প্যারিসনামা
ইংরেজিতে ‘ব্যাকবেঞ্চার’ শব্দের অর্থ হলো ক্ষমতাহীন ব্যক্তি। ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার সংসদীয় ব্যবস্থায় ব্যাকবেঞ্চার বলতে সেই ব্যক্তিদের বোঝায়, যাঁদের না আছে সরকারি দলের পক্ষ হয়ে কিংবা বিপক্ষ দলের পক্ষ হয়ে কথা বলার অধিকার। তাঁরা শুধু বসে বসে কথা শোনেন। খাঁটি বাংলায় বলতে গেলে, তাঁরা এমপি হলেও সংসদে মূলত মাকাল ফল।
আমি হলাম ব্যাকবেঞ্চার টাইপের মানুষ। মানে সবকিছুতেই পেছনের দিকে থাকা মানুষ। একেবারে পেছনে বললে একটু ভুল হবে, সবচেয়ে পেছনের ঠিক আগেরটা। যেমন স্কুলজীবনে ক্লাসের সবচেয়ে শেষের বেঞ্চের আগের বেঞ্চে বসা ছাত্র। মসজিদে নামাজে গেলে সবচেয়ে শেষের লাইনের আগের লাইনে দাঁড়ানো নামাজি। আরও উদাহরণ আছে, যেমন পোস্ট অফিস কিংবা বিদ্যুৎ বিল দিতে গেলে বিরাট লাইনের সবচেয়ে শেষ ব্যক্তির আগের ব্যক্তিটি আমি।
এয়ারলাইনসে ভ্রমণ করতে গেলে বিমানের টয়লেট ও লেজের দিকে যে আসনগুলো থাকে, সেগুলোর সবচেয়ে শেষের সারির আগের সারিতে থাকা যাত্রী।
সবচেয়ে শেষের ব্যক্তির আগের ব্যক্তি হওয়ার একটি বিরাট সুবিধা আছে। নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া যায় এই বলে যে দুনিয়াতে আমার চেয়েও অন্তত একজন বা এক সারির লোক বা অভাগা এখনো বিদ্যমান, যাঁদের অবস্থান আমার চেয়েও দূরে। অর্থাৎ তাঁদের চেয়ে আমার অবস্থা উত্তম। অন্যভাবে বলতে গেলে, এটা গরিব হয়ে জন্মানোর একধরনের আত্মতৃপ্তি।
তবে এক্কেবারে শেষে থাকাও চরম ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন দেশের স্কুলজীবন থেকে শিখেছি যে একেবারে শেষের বেঞ্চে বসা মানে পলাতক আসামি। কারণ, স্যারেরা কারণে-অকারণে শেষের বেঞ্চে বসা ছাত্রদের অপরাধী হিসেবে সন্দেহ করেন। অকারণেই তাদের পড়া ধরেন বেশি। কোনো কারণে স্যারেরা যদি স্ত্রীদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করে ক্লাস নিতে আসতেন, তাহলে সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চে বসা ছাত্রদের পিটিয়ে নিজেদের স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নিতেন।
যাহোক, ২০১৮ সালের শেষের দিকের ঘটনা। বিশ্বজুড়ে করোনা ভাইরাস তখনো অজানা বিষয়।
লন্ডনে এক সপ্তাহের মতো থেকে ট্রেনে চেপে প্যারিসে যাওয়ার পরিকল্পনা পরিবারসহ।
লন্ডন থেকে প্যারিসগামী ট্রেন আধা ঘণ্টা বিলম্ব হওয়ায় ইউরো ট্রেন কর্তৃপক্ষ প্রথমে ক্ষমা চেয়ে ক্ষতিপূরণ বাবদ আমাদের বিজনেস ক্লাস দিল।
ইউরো ট্রেনের বিজনেস ক্লাস মানে সেই রকম আলিশান ব্যাপার। বগির এক পাশে চা–কফি। অন্যপাশে বিভিন্ন ফলের রসওয়ালা রঙিন বোতল। দোতলা ট্রেনের নিচতলায় আবার টাওয়ালসহ গোসল করার ব্যবস্থা। বাড়তি পাওনা হিসেবে বগিতে দুপুরের খাবার পরিবেশন—সবই ফ্রি।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে হঠাৎ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মানুষ বলে মনে হয়। আমার মতো গরিব লোক হঠাৎ ধনী হয়ে গেলে আবার বিভিন্ন ধরনের সিমটম বা উপসর্গ দেখা দেয়। আমার মধ্যে সেই ধরনের একটা উপসর্গ দেখা দিল। পেটে ক্ষুধা নেই তারপরও মনে হলো, এ ধরনের খাবার না খেয়ে গেলে দেশি সমাজে মাথা দেখানো ইজ্জতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ট্রেনের ভেতর ফ্রি গামছা দিয়ে গোসল না করলেও এই জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাওয়ার দুশ্চিন্তা। যদিও ঘণ্টা দুই আগেই গোসল করে স্টেশনে এসেছিলাম।
