আবুধাবিতে দুর্গোৎসব: আবেগ সারা বছরের, উৎসব ৫ দিনের
মানুষ হাঁটছে। একটু এগিয়ে ডানদিকে প্রবেশপথ। ভেতরে একটি পর্দা। সবাই জুতা রেখে ঠিক ঠিক ঢুকে যাচ্ছে মূল জায়গায়। এই-ই ‘স্পোর্টস হাব’। বিস্তীর্ণ জায়গায় দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা স্বাচ্ছন্দ্যে দেখছেন দেবী দুর্গার মুখ।
মহাষষ্ঠীর বিকেলের কথা। ঝিলমিল করছে প্রতিমা। ভক্তরা আসছেন। মাথা নোয়াচ্ছেন। কাঁসর, ঘণ্টা, শঙ্খ বাজছে। প্রণব চক্রবর্তী মন্ত্র পড়ছেন। প্রকৃতি পূজাময় হয়ে উঠছে।
নারী-পুরুষ কারও জন্যই দাঁড়ানোর সমস্যা নেই। ইচ্ছে করলে পাশে বেঞ্চিতে বসে পড়তে পারেন। কিংবা কার্পেট বিছানো মেঝেতে বসেও উপভোগ করতে পারেন এ অনুষ্ঠান আয়োজন। এত এত দর্শনার্থী আসছেন টেরই পাওয়া যাচ্ছে না। নিজের বক্ষে ধারণ করে খেলার এ মাঠ দুদণ্ড স্বস্তি দিচ্ছে জীবনানন্দকে। সত্যিই কি বনলতা সেন এখানে আঁচল বিছিয়ে বসা?
শুধু ষষ্ঠী কেন, দশমী পর্যন্ত প্রতিটা দিনই পুণ্যার্থীরা এসেছেন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো। এক বছরের আবেগ কিন্তু পূজা পাঁচ দিনের। বিস্ফোরণ তো ঘটবেই।
আবুধাবির অনুষ্ঠান। আয়োজনটি করে আবুধাবির সর্বজনীন দুর্গোৎসব উদ্যাপন পরিষদ। উৎসব উদ্যাপন পরিষদের হাল ধরেন দুই যোদ্ধা। সমাজের জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। সভাপতি মিলন কান্তি ধর আর সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব কান্তি দাশ। ধর্মীয় অনুশীলন সংঘগুলো ছিল কেন্দ্রে। এবারকার উৎসব উদ্যাপনের বড় চমক এর সর্বজনীনতা। শিল্পনগরী মোসাফফার ‘স্পোর্টস হাব’–এর এ মহানুষ্ঠানে রাজধানীর তাবৎ মানুষ অংশ নিয়েছেন।
দর্শনার্থী এসেছেন বাংলাদেশ ছাড়া ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা থেকে। ১০ হাজারের মতো পুণ্যার্থীর সমাগম হয়েছে। পূজা অনুষ্ঠানে চণ্ডীপাঠ করেন প্রশান্ত কুমার দাশ। জাগরণ পুঁথি পড়েন অসীমা বিশ্বাস। উদ্যাপনের সাংগঠনিক কর্মে অবদান রেখেছেন তিলক কান্তি তালুকদার।
জীবনানন্দ দাঁড়িয়ে। যেন বরিশাল লাল গির্জার সামনে। দেখছেন প্রতিমা। হার্ডবোর্ডের ওপর ছবিগুলো নিখুঁতভাবে কেটে বসানো হয়েছে। প্রকৌশলী রাজীব পাল, রঞ্জিত দেব, দেব দুলাল চৌধুরী মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন। মঞ্চ নির্মাণে ছিলেন পুলক চৌধুরী, দিলীপ দাশ, রিগ্যান দেব, প্রমোদ পাল।
দেবীপক্ষের শুরুতেই মর্ত্যলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয় দেবীকে। চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দুর্গার ধরাধামে আগমনই শুভ মহালয়া। দেবী দুর্গা প্রতিবছর মর্ত্যে আসেন তার ভক্তকুলের জন্য শক্তির বর নিয়ে। দুর্গাপূজা মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক রূপ পেলেও পূজার প্রস্তুতি মহালয়া তিথিতেই শুরু হয়। দেবী দুর্গা এদিন আসেন হিমালয়ের কৈলাস পর্বত ছেড়ে মাটির পৃথিবীতে।
পূজা চলছে। কার্তিক চক্রবর্তী, পূর্ণ চন্দ্র বণিক তত্ত্ব তালাশ নিচ্ছেন। পূজামণ্ডপের একদিকে রুমা তালুকদার অন্যদিকে আসমা শীল, কলি বৈদ্য, আর মুনমুন তালুকদার। স্বপ্না শীল নৈবেদ্য এগিয়ে দিচ্ছেন।
