স্মৃতির অন্তরালে কবি বন্দে আলী মিয়া

আজ থেকে ঠিক ১৭ বছর আগের ঘটনা। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। বয়স সবে আটে পড়েছে। ওই সময় আমাদের পাঠ্যবইয়ে একটি কবিতা ছিল। কবিতাটি এখানে তুলে ধরা হলো—

‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ।

মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।
আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় যেন,
মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।

সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে,
পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে।’

এর ঠিক দুই বছর পর, অর্থাৎ যখন পঞ্চম শ্রেণিতে উঠি, তখন ‘পাখি’ নামের একটি কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। এ কবিতার চরণগুলো ছিল ঠিক এ রকম—

আরও পড়ুন

‘খাঁচার দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে,
ছোট কালো পাখি উড়ে গেছে দূর নীল নভ অঙ্গনে।
শূন্য খাঁচাটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে,

খোকা বসি পাশে অশ্রুসজল চোখ মোছে বারে বারে।
একদা খোকন দূর দেশে গিয়ে এনেছিল এক পাখি,
সারা দিন তারে করিত যতন সযতনে বুকে রাখি।

ছোট কালো পাখি কুচকুচে দেহ রেশম পালক তার,
দুটি চোখে তার বনের স্বপন জাগে দূর পারাবার।

এত ভালোবাসা, এত যে সোহাগ, পোষ তবু মানে নাই,
খাঁচার প্রাচীরে পাখা ঝাপটিয়া, পথ খুঁজিয়াছে তাই।
খোকা চায় পাখি—পাখি চায় বন—স্বাধীন মুক্ত প্রাণ,
কণ্ঠে তাহার জাগে ক্ষণে ক্ষণে নীল আকাশের গান।

খোকা ভাবে মনে, এ পাখি তাহার—গান সে শোনায় তায়
জানে না তো কভু কান্না তাহার সুর হয়ে বাহিরায়।
গান শুনি তার মুগ্ধ হইয়া ভেবেছিল খোকা মনে—
পোষ মানিয়াছে, ভুলে গেছে বন—রবে সে তাহার সনে।

আদর করিয়া খাঁচার দুয়ার দিল একেবারে খুলি
মন কভু কারো বশ নাহি মানে, সে কথা গেল যে ভুলি।
সহসা পাখিটি কালো ডানা মেলি উড়ে গেল দূর দেশে,
তারি শোকে আজ খোকার নয়ন অশ্রুতে যায় ভেসে।’

সহজ–সরল ভাষায় রচিত কবিতা দুটি আমার মনে শৈশব থেকে দাগ কেটে রেখেছে। অবশ্য কবিতা দুটিকে বাস্তবিক অর্থে আত্মস্থ করতে আমাকে আজকের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। তবে একটি কথা হলফ করে বলতে পারি, শিশুদের সাহিত্যানুরাগী করার জন্য কবিতা দুটি একেবারে যথার্থ; যদিও আজকের প্রজন্মের ছোট ছেলেমেয়েরা যেকোনো ধরনের বই থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করে। মুঠোফোন, কম্পিউটার, প্লে স্টেশন কিংবা এক্সবক্সকে ঘিরে তাদের যত আগ্রহ।

উল্লিখিত কবিতা দুটি যিনি রচনা করেছেন, তাঁর নাম বন্দে আলী মিয়া। তাঁর আরও কয়েকটি কবিতা আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি অত্যন্ত সাধারণ ভাষায় কবিতা লিখতেন। তিনি তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে কোনো একটি বিষয়কে জীবন্তভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে পারতেন।

মানুষের আবেগকে তুলে আনতে পারতেন। যেমন আপনি যখন তাঁর ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতাটি পড়বেন, তখন গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ চোখের সামনে অনন্যসুন্দরভাবে ধরা দেবে। সেই সঙ্গে গ্রামের সহজ-সরল মানুষের জীবনযাত্রাকেও অবচেতন মনে একেবারে কাছ থেকে দেখতে পারবেন। ক্ষণিকের জন্য মনে হবে, আপনি বোধ হয় বাংলাদেশের কোনো এক নিভৃত পল্লিতে দাঁড়িয়ে আছেন।

ঠিক একইভাবে যাঁদের ছেলেবেলা গ্রামে কেটেছে, তাঁরাও সাময়িক সময়ের জন্য হারিয়ে যাওয়া সেই সোনালি দিনগুলোয় ফিরে যাবেন। যখন আপনি বন্দে আলী মিয়া রচিত ‘পাখি’ কবিতাটি পড়বেন, তখন কয়েক মুহূর্তের জন্য এক বালকের বেশে নিজেকে আবিষ্কার করবেন। প্রিয় পোষা পাখিকে হারিয়ে বালক শোকে ছটফট করছে। বালকের এ অনুভূতি আপনার নিজের মধ্যেও সঞ্চারিত হবে।

