মানবিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। গর্হিত সব অপরাধের বিচার হবে—এমন সংস্কৃতি, বিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে জাতিধর্ম–নির্বিশেষে সব নাগরিকের মনে। প্রত্যয়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সব নাগরিক নিরাপদ বোধ করবে। যদি কেউ এসব বিষয় ঝামেলা বলে মনে করে এবং জন্মভূমি ছাড়তে চায়, তাহলে ঠিক হবে না। যা–ই কিছু করি না কেন, যেখানেই থাকি না কেন, মনে রাখতে হবে, জীবনের মূল্য কী এবং আমার কন্ট্রিবিউশন সমাজের জন্য কী? যেখানেই শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ হোক না কেন, তা যেন সুশিক্ষা হয়।

সেই সুশিক্ষা যেন মনের দারিদ্র্য ও কলুষতা দূর করে। এই সচেতনতা যদি থাকে, তবেই হবে পৃথিবীতে জন্মের এবং বেঁচে থাকার সার্থকতা। সব সময় মনে রাখতে হবে, ‘মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’।

লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন