কার্ল মার্ক্সের বাড়িতে একদিন

ছবি: লেখক

পুরো নাম কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (৫ মে ১৮১৮–১৪ মার্চ ১৮৮৩)। জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবীসহ কত বিশেষণেই চিনি ও জানি তাঁকে। যাঁর সমাজতন্ত্রিক দার্শনিক মতবাদ পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে—সমগ্র পৃথিবীতে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে একটি আওয়াজ, একটি মুক্তির বিপ্লব। যাঁর দর্শনে পৃথিবীর সব শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি মেলে। গত বছরের ২৯ জুন একনজরে দেখে আসি মহান বিপ্লবী ও সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা মার্ক্সের জন্মস্থান টিয়ার শহরের বাড়ি।

ছবি: সংগৃহীত

বাড়িটি বর্তমানে একটি জাদুঘর। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ১৯৭ কিলোমিটার দূরে অনন্যসুন্দর শহর টিয়ার। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে কোবলেন্জ হয়ে যেতে হয় টিয়ারে। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে টিয়ারে যাওয়ার পথ খুবই সুন্দর। ট্রেন চলছে ঘণ্টায় ৯৬ কিলোমিটার বেগে, অসম্ভব সুন্দর নদী, স্বচ্ছ জল, নদীর দুই পাড়ে উঁচু উঁচু পাহাড় আর পাহাড়ের ঢালে আঙুরের বাগান। আর পাহাড়ের পাদদেশে সড়ক আর রেললাইন।

ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে কোবলেন্জে কিছুক্ষণ যাত্রাবিরতির পর প্রায় তিন ঘণ্টা পর পা রাখলাম পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী মানুষের তীর্থস্থান টিয়ার শহরে। টিয়ার রেলস্টেশন থেকে ৮২ বা ৮৩ নম্বর বাসে মাত্র ৫টি স্টেশন পর কার্ল মার্ক্সের বাড়ি। বেলা ১১টায় পৌঁছেছিলাম মার্ক্সের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকতেই দেখলাম, হাতের বাঁ পাশে টিকিট কাউন্টার আর স্যুভেনির রুম।

সাড়ে তিন ইউরোর টিকিট নিয়ে প্রবেশ করলাম বিপ্লবীর বাড়িতে। বাড়িতে মধ্যখানে রয়েছে ফুলের গোল বাগান। বাড়ির নিচতলা আর ওপরের তলায় প্রতিটি কক্ষে সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মার্ক্সের বিপ্লবী জীবনের ইতিহাস আর সৃষ্টিকর্ম। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই প্রথমে কিছু ঐতিহাসিক প্রদর্শনীতে চোখ পড়ল। প্রদর্শনীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের সাম্যবাদের ইতিহাস বিষয়ে কিছু ছবি সংবলিত টীকা লেখা রয়েছে। যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে কার্ল মার্ক্সের ছাত্রজীবনের ও লন্ডনে নির্বাসিত জীবনের কিছু ছবি।

ছবি: সংগৃহীত

চে গুয়েভারার কিছু বিপ্লবী ছবিও এই কক্ষে সংরক্ষিত রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় এর পরের রুমে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে তাঁর পড়ার চেয়ার ও ব্যবহারিক কিছু জিনিস। আর রুমের দেয়ালে রয়েছে সাংবাদিক, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী হিসেবে কার্ল মার্ক্সের অবদানের কিছু ছবিসহ টীকা। সেই সঙ্গে আরও চোখে পড়ল ১৯৬৬ সালে সংঘটিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের (Cultural Revolution) কিছু দুর্লভ ছবি, আমেরিকা-ভিয়েতনাম যুদ্ধের (১৯৬৮) কিছু দুর্লভ ডকুমেন্টারি এবং ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ বিপ্লবের কিছু নথি। করিডর বেয়ে বাড়ির অপর পাশে গেলাম। সেখান সংরক্ষিত রয়েছে সমাজতন্ত্রের বাইবেল ‘ডাস ক্যাপিটাল’ (Das Capital)–এর প্রথম সংস্করণ এবং কার্ল মার্ক্সের লেখা কিছু পাণ্ডুলিপি।

ডাস কাপিটাল হলো তাঁর লেখা পুঁজিবাদের সমালোচনামূলক একটি বই। সমাজ প্রগতির সঙ্গে অর্থনীতির জটিল সম্পর্ক মার্ক্সবাদের প্রধান ও মূল বিষয় বইটিতে তুলে ধরা হয়েছে। সামাজিক ইতিহাসের ব্যাখ্যায় মার্কসের এ বইতে দেখানো হয়েছে যে কোন ঐতিহাসিক যুগ সমকালীন পণ্য উৎপাদনব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এতে মার্ক্স জোর দিয়েছেন উৎপাদন সম্পর্কের ওপর। যার অর্থ, উৎপাদনব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে সামাজিক মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যে সম্পর্ক গড়ে তোলে, তার ওপর।

বিনিময়, উৎপাদন, মূল্য, শ্রম, শ্রমের সামর্থ্য বা ক্ষমতা, শ্রম বিভাগ, বিযুক্তি, সম্পত্তি, মুনাফা প্রতিটি ধারণাকেই মার্কস উপস্থিত করেছেন, এ বিষয়ে অর্থনীতির প্রবক্তাদের এবং প্রতিটি বিষয়ের ওপর নিজস্ব মতবাদ উপস্থিত করে প্রচলিত মতকে তিনি খণ্ডন করেছেন। ‘ডাস ক্যাপিটাল’ বইয়ের পাশেই রয়েছে একটি ডিজিটাল জীবনবৃত্তান্তমূলক অডিও-ভিডিও অ্যানিমেশন বই।

মজার বিষয় হলো, বইটি স্পর্শ করলে অটোমেটিক কার্ল মার্ক্সের জীবনী জার্মান ভাষায় অডিও-ভিডিওসহ চলতে থাকে। এক পৃষ্ঠার পর অপর পৃষ্ঠা খুললেই যথাক্রমে বইটির অডিও-ভিডিও চলতে থাকে, যেখানে কার্ল মার্ক্সের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর বিপ্লবী জীবন সম্পর্কে একটি বিস্তারিত ধারণা দেওয়া হয়েছে। এর পরে নিচে নামতেই চোখে পড়ল মার্কসের একটি আবক্ষ মূর্তি, যা তাঁর প্রপৌত্র দ্বারা করা হয়েছিল। মিউজিয়ামে চার ঘণ্টা অতিবাহিত করে ছুটে চললাম লুক্সেমবার্গে।

আমরা পাঠ্যবইয়ের পাতায় যে মার্ক্সিজমের কিছুটা ধারণা পেয়েছি, তার পূর্ণ ধারণা পেতে প্রবেশ করা দরকার কার্ল মার্ক্সের এই বাড়িতে। বাড়িটিকে বলা হয়ে থাকে ‘রাইটার হাউস জাদুঘর’।

**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারেন [email protected]