মানবতা বনাম মহাবিশ্ব: নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা এবং নৈতিক ভারসাম্যের অনুসন্ধান
চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্র প্রতিদিন তারা তাদের নির্ধারিত পথে চলে, কেউ তাদের বলে দেয় না কখন উঠতে হবে বা কখন ডুবতে হবে। তারা শৃঙ্খলার নিখুঁত প্রতীক, কারণ তারা প্রকৃতির নিয়মের প্রতি অনুগত। অথচ মানুষ, যার হাতে চিন্তার স্বাধীনতা ও প্রযুক্তির ক্ষমতা, সে নিজের পৃথিবীকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না, কেন?
কারণ, প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত হয় নিয়মে, আর মানুষ চালিত হয় অহং ও ইচ্ছায়। মানুষকে দেওয়া হয়েছে যুক্তি ও স্বাধীনতা, কিন্তু সেই স্বাধীনতা আজ পরিণত হয়েছে বিশৃঙ্খলায়। যে শক্তি আমাদের সৃষ্টি করেছে, সেই শক্তির নিয়ম থেকে দূরে সরে গিয়ে মানুষ এখন প্রকৃতিকে, সমাজকে, এমনকি নিজেকেও জয় করতে চায়, ফলত হারাচ্ছে ভারসাম্য আর তিলে তিলে ক্ষত করছে নিজেকে।
ধর্মীয় গ্রন্থগুলো একসময় এসেছিল মানুষকে এই ভারসাম্যে ফিরিয়ে আনার জন্য। তাদের মূল বার্তা ছিল সহজ, ন্যায়, প্রেম, করুণা ও সংযম। কিন্তু মানুষ ধর্মকেও ব্যবহার করেছে প্রভাবের হাতিয়ার হিসেবে। ফলে আচার টিকে গেছে, কিন্তু আত্মা হারিয়ে গেছে। মানুষ এখন ধর্ম মানে, কিন্তু তার মর্ম বোঝে না, প্রার্থনা করে, কিন্তু প্রতিবেশীর কষ্টে নীরব থাকে।
আমরা ভুলে গেছি, চিন্তা ও বাক্স্বাধীনতা শুধু একটি অধিকার নয়, এটি একটি গভীর দায়িত্ব। যখন আমরা সত্য উচ্চারণের সাহস হারাই, তখন অন্যায় শক্তিশালী হয়, আর যখন আমরা প্রশ্ন করতে ভুলে যাই, তখন অন্ধ আনুগত্য আমাদের গ্রাস করে।
তবু প্রশ্ন থেকে যায়,
ন্যায় ও অন্যায়ের ভারসাম্য কীভাবে ফিরবে, যেখানে ধনীর হাতে ধন ও ক্ষমতা জমে আছে?
গরিবের জন্মের সার্থকতা কী, যদি তার কণ্ঠ শুনতে কেউ প্রস্তুত না থাকে?
কেন দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে, অথচ মানবতার সংখ্যা কমছে?
এখানেই মতদ্বিমত।
একদল মানুষ বলে, এটাই প্রকৃতির নিয়ম, সব সময় ধনীরা শাসন করবে।
অন্যদল বলে, মানবজাতি তখনই সভ্য, যখন দুর্বলরাও নিরাপদ।
প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি টিকিয়ে রাখে ক্ষমতার স্থায়িত্ব, দ্বিতীয়টি টিকিয়ে রাখে মানবতার ভবিষ্যৎ।
আজ পৃথিবী প্রযুক্তিতে উন্নত, কিন্তু নৈতিকতায় দরিদ্র।
দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমরা জানি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে তৈরি করতে হয়, কিন্তু ভুলে গেছি মানবিক বুদ্ধিমত্তা কীভাবে রক্ষা করতে হয়।
চাঁদে মানুষ পৌঁছেছে, কিন্তু প্রতিবেশীর ঘরে আলো পৌঁছায়নি।
অতএব, সমাধান কোনো যুদ্ধ বা বিপ্লবে নয়, বরং এক সচেতন নৈতিক পুনর্জাগরণে নিহিত। প্রতিটি চিন্তাশীল মানুষের দায়িত্ব হলো নিজের স্বাধীনতাকে সত্য, ন্যায় এবং করুণার সেবায় নিয়োজিত করা, বাহ্যিক ক্ষমতার প্রাচীর গড়ার জন্য নয়।
বিশ্বের ধনী দেশগুলো, ক্ষমতাধারী ব্যক্তি এবং করপোরেট নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা,
যদি কাগজে–কলমে হলেও আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে থাকি, তাহলে ইলন মাস্কের মতো একজনের ভোটের মতো, আমারও একটি ভোট।
এখন ভাবুন, যদি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর লন্ডন বা নিউইয়র্কের মতো শহরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও জোহরান মামদানির মতো নেতৃত্বকে হারানো সম্ভব না হয়, তাহলে অর্থ দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার ফল কী হবে?
