কাঠবাদামের আত্মকাহিনি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি এক বাদামগাছ—
মাটির ভেতর শিকড় ছড়িয়ে
চুপচাপ শুনি মানুষের কান্না।
ওরা বলে, ‘জল কমে গেছে, পৃথিবী গরম হয়ে যাচ্ছে,’
আর আমি ভাবি—
জল কমে গেলে আত্মা কোথায় যায়?
বাতাস এসে বলে, ‘তুমি তো কেবল গাছ,
তোমার কোনো অনুভূতি নেই।’
আমি হাসি, বলো বাতাস, অনুভূতি না থাকলে
আমি কেন বসন্তে ফুল ফোটাই—
মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে?
আমি তো জানি, যে ফুল ফোটে
সময়মতো,
তার রং হয় সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বল।
আমার গায়ে ছোট ছোট কাঠবাদাম ঝুলে থাকে—
মানুষ সেগুলো তুলে নিয়ে যায়,
প্যাকেট করে, বাজারে দামে বিকোয়,
বিজ্ঞাপন দেয়—‘এক মুঠো বাদামেই শক্তি।’
আমি দেখি—
ওদের শরীর বাড়ে, কিন্তু আত্মা শুকিয়ে যায়।
আমার বীজ খায়,
কিন্তু বীজের অর্থ ভুলে যায়।
আমার শরীরে রক্ত নেই, কিন্তু তেল আছে,
তেল মানে আগুনের প্রতিশ্রুতি,
আগুন মানে আত্মার কণ্ঠ।
যেখানেই রোপণ হবে,
সেখানে মাটি শুনবে এক পুরোনো সংগীত—
‘আমি আলো, আমি মধু, আমি স্মৃতির খাদ্য।’
রাতে যখন চাঁদ নামে,
আমি কথা বলি আকাশের সঙ্গে।
বলেছিলাম একদিন,
‘আমিও তোমার মতো বিশাল হতে চাই।’
আকাশ বলেছিল,
‘তুমি তো তা–ই আছ,
শুধু তোমার খোলস ভাঙলেই দেখতে পাবে।’
তখন থেকে আমি ভেতরে ভেতরে পুড়ি,
শিকড়ের রস হয়ে আত্মাকে খাইয়ে দিই,
পাতাগুলো দিয়ে লিখে যাই নীরব প্রার্থনাপত্র—
যেন আমার প্রতিটি ফুলের মতো
একটি করে ফুল জন্ম নেয় মানুষের হৃদয়ে,
যেখানে আবার বিশ্বাস জন্মাবে—
যে আত্মা আছে, আলো আছে,
কাঠবাদামের বীজ কখনো মরে না।
একদিন ঝড়বৃষ্টি হবে, বজ্রপাত হবে,
আমার ডাল ছিঁড়ে যাবে,
আগুন লাগবে গায়ে,
মানুষ বলবে, ‘আহ! গাছটা পুড়ে গেল।’
কিন্তু আমি জানি,
আমার ছাইয়ের ভেতরে আবার জন্ম নেবে এক বীজ,
যা শুনতে পাবে মহাবিশ্বের প্রথম শব্দ—
‘হও।’
আর সেই শব্দ থেকেই আবার শুরু হবে
নতুন জীবন। আমি তখন আর বাদামগাছ থাকব
না, থাকব আলো হয়ে, হাওয়ায়,
মানুষের নিশ্বাসে, থাকব এক শিশুর ভালোবাসায়,
‘মা, মা...’ ডাকে—
শ্রমিকের মেহনতে, কৃষকের মাথার ঘামে।
তুমি যদি মন দিয়ে শোনো,
একটি বাদাম ভাঙার মুহূর্তে
তুমি শুনতে পাবে—
একটি নরম শব্দ—
টিক্‌…যেন কেউ আমাকে বলছেন,
‘তুমি কি জানো, তুমি এখনো জীবিত,
তোমার খোলসের ভেতর
ঘুমিয়ে আছে এক মহাজাগতিক স্বপ্ন।’