ঢাক-ঢোলক, কাঁসর আর উলুধ্বনিতে মুখর পরিবেশ। পুণ্যার্থীরা প্রসাদ নিচ্ছেন। মাদুর পাতা বিস্তীর্ণ জায়গাজুড়ে তাঁরা বসে আছেন। এই যে আয়োজন, এর পেছনে আছে অনেকের শ্রম। পূজার বাজার করেছেন অনুপম ধর। উপকরণ নির্বাচনে তার যে অসাধারণ দক্ষতা! অন্যদিকে চাল, ডাল, তেল, মসলা জোগাড় করাও কি এত সহজ? সাগর শীল, রুপন দাশ এই ঝামেলাগুলো কাঁধে নিয়েছেন হাসিমাখা মুখে।
শরৎকালের আয়োজন। অকালে এ পূজা দেওয়া হয়েছিল বলে এর নাম অকালবোধনবা অকালজাগরণ।
পূজার জন্য এও এক মহাযজ্ঞ। আট হাজার পুণার্থী প্রসাদ গ্রহণ করেছেন। সবজির সমন্বয়ে খিচুড়ি, বিরিয়ানি, ফল মূল আর মিষ্টির এ আয়োজন করেছেন তাঁরা। ৪০ কেজি চাল তুলে দেওয়া হয় প্রতি পাত্রে। মুখে মুখে তাঁদের হিসাব। ৩০০ মানুষের পাতে যাবে এই অন্ন। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী মিলে অনেক অনেক চাপ সহ্য করেছেন তাঁরা।
রান্নার জন্য পুরো এক দিনের সময় এবং শ্রম উৎসর্গ করেছে ‘ইসকন’। অন্য দিনে প্রিয়তোষ বৈদ্য, রাজীব সুশীল ছিলেন রন্ধন কর্মে। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন প্রমোদ পাল, পলাশ দাশ, রুবেল দাশ, বিধান দাশ, রণি দাশ, ভোলা দে। সবজি প্রস্তুতিতে তাঁদের যে কি যত্ন এবং মনোযোগ!
হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে হাঁটছেন জীবনানন্দ দাস। বারবার ভালোবেসে ফিরে আসেন নদীনালা খেতে। সেই জীবনানন্দ আজ প্রবাসী বাঙালির সঙ্গে, তাঁদের প্রাণের আয়োজনে। দেখছেন এদের কর্ম।
রূপসী বাংলার জীবনানন্দ। মনোযোগী দর্শক এক। কথা হয় তাঁর পুণ্যার্থীদের সঙ্গে। দিয়া তৃণা চৌধুরী। আল মোনা একাডেমির পরিচালক। অন্য দুজন তাঁরাও শিক্ষক। সর্বাণী ঘোষ, ইন্দ্রনীল ঘোষ। সাইনিং স্টার এবং গ্লোবাল ইন্ডিয়ান স্কুল তাঁদের ঠিকানা। মতবিনিময় হয়।
দুবাই থেকে এসেছেন তৃপ্তি মোদক, লিপি সাহা রায় এ আবুধাবিরই। প্রাণের কথা হয়। সে আলাদা এক শান্তি। পাশ ফিরতেই প্রকৌশলী সুজন পাল। সঙ্গে ইন্দিরা কলি। সৌহার্দ্যের আলাপ। চকচক করে ওঠে চারপাশ।
আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। আর অনার্য সভ্যতায় দেবী বা মাতার। এর কারণ হচ্ছে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন এবং এর কর্তৃত্ব। মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির সেই সূত্রে আজকের এ উৎসব।
এ উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আবুধাবি আল আইন দুবাইসহ সংযুক্ত আরব আমিরাতের পুণ্যার্থীদের। ধর্মীয় অনুশীলন সংঘগুলো ছিল এর কেন্দ্রে। বাংলাদেশ দূতাবাস, বাংলাদেশ স্কুল, বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ সমিতি, জনতা ব্যাংক, বঙ্গবন্ধু পরিষদকে দেওয়া হয়েছে বিশেষ মর্যাদা। সঞ্জয় শীল, ধীলন রায়, সজল চৌধুরী, প্রকৌশলী হারাধন মজুমদার, কানুলাল দাশ, বিপ্লব কান্তি দাশ ছিলেন আপ্যায়নের সঙ্গে যুক্ত।
মহানবমীতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আবু জাফরকে শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। রাষ্ট্রদূত তাঁর সম্মানে আয়োজিত পর্বে পূজা উদ্যাপন পরিষদের প্রতি গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, উৎসবের মধ্য দিয়ে অনাচার বিনাশে দেবীর ভূমিকা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনকে রাষ্ট্রদূত অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারক ও বাহক হিসেবে অভিহিত করেন।
পর্বটি সঞ্চালনা করেন প্রকৌশলী নিমাই সরকার ও সনজিৎ শীল।