এখন বিশ্বের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনি চাইছেন যুদ্ধ, নাকি শান্তি?
স্রষ্টার নিয়মে মানুষের পুনর্জন্ম
অবশেষে মনে রাখতে হবে, এই বিশাল মহাবিশ্বের প্রতিটি কণিকা স্রষ্টার অলৌকিক শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ ও নক্ষত্র যেমন তাঁর ইচ্ছায় নির্দিষ্ট পথে চলে, তেমনি মানুষও তাঁরই সৃষ্টি শ্রেষ্ঠ জীব, যার মধ্যে তিনি জ্ঞান, বোধ ও বিবেকের শক্তি স্থাপন করেছেন।
আল্লাহ পাক আমাদের মধ্যে একটি অন্তর্নিহিত সেন্স দিয়েছেন, যাকে আমরা বিবেক বলি। তিনি নিজেই সেই সেন্সের মাধ্যমে আমাদের প্রতিটি চিন্তা, কাজ ও উদ্দেশ্য পর্যবেক্ষণ করেন। এ কারণেই পরকালের বিচার সম্পর্কে আমাদের ধর্মীয় চেতনা এত গভীরভাবে প্রোথিত।
কিন্তু যখন দেখা যাচ্ছে মানবজাতি সেই নৈতিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে, তখন প্রশ্ন জাগে, আমরা কি সেই ঐশ্বরিক পর্যবেক্ষণবোধের কোনো প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে পারি না? যদি আমরা প্রযুক্তিকে সেই পথে কাজে লাগাতে পারি, যেমন জ্বর মাপার থার্মোমিটারের মতো নির্ভুলভাবে মানুষের কাজ ও ভাবনাকে শনাক্ত করার একটি মনিটরিং সিস্টেম তৈরি করা যায়, তাহলে মানবসমাজের নৈতিক দিকনির্দেশনা ভেতর থেকেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।
আমার ভাবনায় এসেছে, ড্রোন টেকনোলজিকে আরও উন্নত ও সংবেদনশীল করে তোলা যেতে পারে, যাতে এটি প্রতিটি মানুষের জীবনের কার্যক্রম, চিন্তা ও আচরণের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে একধরনের নৈতিক সেন্সর হিসেবে কাজ করে। হতে পারে, তা শরীরের স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্কের সেন্স অব সেন্সরের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণব্যবস্থা, যা সৎ ও অসৎ কর্মের তথ্য আর্কাইভ করে রাখবে। এর লক্ষ্য হবে শাস্তি দেওয়া নয়, বরং মানুষকে তার বিবেকের সামনে দাঁড় করানো, যাতে সে নিজেই নিজের ভেতরের ভুলকে চিনে নিতে পারে।
কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহলে কি মানুষের বাক্স্বাধীনতা হরণ হবে? গোপনীয়তা নষ্ট হবে?
আমার উত্তর সরল: আল্লাহ পাক তো আমাদের প্রতিটি চিন্তা ও কর্ম সম্পর্কে অবগতই আছেন। তিনি মনিটরিং করছেন আমাদের অন্তর থেকেই। তাহলে আমরা যদি তাঁরই প্রদত্ত জ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্যায়, দুর্নীতি ও মিথ্যাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করি, তাতে ক্ষতি কোথায়? যদি আমরা অন্যায় না করি, তবে আমাদের ভয় কিসের? গোপনীয়তা বা স্বাধীনতা তো কেবল অন্যায়ের ভয়ে লুকিয়ে থাকে, সত্যের ভয়ে নয়।
অতএব প্রযুক্তি যখন সৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন তা আল্লাহর প্রদত্ত জ্ঞান ও ন্যায়েরই সম্প্রসারণ। যদি এই পথেই আমরা আমাদের অন্তরের নৈতিক সেন্সরকে জাগ্রত করতে পারি, তাহলে পৃথিবী ধীরে ধীরে সেই ন্যায়ের সমাজে রূপ নেবে, যেখানে থাকবে না অন্যায়, থাকবে কেবল শান্তি, প্রজ্ঞা ও সত্যের দীপ্তি। ইনশা আল্লাহ।
লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক, সুইডেন।