শুধু কবিতা নয়, বন্দে আলী মিয়া একই সঙ্গে গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কাব্যনাটক, গীতিনকশা, রূপকথা, জীবনীগ্রন্থ, ছোটদের জন্য অফুরন্ত রচনা, স্মৃতিকথাসহ অনেক বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যে এ রকম সব্যসাচী লেখক হাতে গোনা কয়েকজন, যাঁরা সাহিত্যের প্রায় সর্বক্ষেত্রে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর রচিত কাব্য ও শিশুসাহিত্য সমগ্র বাংলাকে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত করেছে করেছে।

তবু তিনি রয়ে গেছেন অনাদরে স্মৃতির অন্তরালে। আজকের দিনে আপনি দুই বাংলার কাউকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কোনো মানুষকে বন্দে আলী মিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা হয়তোবা উত্তর দেবে যে এ নামের সঙ্গে তাঁদের সে অর্থে তেমন পরিচিতি নেই। এমনকি বিভিন্ন পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিনেও খোঁজাখুঁজির পর তাঁকে নিয়ে তেমন কোনো লেখা খুঁজে পেলাম না।

কথিত আছে, বন্দে আলী মিয়ার লেখা ‘ময়নামতির চর’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত পুলকিত হয়েছিলেন। তাই তিনি বন্দে আলী মিয়ার প্রশংসা করে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই চিঠির শেষে লিখেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে তুমি আপন বিশেষ স্থানটি অধিকার করতে পেরেছ বলে আমি মনে করি।’ বিশ্বকবির ওই মূল্যায়ন সার্থক হয়।

বন্দে আলী মিয়া নতুন উদ্যমে লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। তারপরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। সাহিত্যসেবায় যাঁর অনন্য প্রয়াস উভয় বাংলাকে সার্থক করেছে, তিনি কেন আজও বড় প্রাসঙ্গিক হওয়া সত্ত্বেও অনাদরে স্মৃতির অন্তরালে রয়ে যাচ্ছেন? তিনি একটু একটু করে আমাদের সবার কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ত্রিপুরা—কোথাও তাঁকে নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হচ্ছে না। পাঠ্যপুস্তকেও খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ব্রাত্য থেকে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। পাঠকদের সুবিধার্থে কবি বন্দে আলী মিয়ার জীবনী সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম, যাতে পরবর্তী সময়ে তাঁকে নিয়ে আমাদের সবার মধ্যে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

স্বনামধন্য এই সাহিত্যিকের জন্ম পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে। অর্থনৈতিকভাবে তাঁর পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তাঁর বাবার নাম মুন্সী উমেদ আলী মিয়া এবং মায়ের নাম নেকজান নেসা। তাঁর বাবা পাবনা জজকোর্টে চাকরি করতেন। বাংলা সাহিত্যে বন্দে আলী মিয়া এক অনন্য উচ্চতায় নিজেকে আসীন করেছেন। এ জন্য তিনি সব সময় তাঁর মাকে বিশেষভাবে কৃতিত্ব দিয়েছেন। তিনি নিজে বলেছেন যে মায়ের মুখ থেকে শোনা বিভিন্ন ধরনের কল্পকাহিনি ও রূপকথার গল্প তাঁকে সাহিত্যিক হওয়ার পেছনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।

জীবনের শুরুতে প্রথাগত শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। কয়েক বছর পর বন্দে আলী মিয়া পাবনা শহরের মজুমদার একাডেমিতে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯২৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি চিত্রকলার ওপর অধ্যয়নের জন্য কলকাতায় অবস্থিত ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হন। চিত্রকলার ওপর পড়াশোনা শেষে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমি থেকে তিনি প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষাজীবনের ইতি টানেন।

ছাত্র অবস্থায় ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতায় তাঁর হাতেখড়ি হয়। তাঁর রচিত প্রথম গ্রন্থের নাম ‘চোর জামাই’। এটি মূলত একটি শিশুতোষ গ্রন্থ। ১৯২১ সালে কলকাতায় অবস্থিত আশুতোষ লাইব্রেরির প্রকাশনায় তাঁর রচিত প্রথম গ্রন্থটি বাজারে আসে। তখন তিনি কেবল নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ১৯২৯ সালে কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবনে পা রাখেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন।

বন্দে আলী মিয়ার প্রথম উপন্যাস ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। এটি ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয়। এর ঠিক এক বছর পর, অর্থাৎ ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ময়নামতির চর’ প্রকাশিত হয়। এটি তাঁকে বিশেষভাবে পরিচিতি দান করেন। এ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা পাঠকদের মুগ্ধ করেছিল। সাহিত্যালোচকদের মনেও দাগ কাটে ওই কাব্যগ্রন্থ। এভাবে তিনি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন।

