বিশ্বের মানুষের ৯০ শতাংশ সময় ব্যয় হয় সমস্যা সৃষ্টিতে, বাকি ১০ শতাংশ সমাধানে
কোনো ব্যক্তি যদি ভালো কাজ করেন এবং তার তারিফ করার যখন কেউ না থাকে; বা মন্দ কাজ করলে কেউ ধিক্কার না দেয়, তখনই বুঝতে হবে পৃথিবীর মানুষের অবক্ষয় চলছে। মানবজাতি সম্পর্কে এত বড় একটি খারাপ মন্তব্য করার হিম্মত আমি কীভাবে পেলাম, এমন প্রশ্ন আমাকে করা হয়েছে কয়েক দিন আগে সুইডেনের একটি জনসমাবেশে। আমি তৎক্ষণাৎ আমার ওপরের মন্তব্যের পেছনে একের পর এক যুক্তি দাঁড় করাতে শুরু করলাম। বললাম, সুইডেন দুই শ বছরের বেশি সময় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে চলছে, হঠাৎ কী হলো যে ন্যাটোতে যোগ দিতে হবে এবং কেনই-বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য বিশাল অর্থ ব্যয় করার পরিকল্পনা নিতে হবে? দেশের জনগণ সব শুনছে, দেখছে ও জানছে, তারপরও কোনো প্রতিবাদ নেই, নেই হাহুতাশ।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলছে, ইসরায়েল-হামাস সংকট চলছে, বিশ্বের বহু গরিব দেশের মানুষ না খেয়ে মরছে, তো? চোখের সামনে দুর্নীতি, অনীতি হচ্ছে। আমরা নীরবতা পালন করে চলছি ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই চুপ হয়ে গেল। নতুন কোনো প্রশ্ন নেই। ভাবলাম, যাক, তাহলে যা বলেছি, তা ভুল কিছু নয়। আমার পরবর্তী মতামত ছিল—বিশ্বের মানুষের ৯০ শতাংশ সময় ব্যয় হয় সমস্যা তৈরিতে, আর বাকি ১০ শতাংশ সমাধানে। হঠাৎ তরুণ প্রজন্মের এক মেয়ে হাত উঁচু করে বলল, ‘একটু বিশ্লেষণ করবে, কী বোঝাতে চাচ্ছ তুমি?’ বাকিটা সময়ে আমি যে আলোচনা করেছিলাম, সেটা ছিল নিম্নরূপ—
সারা দিন সমস্যার সমাধান করাই মানুষের কাজ, নাকি সমস্যা সৃষ্টি করা? আমরা কি সমস্যা সৃষ্টি করি, নাকি সমস্যা নিজ থেকে আমাদের ওপর চেপে বসে? আমাদের লোভ-লালসা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-প্রত্যাশা এবং প্রয়োজনই মূলত সমস্যার কারণ। মানুষের কারণে কি তাহলে সমস্যা, নাকি সমস্যার কারণে মানুষ? আমরা স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষাগ্রহণ করি, সে শিক্ষায় কী শিখি মূলত? সমস্যার সমাধান করা এবং সমস্যার সৃষ্টি করা। সমস্যা ও সমাধানের বাইরে আসলে আমরা তেমন কিছু করি না। এখন যদি সমস্যা না থাকত, তাহলে আমরা কী করতাম ভেবেছেন কি কেউ? আমি ভাবতে শুরু করেছি। আমার সেই ভাবনার জগৎ থেকে আজকের এই লেখা।