জীবনানন্দ। তাঁরই নামাঙ্কিত পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে একটা লাল রঙের বাড়ি। মন্দিরঘেঁষা সে ভবন। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলে সন্ধ্যায়। মহালয়ার ওপর নাটক ‘মহিষাসুর মর্দিনী প্রশংসা কুড়ায়। ছোটদের কলকাকলিতে প্রাণময় হয়ে ওঠে চরাচর।
সামনে বাবলি ধর, উল্কা সরকার আর তানিয়া ধর। তাঁরা বন্ধুর আলাপ করছেন। ক্যামেরা জ্বলে ওঠে। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়।
জীবনান্দ কথা বলেন ছোটদের সঙ্গে। ঐশিকা, সোনিয়া, পুষ্পিতা, সিঁথি, স্বীকৃতি, প্রীতি, ডিম্পি, আমাইয়া, মিথিলা আরও বেশি সরব হয়। তারা নাচ উপহার দেয়। প্রকৃতি ওদের সঙ্গে মিশে যায়। ওই পর্বের সঞ্চালনায় কান্তা শিকদার এবং অনসূয়া বিশ্বাস তাঁদের মেধার সর্বোচ্চটি ঢেলে দেন।
প্রতিদিন মায়ের পূজা, ভোগ, সন্ধি পূজা, আরতির মধ্য দিয়ে চলেছে এ অনুষ্ঠান। আরতি পরিচালনায় ছিলেন তরুণ কান্তি নাথ, প্রসেনজিৎ শীল, রূপেশ দাশ, লিটন মল্লিক, রূপস দাশ, উত্তম দে। মাতৃমণ্ডলীর সংগঠক ছিলেন অসীমা বিশ্বাস এবং মৌসুমী বিশ্বাস। ব্রাহ্মণকে সহযোগিতা করেন হরিপদ সরকার।
স্বেচ্ছাসেবার পুরো ভাগে ছিলেন সাগর কান্তি শীল। আয়োজনকে শৃঙ্খলায় রাখতে অবদান রাখেন মন্টু সরকার, মিন্টু দত্ত, রাজু দাশ, তন্ময় দাশ, লিটন মল্লিক, সত্যজিৎ বল, জিমন শীল, সুদর্শন দাশ। কী তাঁদের ত্যাগ! চন্দন পাল, টিটন শীল, সুলাল শীল, লিটন পালিত, খোকন চৌধুরী আগলে রাখেন গোটা অনুষ্ঠান। প্রসাদ বিতরণে নিবেদিত ছিলেন স্বরূপ বিশ্বাস, লিটন ধর, জীবন পাল, সুবীর কান্তি দে, গোবিন্দ দেবনাথ, বাপ্পা বিশ্বাস।
রাজারা পূজা করতেন দিগ্বিজয়ে বের হওয়ার আগে। আবুধাবিতে অনুষ্ঠান আয়োজন উদ্যোক্তারা জিতবেন। এ প্রত্যয় তাঁদের বুকের গভীরে। তাঁরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। ঢাক এনেছেন বাংলাদেশ থেকে। একটা নয় পাঁচটা। জোড়া বেল, তাও সরাসরি চাটগাঁ থেকে। কলাগাছ, বিল্বপত্র সবই। তাঁরা অতন্দ্রপ্রহরীর কাজ করেছেন। দিলীপ দাশ, গোবিন্দ দেবনাথ, সাগর কান্তি শীল রাত্রি জেগেছেন পূজামণ্ডপকে সামনে রেখে।
অর্থ সংগ্রহে অপু দাশ এবং অনুপম ধর এগিয়েছেন ছন্দে। এ গণনায় কেউ বাদ যায়নি কিংবা কাউকে দুইবারও ধরা হয়নি। ছিল বিশাল এক বহর। তা না হলে লাখো দিরহাম আসবে কোত্থেকে? সঞ্জিত শীল, সঞ্জয় শীল, প্রসেনজিৎ শীল, রূপক বৈদ্য, রাখাল শীল, সজল চৌধুরী, কাজল বিশ্বাস, ধীলন রায়, সমীরণ চক্রবর্তী, রুপন দাশ, মনোতোষ শীল, জগদীশ শীল, বিশু দাশ, বিশ্বজিৎ মহাজন, বাসু দাশ ছিলেন আত্মনিবেদিত।
দশমী তিথি চলে আসে। মায়ের বিদায়। সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে মায়ের কাছে আশীর্বাদ নিলেন নারীরা।
পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করলেন নর–নারী সবাই। নারীরা সিঁদুরে সাজালেন একে অপরকে। মাঝে সংবাদ প্রচার। এতে প্রকাশ—মা বিদায় নিচ্ছেন খুব কাছাকাছি সময়ে। ‘আকাশ কাঁদে বাতাস কাঁদে, কাঁদছে সবার মন। উমাও কাঁদে মুখ লুকিয়ে, আজ যে বিসর্জন।’ পরাতন দাশ, ধীলন রায়, গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। এখন যে ছুটতে হবে সাগর পানে।
জীবনানন্দ দাঁড়িয়ে। সেই চার্চ, সেই গির্জা, সেই প্রার্থনা শালা। তাতে ধূসর ছাপ। পাণ্ডুলিপি কী?
করুণ সুর বাজে। মা বিদায় নিচ্ছেন।
‘স্পোর্টস হাব’ পেছনে পড়ে রয়। গৌরী সামনে এগোতে থাকেন। আবার মর্ত্য থেকে হিমালয়ের কৈলাস।