তাঁর রচিত লেখা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে শুরু করে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম যে সময় উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, ঠিক ওই সময় বন্দে আলী মিয়ার উত্থান প্রমাণ করে যে সাহিত্যিক হিসেবে তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র এবং অমিত সৃজনশীলতার স্বত্বাধিকারী।
১৯৩২ সালে বন্দে আলী মিয়ার রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস ‘অনুরাগ’ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কবি বাংলাদেশে চলে আসেন। দেশভাগ কবির অন্তরে গভীর বেদনার সৃষ্টি করে।

তিনি সব সময় দুই বাংলাকে একসূত্রে গাঁথার স্বপ্ন দেখতেন। দুই বাংলার মিলন–প্রয়াসে তাঁর রচিত সাহিত্য পড়লে যেকোনো মানুষের চোখ জলে ভিজে যায়। উইকিপিডিয়াতে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। ‘ময়নামতির চর’ ও ‘অনুরাগ’ ছাড়াও তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘পদ্মা নদীর চর’, ‘মধুমতীর চর’ ও ‘ধরিত্রী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে, তাঁর রচিত অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘গোধূলি’, ‘ঝড়ের সংকেত’, ‘নীড়ভ্রষ্ট’, ‘জীবনের দিনগুলো’, ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’, ‘শেষ লগ্ন’ ও ‘অরণ্য গোধূলি’। শিশুতোষ গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত হয়েছেন। তাঁর রচিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘চোর জামাই’, ‘মেঘকুমারী’, ‘মৃগপরী’, ‘বোকা জামাই’, ‘কামাল আতার্তুক’, ‘ডাইনী বউ’, ‘রূপকথা’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘ছোটদের নজরুল’, ‘শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা’, ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’, ‘সাত রাজ্যের গল্প’ ও ‘হাদিসের গল্প’। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি কবি বন্দে আলী মিয়া ‘কিশোর পরাগ’ ও ‘জ্ঞান বার্তা’ নামের দুটি শিশুপত্রিকা সম্পাদনার কাজ করেছেন।

‘বৌদিদির রেস্টুরেন্ট’, ‘জোয়ার-ভাটা’, ‘গাধা হাকিম’, ‘উদয় প্রভাত’সহ ১৪টি নাটক বন্দে আলী মিয়া আমাদের উপহার দিয়েছেন। হাস্যকৌতুক সৃষ্টিতেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তাঁর রচিত কয়েকটি শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থ আজকের দিনেও অপ্রাসঙ্গিক নয়। কোমলমতি শিশুদের জীবন গঠন ও নৈতিকতার বিকাশে এসব জীবনীগ্রন্থ পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে। বন্দে আলী মিয়া রচিত শিশুতোষ জীবনীগ্রন্থের মধ্যে ‘হযরত আবু বক্কর’, ‘হযরত ওমর ফারুক’, ‘হাজী মহসিন’, ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’, ‘ছোটদের সিরাজদৌল্লা’, ‘বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্র বসু’, ‘মীর মশাররফ হোসেন’, ‘ছোটদের কলম্বাস’, ‘ছোটদের আব্রাহাম লিংকন’, ‘ছোটদের সোহরাওয়ার্দী’, ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘বেগম রোকেয়া’, ‘হিটলার’, ‘রাবেয়া বসরী’, ‘শরৎচন্দ্র’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ছোটবেলায় রূপকথার গল্প শোনেনি কিংবা পড়েনি—এমন মানুষ বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না; যদিও প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রূপকথার গল্পেও এসেছে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন। ছোটবেলায় দাদি কিংবা নানির কাছ থেকে অসংখ্য রূপকথার গল্প শুনেছি। কিছু কিছু গল্প সবার মনে গেঁথে যেত। এসব রূপকথায় প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত  সামাজিক ও দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যার কথা কাব্যিক ও প্রতীকী উপায়ে প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া এই ধরনের গল্পের মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে ভালো-মন্দের দিকনির্দেশনাও থাকে, যা শিশুদের চিন্তার বিকাশে সহায়তা করে। কবি বন্দে আলী মিয়া ছোটদের জন্য এমন অসংখ্য গল্পকথা রচনা করে গেছেন।

সংগীত রচনার ক্ষেত্রেও বন্দে আলী মিয়া পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। তাঁর রচিত গানের বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘কলগীতি’, ‘সুরলীলা’ প্রভৃতি। পল্লিগীতি থেকে শুরু করে দেশাত্মবোধক গান, মরমি গান, এমনকি হাসির গান—কোনো কিছু বাদ যায়নি তাঁর বই থেকে। খ্যাতিমান শিল্পীদের অনেকে তাঁর গানে কণ্ঠ ও সুর দিয়েছেন। বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য তিনি পালাগান ও নাটিকাও রচনা করতেন। সেগুলো রেকর্ড আকারে বের হলে তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