আমি দূর পরবাসে ৪০ বছর বসবাস করছি। এই ৪০ বছর সময়ে আমি সমস্যার সমাধানের চেয়ে সমস্যা সৃষ্টি করেছি বেশি। যখনই দেখি এটা নেই, সেটা নেই; তখনই শুরু হয় সমস্যা এবং সেই এটা-সেটা না পাওয়া পর্যন্ত সমস্যার পর সমস্যা সৃষ্টি করতে থাকি। কখনো সমাধান করি, কখনো সমাধান করতে গিয়ে এক বা একের বেশি সমস্যার সৃষ্টি করি। তার মানে, আমি ৯০ শতাংশ সময় ব্যয় করি সমস্যা সৃষ্টিতে এবং ১০ শতাংশ সমাধানে। এখন কথা আছে, সেটা হলো, অনেক সময় আমরা জানি না সমস্যাটা কী। সেটাও একটা বড় সমস্যা। বহু গবেষণার পর হয়তো জানতে পারলাম সমস্যা, এখন সেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। যখন সমাধান পেয়ে গেলাম তখন কিছু সময় স্বস্তি, শান্তি, আনন্দ-ফুর্তি এসে হাজির হলো এবং ঠিক সেই মুহূর্তে নতুন চিন্তার উদয় হলো, মানে শুরু হলো নতুন সমস্যা। ধরুন, শখ হলো শিক্ষামন্ত্রী হবেন। শিক্ষামন্ত্রী নতুন কোনো উদ্ভাবন নয়, তবে আপনি শিক্ষামন্ত্রী হবেন, এটা একটি মিশন ইমপসিবল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গিয়ে দেখা গেল আপনার সব গেল, সঙ্গে আপনিও। তারপরও আপনি সমস্যার সমাধান করতে পারলেন না। মাঝখানে জীবনের বাকি সময় ব্যয় করলেন একটি সমস্যার সমাধান করতে। এভাবে বিশ্বের মানুষ প্রতিদিন তার সময়ের ৯০ শতাংশ ব্যয় করে চলছে সমস্যার মধ্য দিয়ে। আমাদের ধ্যানে যে সময় ব্যয় করি, সেই সময়টুকু যদি সমস্যাযুক্ত না হয়ে মুক্ত হতো, তবে আমরা পৃথিবীকে সুন্দর ও পরিপাটি করে গড়ে তুলতে পারতাম। পারতাম নিজেদের সুখী ও সমৃদ্ধ করতে। আমরা মনে করি, প্রতিদিন যেসব কাজ করি, তার একটা ভ্যালু রয়েছে। কথা সত্য। কিন্তু ভাবুন, মূলত আমরা কী করি। যেমন আইনজীবীরা কী করেন, একজন অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় হাজির করে ন্যায়-অন্যায়ের পক্ষে বা বিপক্ষে লড়েন। যাঁরা অপরাধ করেন বা অপরাধের শিকার, তাঁরা সেটা জানেন। তারপরও আইনজীবী নিয়োগ করেন শাস্তি থেকে মুক্তি পেতে বা শাস্তি দিতে। এখন মিথ্যাকে সত্য অথবা সত্যকে মিথ্যা প্রমাণিত করা এবং সমস্যার সমাধান করা মূলত আইনজীবীর কাজ। যত খারাপ, অন্যায়, মিথ্যা, অপকর্ম, অবিচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, অনীতি কাজের পেছনে আমরা সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করি এবং এর জন্য সমাজের বলতে গেলে সব মানুষ কাজ করে। অথচ ভালো কাজের জন্য আইনজীবী, পুলিশ, বিচার কোনো কিছুর দরকার হয় না। তার মানে কী দাঁড়াল, অকাম-কুকামের জন্য মানুষ সবচেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে। অকাম-কুকাম শেখার জন্য মানুষ শিক্ষিত হয়। এর নাম সভ্যতা নাকি অসভ্যতা? যা-ই হোক না কেন, এ হলো আমাদের পৃথিবী, এ পৃথিবীর পরিবর্তন যদি সত্যিই আমরা চাই, তবে আমাদের উদ্ভাবিত হতে হবে নতুন উদ্দীপনা এবং ক্রিয়েটিভ চিন্তার মধ্য দিয়ে। শুধু সমস্যা সমাধান না করে আসুন নতুন চিন্তার উদ্ভাবন করতে শিখি।
*দূর পরবাস-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]