শুক্লপক্ষের মৎস্যশিকারি

গালফ অব মেক্সিকোয় সূর্যোদয়। ধরা পড়া একটি ফ্লাউন্ডার মাছছবি: লেখক

উত্তরীয় বাতাসে তখনো শেওলাভেজা জলজ লবণ জড়ানো গন্ধ। মেঘের ডানায় ভেসে বেড়ানো শুল্কপক্ষের চাঁদ এলোমেলো বাতায়নে চারদিক ছড়িয়ে দিতে থাকে সূর্যের কাছ থেকে ধার করে আনা আলোকচ্ছটা। সেই আলোয় ম্রিয়মাণ ভাটার স্রোত ক্লান্ত ভঙ্গিতে এসে আস্তে আস্তে করে চুমু দিতে থাকে পাথুরে খাঁড়ির শেষ প্রান্তে জমে থাকা কিছু ভেসে আসা গাছের গুঁড়ি, সামুদ্রিক ঘাসের দঙ্গল, ন্যাড়া কিছু বেলে পাথর, আর বনকলমির ঝাউবনে।

চারদিক নীরব, জনশূন্য, অনেকটা নিষ্প্রাণ, কিন্তু নিঃশব্দ নয়। উত্তরীয় বাতাসের মৃদু আন্দোলন, সঙ্গে পূর্বমুখী মরাকটালের মৃদু নিষ্প্রাণ অনুরণন, আর একটা মানুষ।

ওই যে সেই বৃদ্ধ লোকটি, যে মাছ ধরে বেড়ায়, বনজঙ্গল, এঁদো জলা, পাথুরে খাঁড়ি, সমুদ্রের বালিয়াড়ি, কিংবা লবণাক্ত ঘাটে। ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, তীব্র দাবদাহ, কিংবা হাড় হিম করা শীত, কোনোটাই তোয়াক্কা না করা মানুষটা। কী এক পাগল জলের নেশায় কুহকিনীর ডাকে উন্মাদের মতো ছুটে বেড়ায় এ ঘাট থেকে ও প্রান্তে, মাছ ধরার আশায়।

কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নেওয়া একটা আধপোড়া লাঠির খোঁচায় উসকে দিতে থাকে পাশে পড়ে থাকা আগুন। এখন ভর গ্রীষ্মকাল। বাতাসে ঠান্ডার ছিটেফোঁটাও নেই। উপরন্তু এরই মধ্যে রাত্রির বাতাসে সামুদ্রিক আর্দ্রতা যেন ঘামিয়ে ওঠা উষ্ণতার পরশ বুলিয়ে দেয়। এরপরও এই আগুন আর আপাদমস্তক বহিরাবরণ দিয়ে বৃদ্ধ লোকটির নিজেকে ঢেকে রাখার একটাই কারণ—মশা। পুরো মহিষের সমান একেকটা মশা কামড়ে যেন উড়িয়ে নিতে চায়। আর আছে শতসহস্র জাব পোকা আর ঘোড়া মাছি। কেউ কারও চেয়ে কম যায় না এখানে।

পারশে মাছের পোনা। বড় মাছ ধরার জন্য বেইট
ছবি: লেখক

এত কিছু সহ্য করে এই লোকটার মাত্র একটাই লক্ষ্য—একটা মাছ। বিশাল সাইজের একটা মাছ, একটা মূর্তমান জলদানব।

এই পাথুরে খাঁড়ির কোল বেয়ে চলে যাওয়া, বয়ে যাওয়া ডুব স্রোত বিশাল বিশাল মাছের আনাগোনার রাস্তা। অন্য সব শিকারি প্রাণীর মতো এই বড় মাছগুলোও বের হয়ে আসে এই গভীর রাতে, অনাহূত অপ্রস্তুত কোনো শিকারের আশায়। মাথায় লাগানো তীব্র ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে দিলে ক্ষণিকের মতো জ্বলে উঠে তাদের শ্বাপদ চোখ। নিমেষেই হারিয়ে যায় গভীর উপসাগরের অতলে।

এরা ভয়ানক চতুর। বিবর্তনবাদের প্রাকৃতিক নির্বাচনে তাদের সহোদরদের উতরে গিয়ে বছরের পর বছর হাঙর-শুশুকের হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে আজ তারা দানব। এত সহজেই তাদের কুপোকাত করা সম্ভব নয়। তাদের নাস্তানাবুদ করতে চাই অনভিপ্রেত কৌশল, নিখুঁত সময়জ্ঞান, আর অসীম ধৈর্য।

