জননী আমার, প্রতিদিন হোক মা দিবস
১২ মে মা দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রবাস থেকে পাঠানো পাঠকের লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।
বহুল পঠিত বিখ্যাত প্রবাদ, ‘দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বোঝে না’। এই প্রবাদ জানার পরও আমরা তেমন করে মায়ের মর্ম বুঝি না। ছোট্ট একটি শব্দ, অথচ কী বিশালত্ব লুকিয়ে আছে এই একটি এক অক্ষরের শব্দে। পৃথিবীর সব দেশে সব ভাষাতেই রয়েছে এই মা শব্দ। ম্যাক্সিম গোর্কির বিখ্যাত ‘মা’ উপন্যাস বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। আনিসুল হকের লেখা ‘মা’ উপন্যাস ইতিমধ্যে শততম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। সবার হৃদয়ে আবেগের আকুতির একটি উচ্চারণ, মা। শওকত ওসমান লিখেছেন ‘জননী’। মা শিরোনামের বই দ্রুত পাঠক আদৃত হয়। ব্যথা পেলে, হোঁচট খেলে, অসুস্থ হলে উচ্চারিত হয় এই একটি শব্দ, মা। মাকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান। প্রতিদিন মাকে স্পর্শ করা উচিত। মাকে হাগ (আলিঙ্গন) করা উচিত। প্রবাসে আমার ছেলে-মেয়ে সব সময় তাদের মাকে বলবে, ‘মা হাগ দাও।’
মাকে (১৩ আশ্বিন, ১৩২৮—১৯ মাঘ, ১৪০৪) কখনো দেখিনি আব্বার সঙ্গে ভাত খেতে। আমাদের সবার খাওয়াদাওয়ার পর মা ভাত খেতেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই রীতি। স্বামীর খাবার শেষে স্ত্রী খাবার খাবেন, এটি স্বামীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। পরিবারের সবার খাবারের পর মা ভাত খেতেন। আব্বার সঙ্গে আপনি সম্বোধনে কথা বলতেন মা। শৈশবে ‘বিষাদ সিন্ধু’ পড়তে দেখেছি মাকে, মহররম মাসে ও বিভিন্ন সময়ে পুঁথি পড়তেন সুর করে। রেডিওতে নাটক শুনতেন। মাগরিবের পর পাঞ্জেগানা সুরা পড়তেন। বিকেলে রেডিওতে কৃষি অনুষ্ঠান, সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় রেডিওতে দুর্বারে গান শুনতেন। মায়ের বিয়ে হয়েছিল শৈশবে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুল পর্যন্ত পড়েছিলেন মা। নানা ছিলেন মায়ের পথপ্রদর্শক ও শিক্ষক। পিতার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ, অপরিসীম ভালোবাসা। মা কখনো কোনো রকমের কসমেটিকস ব্যবহার করতেন না। চোখে সুরমা নিতেন এবং ঈদের আগে হাতে মেহেদি দিতেন।
দুপুরে জোহর নামাজ পড়ে ঘরের কাজ শেষ করে দুপুরের ভাত খেতেন পড়ন্ত বেলায়। রাতে মা আর খাবার খেতেন না। দুই ঈদে ভোররাতে ঘুম থেকে উঠে রান্না শুরু করতেন। আমরা ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে গরম পোলাও, খিচুড়ি খেয়ে ঈদগাহে গিয়েছি। কখনো এই নিয়মের কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রতিবছর শীতে দুপুরের পর থেকেই শুরু হতো পিঠার আয়োজন। মধ্যরাত পর্যন্ত পিঠা বানানোর পর সবাই বিছানায় গেলেও মা রান্নাঘরে লাকড়ির চুলার পাশে সারা রাত পিঠার আয়োজনে ছিলেন ব্যস্ত। সকালে চলত পিঠার বিলিবণ্টন। আত্মীয়-প্রতিবেশীদের বাসায় বিতরণ। আব্বা ফোন করে ডেকে আনতেন তাঁর প্রিয়জনদের। টিফিন ক্যারিয়ার আমার হাতে দিয়ে বলতেন, ‘দুলামিয়ারে দিয়া আয়।’ মা তাঁর মেয়ের স্বামীকে দুলামিয়া সম্বোধন করতেন। যেকোনো ভালো খাবার রান্না করলেই আমার হাতে মা টিফিন ক্যারিয়ার তুলে দিতেন দুলাভাইয়ের জন্য। আপা তখন নারায়ণগঞ্জের কিল্লারপুলে থাকতেন, এরপর স্বামীবাগ ছিলেন। বিআরটিসির বাসে চড়ে গিয়েছি ঢাকায় একাত্তরের আগে। একাত্তরের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতে আমি ছিলাম আপার স্বামীবাগের বাসায়। পুকুরপাড়ে, রেললাইনের কাছে।
উচ্চ রক্তচাপ থাকায় স্ট্রোক হলে তিন দিন পর চোখ খোলেন মা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক দুলাভাইয়ের বড় ভাই ডাক্তার জোয়ারদার (প্রয়াত)। তাঁর রেফারেন্সে মা হাসপাতালে দুই বেডের কেবিনে ভর্তি হলে তিনি চিকিৎসার সব খরচ ফ্রি করে দিলেন। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলে ডান হাত, ডান পা অচল হয় তাঁর। রান্নাঘরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেন। কিন্তু জীবন তাঁকে কোনো ছাড় দেয়নি। উপর্যুপরি স্ট্রোক হলে বিছানাই তাঁকে কোলে টেনে নেয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি হন জ্ঞানহীন। বিছানায় শুয়ে থাকার ফলে পিঠে বেডসোর বা ঘা হয়। জ্ঞানহীন থাকায় ডান হাতে পিঠ চুলকাতেন, এ জন্য আব্বা মায়ের ডান হাত বেঁধে রাখতেন। আব্বা মায়ের পিঠে পাউডার ও ওয়েন্টমেন্টে দিয়ে দিতেন। নাকের রাইস টিউব দুই সপ্তাহ পরপর পরিবর্তন করতে হতো। সে এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। স্ট্রোকে অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মা চলে যাওয়ার আগপর্যন্ত বিরতিহীন ২২ বছর আব্বা দ্বিধাহীন চিত্তে, অবিচলভাবে, অপরিসীম মমতায় মায়ের সেবা করেছেন।
শৈশব থেকেই দেখেছি, বরাবরই ছবি তোলার প্রতি মায়ের ছিল অপরিসীম অনাগ্রহ। ১৯৬৭-৬৮ সালে মেজদা লুকিয়ে মায়ের ছবি তুললেও সেই ছবি কখনোই আলোর মুখ দেখেনি। কী করে নেগেটিভ নষ্ট হয়ে গেছে, সে এক অপার বিস্ময়। ছবি নষ্ট হয়ে গিয়েছে শুনলে মা খুব খুশি হতেন।
অতুলনীয় স্বামীসেবায় স্নাত বাক্রুদ্ধ মা ১ ফেব্রুয়ারি (১৯৯৮) রাত দুইটায় নীরবে, নিঃশব্দে অসীমের উদ্দেশে চলে যান।
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]