বাংলায় লিখেছেন সমরেশ তবে তিনি ভারত রাষ্ট্রের নাগরিক

মেলবোর্ন বিমানবন্দরে লেখক সমরেশ মজুমদার
ছবি: মনজুর মোরশেদ চৌধুরী

আত্মপরিচয় নিয়ে বর্তমান সময়ে মানুষ কিছুটা উদ্বিগ্ন। এই বিশ্বায়নের যুগে এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি? বিশ্বায়নের যুগে মানুষের ভেতর সৌহার্দ্য, সহযোগিতা, সহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা বাড়াটাই ছিল আদর্শিক। বাস্তব তুলে ধরে উল্টো চিত্র। অসহিষ্ণুতার বাড়াবাড়ি, অসম্ভব ঘৃণার ছড়াছড়ি। এহেন বৈরী পরিবেশে মানুষ বিপন্ন। তাই নিজের টিকে থাকার স্বার্থেই, আপন অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার জন্যই মানুষ আত্মপরিচয় খুঁজে ফেরে ও নানাভাবে তা তুলে ধরে।

টুপি (টুপিরও নানা নকশা ও মাপ রয়েছে), টিকি, লম্বা চুল–দাড়ি ইত্যাদি মানুষের অন্তরে লালিত বিশ্বাস ও আচার–ব্যবহারে চর্চিত অভ্যাসের কথা বলে। এতে ঠিক আত্মপরিচয়টা সঠিকভাবে বিবৃত হয় না বটে। উদাহরণ দিলে বিষয়টা বুঝতে সুবিধা হবে।

ঘটনাক্রমে এক সেমিনারে দুই ব্যক্তির সঙ্গে দেখা। একই ধরনের টুপি পরা, যাকে বলা হয় ইয়ামাকা, যা ইহুদিদের পরতে দেখা যায়। এটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো থাকে। ফর্সা, দীর্ঘদেহী, অত্যন্ত ভদ্র, শিক্ষিত দুই ব্যক্তি। একজন হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘আই অ্যাম কার্ল গোল্ডবার্গ ফ্রম আমেরিকা।’ অন্যজন একইভাবে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘আই অ্যাম এরিক কোহেন ফ্রম ইসরায়েল।’ দুজনই ইংরেজিতে কথা বলছেন, তবে উচ্চারণের পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

ওই দুজনের বাহ্যিক অবয়ব একই রকম প্রায় এবং মাথার ইয়ামাকা তাঁদের লালিত বিশ্বাসের অঙ্গ, তবু তাঁদের আত্মপরিচয় ভিন্ন। দুজনের দুটো দেশ রয়েছে, সেই ভূখণ্ড তাঁদের পরিচিতি তুলে ধরে।

আরেকটি ঘটনা। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক সমরেশ মজুমদার এসেছেন। মেলবোর্ন বিমানবন্দরে জাতিধর্ম–নির্বিশেষে কয়েকজন বাংলাভাষী সাহিত্যপ্রেমী তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত। বাইরে অবয়ব একই রকম এদের। কেউ বলছেন, ‘নমস্কার দাদা, কেমন আছেন?’

অন্য কেউ একজন বলছেন, ‘আদাব দাদা, পথে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’
ভাষাটা বাংলাই বলা হচ্ছে, তবে দুজনের উচ্চারণের তফাৎ লক্ষণীয়।

বিমানবন্দরে উপস্থিত বাংলাভাষীদেরও আত্মপরিচয়ের সঙ্গে নিজস্ব ভূখণ্ড মিশে আছে। এক দল ভারত রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাংলাভাষী, আরেক দল বাংলাদেশের বাংলাভাষী। এক দলের জাতীয় পরিচয় তারা ভারতীয়, আর অন্য দলের পরিচয় এরা বাংলাদেশি। দেখা যাচ্ছে, ভাষা এক হলেও আত্মপরিচয়ের জন্য নিজ ভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ততা পরিচিতির অঙ্গ।

বাংলাদেশি পরিচয় স্থাপিত হয়েছে ১৬ ডিসেম্বরে বিজয়ের মাধ্যমে। নিজস্ব আত্মপরিচয়ের জন্য ভূখণ্ড ও একটি পতাকা জরুরি। সেই ভূখণ্ড ও পতাকা পাওয়ার জন্য যে ভূমির মানুষ যখন রক্ত বিলিয়ে দিতে পিছপা হয় না, তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠা ঠেকায় কার সাধ্য? আত্মপ্রতিষ্ঠিত জাতির পরিচিতি দেওয়ার মতো থাকে নিজ ভূমি, থাকে নিজস্ব পতাকা এবং নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি।

শুধু ভাষা এক হলেই মানুষের পরিচিতি এক হবে, তা নয়। ইউরোপে রাষ্ট্রগুলোর নাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভাষা থেকে উদ্ভুত। যেমন ইংলিশ ভাষার দেশ ইংল্যান্ড, পোলিশ ভাষার দেশ পোল্যান্ড, রুশ ভাষার দেশ রাশিয়া, রোমানিয়া ভাষার দেশ রোমানিয়া। মোলদভা (পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত একটি প্রদেশ ছিল এবং বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মার্ক শাগালের মাতৃভূমি) রাষ্ট্রের মানুষের ভাষাও রোমানিয়া, তবে তাদের আত্মপরিচিতি তুলে ধরে তাদের স্বদেশ–স্বভূমি। তারা পরিচিত হয় মোলদাভান নামে। ভাষা এক হলেই দুই ভূখণ্ড এক হয়ে যাবে, তা সব ক্ষেত্রে ঠিক নয়।

