পার্থে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রাণের সংগঠন বাওয়া—বাংলাদেশ–অস্ট্রেলিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া। বছরজুড়ে বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসবপ্রিয় বাঙালিদের মাতিয়ে রাখে সংগঠনটি। বাওয়ার বিভিন্ন আয়োজনের মধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অন্যতম। প্রতিবছর বর্ষবরণ, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস, নাট্যসন্ধ্যার মতো বড় সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তারা। তবে বাওয়ার অন্যতম আয়োজন ‘বার্ষিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা’। প্রায় ছয় শ দর্শকের উপস্থিতিতে গান, আবৃত্তি, নাচ, নাটিকা নিয়ে ছিল মনোজ্ঞ জমাটি এক অনুষ্ঠানের আয়োজন।
প্রতিবছরের মতো এবারও বাওয়ার বার্ষিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় বাঙালিদের সমাবেশে মুখর হয় অনুষ্ঠানস্থল। তা ছাড়া এ বছর সংগঠন হিসেবে বাওয়া ৪০ বছরের মাইলফলক স্পর্শ করায় এবারের আয়োজনে একটা ভিন্ন আবেগ ছিল। দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে সবাইকে অনুরোধ করা হয় রুবি লাল রঙের পোশক পরতে।
শনিবার ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় পেনরোজ কলেজের রিক্সন থিয়েটারের পর্দা উন্মোচিত হয় আগত দর্শকদের সামনে। শুরুতেই পাঠশালা বাংলা স্কুলের খুদে শিল্পীরা পরিবেশন করে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত। সবাই এ সময় দাঁড়িয়ে দেশমাতাকে সম্মান প্রদর্শন করেন। এরপর বাওয়ার ৩৯তম বর্ষপূর্তিকে স্মরণ করে তিন প্রজন্মের শিল্পীদের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় দলীয় সংগীত ‘জগৎজুড়ে উদার সুরে’।
অনুষ্ঠানে একের পর এক দর্শকনন্দিত নাচ, গান নিয়ে মঞ্চে আসে বিভিন্ন দল ও প্রতিষ্ঠান। কোরিওগ্রাফার মিথিলা রায়ের পরিচালনায় শিশুদের দুটি দলীয় নাচ পরিবেশিত হয় নজরুলগীতির সঙ্গে ওডিসি ও আধুনিক ধারার মিশ্রণে একটি নাচ এবং ডিজনি। ইমন রাগভিত্তিক দলীয় সংগীত পরিবেশন করে ভৈরবী মিউজিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা। কত্থক নাচ নিয়ে মঞ্চে আসে পার্থের বিখ্যাত নাচের স্কুল সরস্বতী মহাবিদ্যালয়। পার্থে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের ৩০ শিল্পীর অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় ফোক ও বাউল গান। নেপালি যুগল নাচ অনুষ্ঠানে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।
কোরিওগ্রাফার জারিন লিমার পরিচালনায় দলীয় হাজং নাচ এবং দুটি পল্লিগীতির সংমিশ্রণে আধুনিক লোকনৃত্য ছিল হৃদয়গ্রাহী। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন মনোনীতা ঘোষ, রাইসা আনোয়ার, নজরুল ইসলাম, শাহেদীন শহীদ, সাইবা ও সুবাহ। অনুষ্ঠানে কিছুটা নতুনত্ব আনতে এবারই প্রথম অনুরোধের আসরে দর্শকদের অনুরোধের গান গেয়ে শোনান তাসনিমুল গালিব অমিত ও শাওলী শহীদ।
টানা তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠানে একটু হাসির খোরাক না থাকলে কেমন হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জয়জয়কারের এ যুগে জনপ্রিয় শব্দ ভাইরাল আর সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল ভুবন বাদ্যকরের ‘কাঁচা বাদাম’। এ গানের থিম নিয়ে দলীয় নাচ পরিবেশন করেন রিজয়ান ইসলাম ও তাঁর দল। এরপর দম ফাটানো হাসির খোরাক জোগাতে মঞ্চে আসেন ফারহানা আলী সুমী ও তাঁর দল নাটিকা ‘তার ছেঁড়া পোডাকশান’ নিয়ে।
অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাগত বক্তব্য দেন বাওয়া সভাপতি শাহেদীন শহীদ, সাধারণ সম্পাদক আবু সাঈদ আনোয়ার, সাংস্কৃতিক সম্পাদক স্বর্ণা আফসার ও প্রধান অতিথি ইয়াজ মুবারোকি এমএলএ। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন জগদীশ কৃষ্ণান এমএলএ, সিনেটর ফাতিমা পাইমান, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার সহ–উপাচার্য প্রফেসর অমিত চাকমা, সিটিজেনশিপ এবং মাল্টিকালচার ইন্টারেস্ট অফিসের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার সাইদ পাদসা, ইন্ডিয়ান সোসাইটির সভাপতি সতীশ নায়ার এবং নেপালি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বাসুদেব রেগমি। অতিথিদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় শিশুশিল্পীরা।
২০২২-এর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা সমাপ্ত হয় মিথিলা রায় ও অনন্যা শর্মার পরিচানায় দলীয় নাচ ‘স্বদেশ বন্দনা’র মধ্য দিয়ে। অনুষ্ঠান সেদিনের মতো শেষ হলেও প্রবাসী বাঙালিরা হৃদয়ে তখনো ভিন্ন এক অনুভূতি নিয়েই গন্তব্যে রওনা হন। দীর্ঘ দুই-তিন মাসের পরিকল্পনা ও মহড়ার শেষে সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে দর্শকদের এক টুকরো বাংলাদেশ উপভোগের আনন্দ দিতে পারার তৃপ্তি নিয়ে ফেরেন আয়োজকেরা। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন অনিন্দিতা চক্রবর্তী ও নওশিন রাজিয়া খান। অনুষ্ঠানের সার্বিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন বাওয়ার সাংস্কৃতিক সম্পাদক স্বর্ণা আফসার।
পার্থের মাটিতে বেড়ে ওঠা ১০৫ শিশু–কিশোরসহ ১৪১ শিল্পী অংশ নেয় অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্রবেশপথে জারিন জাহিদ নূপুরের পরিকল্পনায় বাওয়ার ৪০ বছরের ইতিহাস নিয়ে প্রদর্শনী। মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন তানজিব শহীদ, নাফিসা আক্তার চৌধুরী, মো. মাজেদুল ইসলাম, মো. কেফায়েত মজুমদার, মো. মান্নান মামুন, সৈয়দ মো. মারুফ। শব্দ সঞ্চালন ও আলোক প্রক্ষেপণে ছিলেন তাসলিমুল গালিব অমিত।