ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ এবং কিছু প্রশ্ন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: রয়টার্স

আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানটি টেলিভিশনে লাইভে সেদিন আমি পুরুটা দেখেছি, দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রথম মেয়াদের চাইতে এবারের ট্রাম্পকে অনেক বেশি ম্যাচিউরড। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি অনেকগুলো নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অবৈধ অভিবাসী বিতাড়ন এবং এই দেশে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা এখন থেকে আর জন্মসূত্রে আমেরিকান নাগরিক হবে না।

অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই মাঠে সক্রিয় রয়েছে আইসিআই। এই আইসিআই কী? আইসিআই হচ্ছে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট আর যাঁরা এই ধরপাকড়ে নিয়োজিত, তাঁদের বলা হয় ইআরও, অর্থাৎ (এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড রিমোভাল অপারেশন) সব কটি সীমান্তে ইতিমধ্যেই তিনি জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। বাণিজ্য অংশীদারদের পণ্যের ওপর তিনি নতুন শুল্ক–কর আরোপ করেছেন। তিনি দাবি করছেন, আমেরিকার স্বপ্ন ন্যায় এবং সমতার ভিত্তিতেই হবে। বিশ্বে দুটি দেশ বাদে সব দেশে আমেরিকার এইড (সাহায্য) ৯০ দিনের জন্য বন্ধ থাকবে; অর্থাৎ তিনি এই ৯০ দিনের মধ্যেই জানতে চান, কোন কোন দেশ সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত এবং দেশগুলো আমেরিকার জন্য কতটা দরকারি।

যে দুটি দেশ এ আদেশের আওতামুক্ত থাকবে তা হচ্ছে মিসর ও ইসরায়েল। তিনিই আমেরিকার প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট, যাঁর বিরুদ্ধে আনা ফৌজদারি ৩৪টি অভিযোগের মধ্যে সব কটিতেই অভিযুক্ত এবং তিনি আদালতে অভিযুক্ত প্রমাণিত হওয়ার পরও বিচারক তাঁকে দণ্ড থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই গতবার ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য সাজাপ্রাপ্ত প্রায় ১ হাজার ৬০০ নাগরিককে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁর প্রথম কাজ হবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করা, এটি একটি ইতিবাচক দিক।

ফিলিস্তিন ইস্যুতে ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও ২০০০ পাউন্ড বোমা তিনি ইতিমধ্যেই ইসরায়েলে পাঠিয়েছেন এবং ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র কোনো দেশে কিংবা কয়েকটি দেশে স্থানান্তরিত করা যায় কি না, এ বিষয়ে তিনি আলাপ–আলোচনা শুরু করেছেন। মার্কিন অর্থনীতি, বাজারমূল্য হ্রাস, অভিবাসন, যুদ্ধনীতি—তাঁর এসব নীতির কারণেই মূলত দ্বিতীয় মেয়াদে রিপাবলিকান পার্টি থেকে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। ‘উই দ্য আমেরিকান অ্যান্ড আমেরিকা ফাস্ট’, এটাই ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এবারের নির্বাচনী স্লোগান। ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বিদেশে সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। বিদেশি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ (ক্ষেত্রবিশেষে ২০ শতাংশ) শুল্ক আরোপ করেছেন। কিছু নির্বাহী আদেশ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও তিনি তা পারেন কি না, এ নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এবং কিছু কিছু আদেশের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন আদালতে মামলাও হয়েছে। তবে আমি মনে করি, হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে নির্বাহী ক্ষমতা প্রেসিডেন্টকে দেওয়া হয়েছে, যদিও সংবিধানে বর্ণিত আছে, পিতা/ মাতার স্ট্যাটাস (বৈধ কিংবা অবৈধ) যা–ই হোক না কেন, এই দেশে যে সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, সে–ই জন্মসূত্রে এই দেশের নাগরিক হবে; কিন্তু প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশবলে এখন থেকে আর কোনো শিশু জন্মসূত্রে আর আমেরিকার নাগরিকত্ব পাবে না।

বিতর্কিত সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে প্যারিস জলবায়ুচুক্তি থেকে আমেরিকার নাম প্রত্যাহার, হু (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সদস্যপদ প্রত্যাহার এবং আমেরিকার কাছে কানাডার বিপুল পরিমাণ ঋণ থাকায় তিনি দেশটিকে আমেরিকার অঙ্গরাজ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান জানিয়েছেন। গ্রিনল্যান্ডকে তিনি কিনে নিতে চাইছেন আর ডেনমার্ককে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে আনার চেষ্টা করছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী, তিনি লেনদেন খুব ভালো বোঝেন। তিনি ট্রানজেকশনাল পারসন; সুতরাং কোন কোন দেশে আর্থিক সাহায্য দেওয়া যৌক্তিক হবে, তা তিনি রিভিউ করতে চান আর যুক্তরাষ্ট্রের সব সাহায্য মূলত বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা জাতিসংঘের মাধ্যমে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শুধু একটা জায়গায় হোঁচট খেতে পারে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে, তা হলো ‘রোহিঙ্গা’ ইস্যুতে। কেননা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং খাদ্যের বেশির ভাগই আমেরিকার সাহায্যে পরিচালিত হয়। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, এই স্থগিতাদেশ যেহেতু পৃথিবীর সব দেশের জন্য স্বল্প সময়ের জন্য (৯০ দিনের জন্য), সুতরাং বাংলাদেশ এই ৯০ দিনের জোগান নিশ্চয় সামাল দিয়ে পারবে। বাংলাদেশের পোশাক খাত নিয়ে আমি মোটেও ভাবছি না, বাংলাদেশ থেকে আমেরিকার পোশাক আমদানি করাই লাগবে, কেননা এত সস্তা দামে কাপড় অন্য কোনো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিনতে পারবে না। ওয়ালমার্ট, জেসি প্যানিসহ আরও কত কত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল, দেশে শুধু স্থিতিশীলতাটা খুব দরকার।

শেষে একটা কথা বলতে চাই, অবৈধ অভিবাসী যাঁরা আছেন, তা আশ্রয় (অ্যাসাইলাম) হোক কিংবা ওয়ার্ক পারমিটই, স্টুডেন্ট ভিসা হোক, ট্যুরিস্ট ভিসা হোক, বিজনেস ভিসাই হোক, এখন থেকে সঙ্গে অবশ্যই আইডি কার্ড রাখবেন। আইসিই যেকোনো জায়গায় তল্লাসি, যে কাউকেই জিজ্ঞাসাবাদ এবং গ্রেপ্তারের এখতিয়ার রাখে। সুতরাং তারা যদি আপনাকে চ্যালেঞ্জ করেই বসে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। ভুলেও যে কাজটি করবেন না তা হচ্ছে, রূঢ় ব্যবহার, খারাপ ব্যবহার। প্রয়োজনে আপনি বিনীতভাবে এইটুকু বলতে পারেন, ‘আমি আমার অ্যাটর্নি ছাড়া কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।’ তাতে অনন্ত ডিপোটেশনের ঝুঁকিটা তাৎক্ষণিকভাবে কিছুটা কম থাকে, বড়জোর সেই ক্ষেত্রে তারা আপনাকে ডিটেনশন সেন্টারে কিংবা শেল্টারে নিয়ে যেতে পারে।