বছরের এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে গ্র্যাজুয়েশন টাইম
যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন, যাঁদের সন্তানেরা বড় হচ্ছে, তাঁদের জন্য বছরের এই সময়, বিশেষ করে মে-জুন মাসটা একটু অন্য রকম। এই সময় স্কুল ইয়ার শেষ হয়। দু-আড়াই মাস শেষে আবার নতুন ক্লাস শুরু হয়। এই সময় বাবা-মায়েদের বুঝিয়ে দেয় বাচ্চারা বড় হচ্ছে। এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাস। বয়সও বাড়ছে ওদের, ১০ থেকে ১১ বা ৮ থেকে ৯। কিন্তু যাঁদের বাচ্চারা আরেকটু বড়, হাইস্কুলে পড়ে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই সময়টা একটু কঠিন। আর একমাত্র সন্তান হলে তো কথাই নেই।
আমার কথা বলি। আমার এখানকার জীবন ২৩ বছর হয়ে এল। আমাদের একমাত্র সন্তান, মেয়ে, লাবণ্য এবার হাইস্কুলের ১১তম গ্রেডে, অর্থাৎ জুনিয়র ইয়ার শেষ করবে আর দুই সপ্তাহ পর। একই সময়ে সে ১৭ বছর বয়স পূর্ণ করবে। স্কুলে তার আরও এক বছর বাকি আছে। ১২তম গ্রেড অর্থাৎ সিনিয়র ইয়ার।
কিন্তু হাইস্কুলে এবং ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য এই জুনিয়র ইয়ারটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভালো ইউনিভার্সিটি, পছন্দের সাবজেক্ট, ডিপার্টমেন্ট—সবকিছু এই বছরের রেজাল্টের ওপর নির্ভর করে। আমার মেয়ে লাবণ্য এখন তার ‘এসএটি’, ‘এসিটি’ সব এপি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত।
নভেম্বরের মধ্যে সব ইউনিভার্সিটিতে আবেদনপত্র পাঠাতে হবে। এ এক লম্বা এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এখন প্রতিদিন মেইলে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ওর জন্য আমন্ত্রণপত্র আসছে, যা ইউনিভার্সিটিগুলো প্রায় সবাইকেই পাঠায়।
আর হ্যাঁ, যারা এবার সিনিয়র ইয়ার কমপ্লিট করছে, তাদের যেমন ইউনিভার্সিটি যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে, তেমনি গ্র্যাজুয়েশন পার্টির আয়োজন হচ্ছে পুরোদমে। এখানে কমবেশি সবাই তাঁর সন্তানের জন্য গ্র্যাজুয়েশন পার্টির আয়োজন করেন।
আমার মেয়ের মতো যারা এবার জুনিয়ার ইয়ার কমপ্লিট করছে, তাদের জন্য আগামী বছর, অর্থাৎ সিনিয়র ইয়ারে পড়াশোনার চাপ কম থাকবে। ইউনিভার্সিটি অ্যাপ্লিকেশন, ক্যাম্পাস ভিজিট, স্কলারশিপের জন্য আবেদন, ফিন্যান্সিয়াল এইডের খোঁজ এসব নিয়ে খুব টেনশনের একটা সময় যাবে। আশা করি, আগামী বছর এ সময় ওর সবকিছুই ঠিকমতো নির্ধারিত হবে। মেয়েকে আমরা টেক্সাসেরই কোনো ভালো ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্রেড করতে পাঠাব চার বছরের জন্য, সে রকমটাই ইচ্ছা, পরিকল্পনা। এই চার বছরের মধ্যেই বাচ্চারা জীবনের জন্য তৈরি হয়ে যায়। আন্ডারগ্র্যাজুয়েশন হলে অনেকে কিছুদিনের জন্য চাকরিতে ঢোকে। অনেকে আবার কোনো বিরতি ছাড়া মাস্টার্সে ভর্তি হয়।
মা-বাবার ছোট্ট বাচ্চাটা আর কখনোই তাঁদের কাছে আগের মতো ফিরে আসে না। আসে বিশেষ দিনে। ছুটিতে ছোট্ট এক স্যুটকেসে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে। যদিও মা-বাবার বাড়িতে তাদের সেই ঘর একই রকম থেকে যায়; এ দেশে এই পর্যায়েরও একটা নাম আছে—‘ইম্পটি নেস্ট’ বা ‘শূন্য ঘর’।
সময়টা একই সঙ্গে খুশির। কারণ, সন্তান বড় হচ্ছে, নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। নিজের জীবনের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে। আবার একই সঙ্গে কষ্টের এই ভেবে, বাচ্চারা বড় হয়ে গেল কেন এত তাড়াতাড়ি? একটি কথা আছে, ‘ডেজ আর লং বাট ইয়ারস আর শর্ট’।
এসব ভাবনায় কয়েক দিন ধরে আমার শুধু কান্না পাচ্ছিল। মেয়ের দিকে তাকালেই চোখে পানি। কোথাও ছোট বাচ্চাসহ কোনো মা-বাবাকে দেখলে মনে হচ্ছিল, আহা, তাঁদের হাতে এখনো অনেক সময় আছে!
এমন হাজারো ভাবনা নিয়ে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশের স্বনামধন্য অভিনয়শিল্পী বিপাশা হায়াতের সঙ্গে। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিপাশার ছেলে ইতিমধ্যে পড়তে চলে গেছে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। মেয়ে লাবণ্যর বয়সী। জুনিয়র ইয়ার। এক বছর পর সেও চলে যাবে। বিপাশা একই সঙ্গে খুব আবেগপ্রবণ, আবার প্র্যাকটিক্যাল চিন্তার মানুষ। খুব সুন্দর করে আমাকে বোঝাল। বাচ্চারা যখন বড় হয়ে নিজের দায়িত্ব নিতে তৈরি হয়ে যায়, তখন কিন্তু তা মা-বাবার জন্য খুব আত্মতৃপ্তিরও ব্যাপার। তার মানে মা-বাবা হিসেবে ছোট্ট বাচ্চাটাকে ক্রমেই আমরা এ পৃথিবীর জন্য, জীবনের জন্য তৈরি করতে পেরেছি।
মানুষ হিসেবে সেটাই তো আমাদের সাফল্য। আমাদের দায়িত্ব। এরপর আমরা ওদের দূর থেকে শুধু ভালোবাসব। বিপাশার এই সুন্দর কথার সঙ্গে আমি মনে মনে আরও কয়েকটা লাইন যুক্ত করি। দূর থেকে ভালোবাসার সঙ্গে ওই প্রতিদিন ফোনে, ভিডিও কলে চলতেই থাকে, চলতেই থাকবে। ছোট ছোট কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন।
‘উঠেছ?’
‘খেয়েছ?’
‘পড়েছ?’
‘এখনো জেগে আছ?’
‘কবে বাসায় আসবে?’
কাছে অথবা দূরে। মা-বাবার মন, বিশেষ করে মায়ের মন বলে কথা। সে সব সময় জেগে থাকে। অপেক্ষায় থাকে।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]