লন্ডনে জেমস
ব্যস্ত লন্ডন নগরীর শীতের সন্ধ্যাগুলো বড্ড একঘেয়ে হয়। সারা দিনের কাজ শেষে গাড়ি, বাস, টিউবে চড়ে যে যত তাড়াতাড়ি পারে বাড়ির দিকে ছোটে, যাতে তাড়াতাড়ি আরেকটি দিনের শেষ হয়। মাথায় ছাতা থাকলে ভালো, না হলে জ্যাকেটের ক্যাপ দিয়ে মাথা বাঁচানোর চেষ্টা, এই শীতের হঠাৎ আসা বৃষ্টি থেকে।
বাংলাদেশে প্রথম জীবন কাটানো আমাদের জন্য গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাটি ছিল ব্যতিক্রম। কারণ, আমাদের কৈশোর ও যৌবনের গানের গুরু জেমস যে লন্ডনে। লন্ডনের বাংলা চ্যানেল আই অন টিভি অনেক বছর পর গুরুকে লন্ডনে উড়িয়ে এনেছে। বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাটিও আর তখন একঘেয়ে লাগে না। বৃহস্পতিবার অফিস শেষে অনেকের মতো আমাদের গন্তব্যও তা–ই লন্ডনের রয়্যাল রিজেন্সি হলের দিকে।
কনসার্টটি উইকএন্ডে না হওয়ায় ভয় ছিল, আসতে না দেরি হয়ে যায়! আর আমরা থাকি লন্ডন থেকে ৩০ মাইল দূরের এক শহরে। অফিসফেরত জ্যাম মাড়িয়ে সময়মতো পৌঁছাতে পারা সহজ কথা নয়। আমাদের আসতে আসতে এক ঘণ্টা দেরি, তবে লন্ডনে থাকা ডা. মুরাদ ভাই ও ভাবি সময়মতো এসে আমাদের জন্য জায়গা রেখে দিয়েছিলেন বলে রক্ষা, না হলে কানায় কানায় পূর্ণ এই কনসার্টে বসার জায়গা পাওয়াও কঠিন হতো।
কনসার্টটি শুরু হতে অনেক দেরি হয়। প্রথমে স্থানীয় শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশনা হয়, কিন্তু সবাই তখন জেমসের অপেক্ষায়। সারা হল যখন জেমস জেমস চিৎকারে মাতোয়ারা, তখন জেমস এলেন এবং কোনো কথা না বলেই শুরু করলেন—‘পদ্মপাতার জল’ দিয়ে।
তারপর কোনো বিরত ছাড়াই গেয়ে গেলেন তাঁর কয়েক দশকের হিট গানগুলো। দর্শকরাই যেন গাইলেন তাঁর সঙ্গে। তিনি শুধু গানের প্রথমটুকু শুরু করেন আর বাকিটা ভক্তদের কাছ থেকে শুনে নেন। এটাই তো একজন গায়কের গায়কিজীবনের সার্থকতা, যখন তাঁর গান ভক্তরা তাঁকে শোনান।
এই টিকটক, সামাজিক যোগাযোগের যুগেও জেমসকে তেমন কোথাও পাওয়া যায় না, যেন সংগীতের এক মৌন ঋষি। ভক্তদের সঙ্গে শুধু গানে গানেই কথা হয়, গানই সেতুবন্ধ করে দেয়। এই না হলে নগর বাউল! আর তাই কবি শামসুর রাহমানের লেখা ‘সুন্দরীতমা’ গানের শেষ লাইন ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব তুমি আমার’ গাওয়ার পর ভক্তদের শুধু বলে রাখেন—‘আর আমি শুধুই তোমাদের।’