রুবেনের কাছে হেরে যাওয়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ছেলেটিকে দেখে মেয়েটির পিলে চমকে গেল। অদ্ভুত সুন্দর গোলাপি ঠোঁট আর মথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, কিন্তু কি রাগি রাগি চাহনি। দেখলেই মনে হয় পুরো পৃথিবীর ওপর সে ভয়ানক বিরক্ত। মেয়েটি আবার উল্টো, সব সময় হাসি লেগেই আছে মুখে, আর খুব মিশুক। সবাইকে আপন করে নিতে পারে সহজে। এই গ্রোসারি স্টোরে এমন কেউ নেই, যার সঙ্গে মেয়েটির পরিচয় বা হাই–হ্যালো নেই। সেই মেয়েটিই কি না এই ছেলেটিকে দেখলে ভয়ে হাই বলতে পারে না।

আমার কথাই বলছিলাম। আমি রাইনা। ফ্লোরিডার ছোট্ট শহর টাম্পাতে থাকি পড়াশোনার কারণে। পড়াশোনার পাশাপশি খণ্ডকালীন চাকরি করি একটা বেশ নামী গ্রোসারি স্টোরে। কাজের পরিবেশ খুবই ভালো। এখানে আমরা সবাই সাহায্য করি সবাইকে। শুধু ওই ছেলেটির কাছে সাহায্য চাইতে পারি না। কেন যেন ভয় হয় আমার। ছেলেটি সব সময় গোমরা মুখে ঘুরে বেড়ায় আর খুব ইন্ট্রোভার্টেড। তার পরও কয়েকবার সাহায্য চাইতে বাধ্য হলাম। রাগী চোখে তাকিয়ে থেকেই আমাকে সাহায্য করল সে। এর পর থেকে ভয় আরও বেড়ে গেল। ছেলেটির আশপাশেও যাই না। এর ভেতর একদিন দেখি, চাকু নিয়ে একটা পেপার বক্স কাটার চেষ্টা করছে। আর চাকুটা ওর হাত থেকে ছিটকে এসে আমার পায়ের কাছেই পড়ল। ভয়ে দৌড় দিই অমি। কত রকম উদ্ভট অবস্থা থাকে, কে জানে যে ও সে রকম নয়। পেছনে না তাকালেও বুঝতে পারলাম, এই প্রথম ছেলেটি হাসল। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল।

পরে বেশ কিছুদিন কাজের ফাঁকে চোখ পড়লে দেখতাম ছেলেটি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখে এক অদ্ভূত মায়া। একদিন সাহস করে হাই বলে ফেলি। জানতে পারি ছেলেটির নাম রুরেন। ছেলেটি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আমার মতোই খণ্ডকালীন কাজ করছে। অদ্ভুতভাবে আমাদের ভালোলাগার বিষয়গুলো আর পড়াশোনার বিষয় ও মিলে গেল। একাডেমিক বিষয় নিয়ে আমাদের বেশ কথা হতো।

কাজের সময় আমার পিছে পিছে ঘুরে আমাকে সাহায্য করাই এরপর ওর প্রায়োরিটি হয়ে গেল। আমার নাম রাইনা আর সে ডাকত রানা বলে। কী যে রাগ লাগত। দিন দিন ছেলেটির চোখে মায়ার সঙ্গে মুগ্ধতা যোগ হতে দেখলাম। নানাভাবে ছেলেটি আমাকে বোঝাতে চাইত ভালোবাসার কথা, আমি বুঝেও না বোঝার ভান করতাম। আমি চাইনি ছেলেটি আমার প্রেমে পড়ুক। এর পর থেকে ছেলেটিকে এড়িয়ে চলা শুরু করলাম। খুব কষ্ট হতে লাগল। বুকের ভেতর হাহাকার অনুভব করলাম। বুঝলাম আমিও…কিন্তু এটা যে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ছেলেটিও আমার মতকে সম্মান করে চলতে লাগল।

এরপরও একদিন ছেলেটি কথা বলার সুযোগ পেয়েই ছুটে এলো। এড়ানোর উপায় পাচ্ছিলাম না। ছেলেটি এসে বলল আজই আমার এখানে শেষ কাজ, আমি আমার অধ্যাপকের সহকারী হিসেবে ইউনিভার্সিটিতে কাজ শুরু করছি। তোমার সঙ্গে কী কোনোভাবেই যোগাযোগ রাখতে পারি না? যেকোনো উপায়ে?

এই ভীতু, আমি তোমাকে না করে দিয়েছিলাম। তুমি শুধু একটা কথাই বারবার বলছিলে, ‘উই উইল নেভার সি ইচ আদার এগেইন? নেভার?’ তোমার চোখে কী অদ্ভুত মায়া আর হাহাকার। বিশ্বাস করো, কখনো চাইনি আমার জন্য কষ্ট পাও তুমি। এটা ভেবে কষ্ট পেয়ো না যে তুমি আমার যোগ্য নও, তাই তোমাকে আমার ভালো লাগেনি। এই ভীতু আমি তোমার যোগ্য নই। তোমার সব কষ্ট আমাকে দাও, ভালো থেকো অনেক বেশি। এত মায়া নিয়ে কেউ কী কখনো তাকাবে আমার দিকে?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তবু আমি বিদায়, ভালো থেকো বলে আর কথা আগাতে দিইনি। তুমি বলেছিলে, উইস ইউ অল দ্য সাকসেস। সেটাই তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা আর শেষ কোথা।
তুমি তোমার ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ ভুলে আপন করতে চেয়েছিলে আমাকে কিন্তু আমি পারিনি। এভাবেই খুব ইন্ট্রোভারটেড রুবেনের কাছে হেরে গেলাম এই এক্সট্রোভারটেড আমি। আজও এই যুগে এসেও ভালোবাসা হেরে যায় সমাজ, সংস্কৃতি আর ধর্মের কাছে। স্যালুট সব না হেরে যাওয়া ভালবাসাকে, বেঁচে থাকুক চিরকাল।

*লেখা: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

 **দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]