ফেয়ার হোপের একটি সূর্যোদয়
ছবি: লেখক

পাশে রাখা বালতিতে হঠাৎ একটা আন্দোলনের শব্দে ঝিমুনি ভেঙে তাকিয়ে ওঠে লোকটি। ঘণ্টাখানেক আগেই ধরে আনা পারশে মাছের পোনাগুলো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বালতিময়। এদের একটা কিছুক্ষণ আগে বড়শিতে গেঁথে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে উপসাগরের জলে, জলদানবের খোঁজে।

বৃদ্ধ লোকটি সামনে তাকিয়ে বড়শি পরখ করে নেয়। মৃদু একটা আন্দোলন দিয়ে ওঠে বড়শি। কিছু কি ধরেছে! জরাজীর্ণ হাতে বড়শি টেনে নিয়ে হালকা করে সুতো গুটাতে থাকে লোকটি। একটু বিরতি দিয়ে অনুভব করতে থাকে সুতোর ওপর মাথায় টান। কিছু একটা ধরেছে। ছোট জাতীয় কিছু। হালকা করে টান দিয়ে মাছের মুখে বড়শি গেঁথে টেনে আনতে থাকে রিল হাতলের ঘূর্ণনে। একটা ক্যাট ফিশ।

ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে লোকটা। আজও কি হবে না!

বুল রেড দানব—রেড ড্রাম মাছ
ছবি: লেখক

চিন্তা করতে করতেই পাশে পড়ে থাকা বহু ব্যবহারে জীর্ণ ট্যাকল ব্যাগ টেনে নেয় নিজের কাছে। হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে নিতে থাকে ফিশিং প্লায়ার্সটা। এই ক্যাট ফিশ খুব ঝামেলার, একটু অসাবধানতায় হাতের তেলোয় ফুটিয়ে দিতে পারে তার উল্টোমুখী বিষকাঁটা। প্রচণ্ড ব্যথা আর বিষের প্রভাবে ফুলে ওঠা হাত নিয়ে তখন ঝামেলায় পড়তে হয় দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। কাঁটা ভেঙে ভেতরে রয়ে গেলে তো আরেক আপদ।

মাথার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বেলে অনেক সন্তর্পণে প্লায়ার্সটা দিয়ে লোকটা আস্তে আস্তে ছাড়াতে থাকে বড়শি। তার ফ্ল্যাশ লাইটের আলোক কোণের বাইরে লোকটার অজান্তেই তখন ঘটে যাচ্ছে অভাবনীয় ঘটনা। দ্বিতীয় বড়শি যেটাতে একটা মরা পারশে মাছের পোনা দেওয়া ছিল, মাছ ধরার কোনো আশাই যেখানে ছিল না, সেই বড়শিটা হালকা নড়ে ওঠে। কিছুক্ষণ নড়ে নড়ে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে যায়। সেই স্থির হয়ে যাওয়া সাময়িক। এরপর বড়শিটা আস্তে আস্তে বাঁকতে শুরু করে। হালকা এদিক-ওদিক নড়তে থাকে খুব স্বাভাবিকভাবে। এরপর সুতো টান টান হতেই ভয়ংকর জোরে বেঁকে ধনুকের মতো হয়ে যায় বড়শি। আর সঙ্গে করে রিলের কড়কড় শব্দে মাছের সুতো টেনে নেওয়ার শব্দ। এতক্ষণে সেই দানব বুঝতে পারে যে সে কোনো কিছুতে আটকে গিয়েছে। প্রাণপণে তাই ছুটে যেতে চাইছে উপসাগরের অতল অতলান্তে।

মবিল উপসাগরের ওপর শুক্লপক্ষের চাঁদ
ছবি: লেখক

শেষ মুহূর্তে মাথা নুইয়ে গিয়ে পাথর ছুঁই ছুঁই হওয়ার আগেই বৃদ্ধ লোকটি ধরে ফেলে বড়শি। হাতে নিতেই তার চোখ চক চক করে ওঠে আনন্দে। বেঁধেছে বেঁধেছে, শেষমেশ বেঁধেছে এই জলদানব। বড়শির সুতো টেনে নেওয়ার কড় কড় শব্দে পাথুরে বালিয়াড়ির সমস্ত নৈঃশব্দ্য যেন ভেঙে খান খান হয়ে যায় মুহূর্তে। আর তার সঙ্গে মিলেমিশে যেতে থাকে বৃদ্ধের অন্তর খোলা হা হা হাসি।

লেখক: মইনুর রহমান, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার ৩, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট, সিটি অব মবিল-গভর্নমেন্ট, মবিল, আলাবামা, যুক্তরাষ্ট্র

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]