শিক্ষক হিসেবে বন্দে আলী মিয়া যেমন সুনাম কুড়িয়েছেন, ঠিক একইভাবে চিত্রকলার মধ্য দিয়েও তিনি প্রশংসা অর্জন করেছেন। গ্রন্থের প্রচ্ছদচিত্র থেকে শুরু করে তিনি পেশাদারি ছবিও এঁকেছেন অঢেল। ষাটের দশকে বন্দে আলী মিয়া প্রথমে ঢাকা ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেছেন। এ সময় তিনি ‘গল্পদাদু’ হিসেবে শিশুদের মন জয় করে নেন। ষাটের দশকে বাচ্চাদের জন্য রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সবুজ মেলা’ নামের এক অনুষ্ঠান। শিশুদের মনে বাড়তি আনন্দ সৃষ্টির লক্ষ্যে এ অনুষ্ঠানকে আরও আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ বন্দে আলী মিয়া।

তিনি শিশুদের বিভিন্ন গল্প শুনিয়ে মুগ্ধ করার চেষ্টা করতেন। যার ফলে রেডিওতে প্রচারিত ‘সবুজ মেলা’ নামের অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। তবে এত কিছু সত্ত্বেও কবি খুব একটা সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে দারিদ্র্যে। কিন্তু তারপরও তিনি কখনো সাহিত্যচর্চায় আপস করেননি। অবিরাম গতিতে চলেছে তাঁর কলম। তিনি লিখেছেন বাংলার জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে। লিখেছেন ছোটদের নিয়ে। ছোটদের মুখে হাসি ফোটানোর মধ্যে তিনি সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন।

শিশুসাহিত্যে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য বন্দে আলী মিয়া ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ শীর্ষক সম্মাননা প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে তিনি রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিশ পদকে ভূষিত হন। ১৯৮৮ সালে একুশে পদক লাভ করেন বন্দে আলী মিয়া। ১৯৯০ সালে কবিকে এ দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা হিসেবে খ্যাত স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত তিনি জীবদ্দশায় একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদকের কোনোটিই দেখে যেতে পারেননি।

বন্দে আলী মিয়ার দুর্ভাগ্য, তিনি এমন এক দেশে জন্মেছিলেন, যে দেশের মানুষ তাঁকে উপযুক্ত মূল্যায়ন করতে পারেনি। সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রে ছিল তাঁর সমানভাবে পদচারণ। তাঁর রচনা বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে যেকোনো মর্যাদাপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তাই তাঁর সৃষ্টিকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরতে হলে বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে, তাদের সবাইকে নতুন উদ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনবোধে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলো নতুনভাবে প্রকাশ করতে হবে এবং আজকের প্রজন্মের পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।

এ ছাড়া তাঁর রচনাকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এ বিরল প্রতিভা সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের সরকারকেও তাঁর সৃজনশীল কর্মকে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী যেমন সরকারিভাবে পালন করা হয়, ঠিক একইভাবে কবি বন্দে আলী মিয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের উদ্যোগ নিতে হবে। কতিপয় সড়ক, এমনকি রাষ্ট্রীয় স্থাপনাও তাঁর নামে নামকরণ করতে হবে। তাঁর রচনাবলিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের উচ্চতর গবেষণা হওয়া জরুরি।

পাবনার রাধানগরে অবস্থিত কবির বাসভবনকে ‘কবি বন্দে আলী মিয়া স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা’ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাঁকে নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বা ম্যাগাজিনে যাঁরা নিয়মিত কলাম কিংবা ফিচারধর্মী লেখা পাঠান, তাঁদের কবি বন্দে আলী মিয়ার ঘটনাবহুল জীবন ও তাঁর রচিত বিভিন্ন গ্রন্থের ওপর বিশ্লেষণধর্মী কিছু লেখা পাঠানোর জন্য অনুরোধ করব।

যত দিন বাংলা ভাষা থাকবে, তত দিন কবি বন্দে আলী মিয়া ধ্রুবতারার মতো বাংলা সাহিত্যাঙ্গনকে আলোকিত করে যাবেন। আমরা সবাই তাঁর কাছে ঋণী। বলিষ্ঠ ও সাহিত্যরসপূর্ণ লেখার গুণে তিনি আমাদের সাহিত্যকে অকল্পনীয় এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন। এক লেখায় তাঁর কৃতিত্বের খুব সামান্য অংশ তুলে ধরা যায়। তাই শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে উপযুক্ত সম্মান প্রদানের পাশাপাশি তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাভাষী সব মানুষকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।