সহজ–সরলভাবে এটুকু বুঝি, আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ড, নিজের পতাকা, আমাদের নিজেকে প্রকাশের জন্য নিজের ভাষা—এসব হচ্ছে আমাদের আত্মপরিচিতির মূল উপাদান।
যদি ভাষা বাঁচানোর সংগ্রাম না হতো, আত্মপরিচয় ধরে রাখা যেত কি? রক্ত দিয়ে ভাষা রক্ষা করেছিল কারা? কবির লেখনী বলে— (স্মৃতি থেকে লিখছি; কবি খুব সম্ভবত সুফিয়া কামাল)

‘মায়ের নয়নমণি, মায়ের বুকের আশা
বক্ষ রক্তে লিখে গেল বাংলা মোর ভাষা।’

তারপর হলো দুঃশাসন থেকে মুক্তির জন্য লড়াই। নিজস্ব ভূমির স্বাধীনতা, নিজ পতাকা পাওয়ার মরণপণ শপথ। নিঃস্বার্থ ও ত্যাগী নেতৃত্ব এবং সর্বস্তরের মানুষের চেষ্টা ছিল শপথ বাস্তবায়নের মূল শক্তি। এ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সফল হলো পতাকা উত্তোলন, অর্জিত হলো মাতৃভূমির স্বাধীনতা।

হিটলার নিরপরাধ ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করে নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার উন্মাদনায় মেতে ছিলেন আর পাকিস্তানের শাসক দল বাঙালিদের শেষ করতে চেয়েছিল নিজেদের কর্তৃত্ব শক্ত করার উদ্দেশ্যে। হিটলার অনেক বছর ধরে ইহুদি নিধনে তৎপর ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় পাঁচ বছর সময়েজুড়ে ছয় কোটির মতো মানুষ নিহত হয়, যার ভেতর ৬০ লাখ ছিল ইহুদি। আর পাকিস্তান বাহিনী মাত্র ৯ মাসে ৩০ লাখ বাঙালির প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দেয়।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় সৈন্যদের যুদ্ধের আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে হত্যা, ধর্ষণ ও সীমাহীন বর্বরতা চালানোয় উদ্বুদ্ধ করেছিল যুদ্ধবাজদের নীতিহীনতা এবং (শোনা যায়) সৈন্যদের মাদকনির্ভরতা। আর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময় অত্যন্ত চতুরভাবে ধর্মকে হাতিয়ার করেছিল পাকিস্তান বাহিনী। কোনো ধর্ম এই পাশবিক আচরণ অনুমোদন করে না। তবে ধর্মের নামে চালানো ৯ মাসের সেই যুদ্ধে দুই লাখ মা-বোন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সুফিয়া কামালের কবিতা হৃদয় হাহাকার তোলে—
‘জাদুরা দিয়েছে প্রাণ, দুহিতারা সম্ভ্রম–সম্মান,
মায়েরা উপাড়ি দিল হৃৎপিণ্ড...’*

বিজয়ের প্রাক্কালে ১৪ ডিসেম্বর বাংলার বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন এদের সহযোগিতায় সূচারু রূপে সংগঠিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন—

‘বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা
এর যে মূল্য, তার সবই কি ধরার ধুলায় হবে হারা।’

কিছুই ধরার ধূলায় হারায়নি। কবিগুরু নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বাংলায় লিখে। তাঁর প্রয়াণের পর উপমহাদেশ ব্রিটিশের কবজা ভেঙে বের হলো। তারপর অনেক রক্ত ঝরিয়ে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে স্বাধীন এক ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠিত হলো এবং কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ মর্যাদা পেল স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কবিগুরু তৎকালীন পূর্ব বাংলার মাটিতে তাঁর জমিদারিতে অবস্থানের সময় এ গানের সুর খুঁজে পেয়েছিলেন। বাংলার মাটির সুরের অসাধারণ মাধুর্য অনুধাবন করার জন্য রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বই প্রয়োজন ছিল। মনে বোধ জাগে, লাল–সবুজ পতাকা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গে অনুরণন তোলার জন্য কবিগুরুর বাণী ও গগন হরকরার সুর (আমার সোনার বাংলা) ছিল ব্যাকুল অপেক্ষায় এবং এ কথা গভীর বেদনা ও গর্বের সঙ্গে বলতে হয় যে নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন, বীরের রক্ত ক্ষরণ ও বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণদান এই অপেক্ষার অবসান করেছিল।

*সুদূর আমেরিকা থেকে কবিতা পাঠিয়ে সহযোগিতার জন্য কবি সুফিয়া কামালের পুত্র সাজেদ কামালের প্রতি কৃতজ্ঞ।