যাহোক, শেষমেশ গোসল ছাড়াই ইউরো ট্রেনযাত্রা শেষ করলাম প্যারিস পৌঁছে।
প্যারিস শহর তখন রাতের আলোয় আলোকিত। আগে থেকেই এয়ার বিএনবির মাধ্যমে একটা দুই রুমের বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম শহরের কাছাকাছি। ওই বাসার জানালা দিয়ে তাকালে আইফেল টাওয়ারের বাত্তি জ্বালানো মাথা দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর রাতের খাবার কিনতে প্যারিসের রাস্তায় বের হলাম একা। উদ্দেশ্য দেশি রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করে খাবার কিনে নিয়ে আসা। আধঘণ্টার মধ্যে কমপক্ষে দুটি দেশি রেস্টুরেন্ট খুঁজে পেলাম। পরিচয় হলো কমপক্ষে পাঁচজন বাংলাদেশির সঙ্গে। বোনাস হিসেবে পরিচয় হলো আরও কমপক্ষে সাতজন সেনেগালিস ভাই-ব্রাদারের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে আবার চারজনের একই নাম। ইব্রাহিম।
যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপের সবকিছুই ছোট। বাড়ি-গাড়ি, দোকান, রাস্তাঘাট, রেস্টুরেন্ট, বার্গারের সাইজ ইত্যাদি অনেক কিছুরই সাইজ ছোট। পক্ষান্তরে, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কিছুই আকারে বড়। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের শারীরিক গঠন ও উচ্চতার দিক দিয়ে ইউরোপিয়ানদের চেয়ে বেশি না হলেও প্রস্থে বেশ মোটা। এর একটা কারণ, আমেরিকানরা খায় বেশি কিন্তু হাঁটাহাঁটি করে কম।
ভাড়া করা বাড়িতে দুটি রুম, একটি টয়লেট থাকলেও সেটি মূলত একটি ছোট রুমের সমান। কাঠের ওয়াল দিয়ে এক পাশে বাথরুম অন্যপাশে থাকার রুম করা হয়েছে। ওয়ালমার্ট থেকে বড় পুতুল কিনলে খুব সম্ভবত প্রাণহীন পুতুলও ওখানে থাকতে পারবে না।
রাতে ঢুকলাম কাচ দিয়ে ঘেরা গোসলখানায়। গোসলখানাটি উচ্চতায় সাড়ে ছয় ফিট হলেও প্রস্থে খুব সম্ভবত ২৪ ইঞ্চি বা দুই ফিটের বেশি না। কোনোরকমে স্লিম ফিগারের একজন দাঁড়িয়ে গোসল করতে পারবে; কিন্তু ডানে বা বাঁয়ে ঘুরে ঘুরে গোসল করতে পারবে না। ওপরের দিকে সাবানদানি।
আমি সাবান গায়ে মাখতে মাখতেই সর্বনাশ হয়ে গেল। পিচ্ছিল সাবান হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। কিন্তু ওই সাবান হাত দিয়ে তোলার কোনো উপায় নেই। কারণ, দুই ফিট চওড়া গোসলখানায় শরীর উপুড় করে সাবান তোলা যাবে না। এমতাবস্থায় শব্দ করেও কারও সাহায্য নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, গোসলখানার দরজাও বন্ধ।
শেষমেশ এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আরেক পা ভাঁজ করে পাঁচবার চেষ্টা করে সাবান মেঝে থেকে তুলে আনলাম।
এক পা দিয়ে এই অসাধ্য কাজটি করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হলো।
আগেই বলেছিলাম, গরিবের আত্মতৃপ্তি এক অন্য রকম ব্যাপার। ব্যাপারটি বুঝতে হলে আপনাকে অবশ্যই গরিব হতে হবে।
কারও কাছে পাঁচ হাজার টাকায় দুপুরের খাবারের বিল মামুলি ব্যাপার। কিন্তু একটা পিঁপড়ের কাছে একটি ভাজা মুড়ির ভাঙা অংশ বিশাল প্রাপ্তি।
আমি সেই এক পিস মুড়ি নিয়ে হেঁটে চলা পিঁপড়া দলের মানুষ।
ধনী-গরিব, প্রাপ্তি কিংবা অপ্রাপ্তিতে ভরপুর সবার জীবনই হোক সুখের ও আনন্দের।
শুভ হোক নতুন বছর ২০২৫।
*দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