সুইডেনের খেলাধুলার শক্তি কি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ও তাদের পথপ্রদর্শককে প্রেরণা দিতে পারবে?

পোল ভল্ট হাতে একের পর এক বিশ্ব রেকর্ড গড়ছেন ডুপ্লান্টিসএএফপি

সুইডেনে ক্রীড়া শুধু একটি বিনোদন নয়; বরং এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্তম্ভ। প্রায় প্রতিটি পৌরসভায় রয়েছে ক্রীড়া ও বিনোদনের সুযোগ–সুবিধা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ, এমনকি বাণিজ্যিক খাতেও ক্রীড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে লাখো মানুষ প্রতি সপ্তাহে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন—কেউ কোচ, কেউ সংগঠক, কেউ আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দায়িত্বে। গবেষণায় দেখা গেছে, সুইডেনে মোট স্বেচ্ছাসেবা কাজের অর্ধেকই হয় ক্রীড়া ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডে।

শরীরচর্চা শুধু খেলোয়াড়দের জন্য নয়, এটি সবার জন্য। নিয়মিত ব্যায়াম আমাদের মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমায়, হৃদ্‌রোগ ও ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস করে, এমনকি ডিমেনশিয়ার মতো জটিল রোগ থেকেও রক্ষা করতে পারে। বয়স্কদের জন্য শক্তি বাড়ানো ও হাড়ের ক্ষয় রোধ করতেও ব্যায়ামের জুড়ি নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত, যারা একেবারে অচল জীবন থেকে সামান্য হলেও নড়াচড়া শুরু করে, তারাই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়।

সুইডেনে খেলাধুলা পর্যটন ও বিনোদনশিল্পেরও বড় চালিকা শক্তি। দেশের ভ্রমণ, হোটেল ও অনুষ্ঠান আয়োজনের একটি বড় অংশের সঙ্গে ক্রীড়া জড়িত। এভাবে ক্রীড়া শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সম্প্রীতিকেও সমৃদ্ধ করছে।

শুধু তা–ই নয়, সুইডেনে ক্রীড়াকে টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করার বিশেষ উদ্যোগ রয়েছে। ‘হেলথ অ্যান্ড স্পোর্ট ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক’ শিক্ষা, গবেষণা ও নীতিমালায় টেকসই উন্নয়নকে ক্রীড়ার সঙ্গে যুক্ত করছে। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল সুস্থ থাকবে না; বরং জলবায়ু পরিবর্তন ও সামাজিক বৈষম্যের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়ও প্রস্তুত হবে।

এমন পটভূমিতে সুইডেনের তরুণ প্রতিভা আর্মান্ড ডুপ্লান্টিস বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন শরীরচর্চা, প্রতিশ্রুতি আর সঠিক সহায়তা থাকলে অসম্ভব কিছু নেই। তিনি পোল ভল্টে ৬.৩০ মিটার লাফিয়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন, যা তাঁর ক্যারিয়ারের ১৪তম বিশ্বরেকর্ড। শুধু তা–ই নয়, তিনি এরই মধ্যে দুইবারের অলিম্পিক স্বর্ণপদকজয়ী, তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এবং একাধিক ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছেন। তাঁর এই অবিশ্বাস্য যাত্রা প্রমাণ করে—যদি প্রতিভা সঠিক দিকনির্দেশনা, সুযোগ ও পরিবেশ পায়, তবে বিশ্ব জয় করা সম্ভব।

‘দূর পরবাস’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

সুইডেনের খেলাধুলার শক্তি কেবল খেলা বা বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সামাজিক সংযোগ, স্বেচ্ছাসেবা, স্বাস্থ্য ও মানসিক শক্তির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। আমার কেন যেন মনে হয়েছে, বাংলাদেশ যখন এই উদাহরণ দেখবে, তারা অনুপ্রাণিত হবে। তাদেরও সুযোগ আছে নিজেদের স্বপ্ন পূরণে, সমাজের জন্য অবদান রাখতে এবং নিজের স্বাস্থ্য ও সক্ষমতা বাড়াতে।

আর্মান্ড ডুপ্লান্টিস দেখিয়েছে, সঠিক পরিবেশ, নির্দেশনা ও অধ্যবসায় থাকলে তরুণেরা বিশ্বের শীর্ষে পৌঁছাতে পারেন। বাংলাদেশেও যদি একই মানসিকতা গড়ে তোলা হয়, যেমন নিয়মিত শারীরিক চর্চা, ক্রীড়ার সংস্কৃতি, স্বেচ্ছাসেবা ও টিমওয়ার্ক, তাহলে তরুণদের পাশাপাশি শিক্ষক, পেশাজীবী, সাংবাদিক, প্রশাসন, রাজনীতিবিদসহ সব স্তরের মানুষ নতুন প্রেরণা পাবেন। তাঁরা নিজের ক্ষমতা পরীক্ষা করবেন এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবেন।

বাংলাদেশের জন্য এ অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ তরুণ ও তরুণী (১০ থেকে ৩০ বছর বয়সী)। যদি রাষ্ট্র ও সমাজ এই বিপুল তরুণ শক্তিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়, যেমন শিক্ষা, ক্রীড়া, উদ্যোক্তা ও সৃজনশীলতায় তাঁদের সুযোগ করে দেয়, তবে বাংলাদেশ হতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি।

কিন্তু এখানে একটি বড় প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা আমাদের সময় কোথায় ব্যয় করছি? রাজনীতির মঞ্চে আমরা যে বহু সময় ব্যয় করি শুধু পরনিন্দা, মিথ্যা, প্রতারণা আর প্রপাগান্ডা ছড়াতে, তার যদি মাত্র ১ শতাংশ সময় ব্যয় করতাম মাইন্ডফুলনেস, শরীরচর্চা কিংবা ভালো কিছু করার জন্য, তাহলে আজ কোটি কোটি তরুণ ও তরুণী বেকারত্ব ও হতাশার অন্ধকারে ডুবে থাকতেন না। সুইডেনেও মানুষ রাজনীতি করেন, করবেন না কেন? কিন্তু এখানে পার্থক্য হলো, দেশের রাজাও প্রতিদিন দৌড়ান। কারণ, তিনি জানেন, প্রজা তাঁর অনুসারী। নেতা যদি নিজেকে সুস্থ, সচেতন ও সক্রিয় রাখেন, জনগণও সেই অনুকরণে এগিয়ে যান।

আজ আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, শরীরচর্চা কেবল দৌড়ঝাঁপ নয়, এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গি, একটি সংস্কৃতি। এটি মানুষকে দেয় আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলা আর সৃষ্টিশীলতা। বাংলাদেশ যদি তরুণ প্রজন্মকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি দিতে পারে, তবে আমরাও বিশ্বকে দেখাতে পারব—আমাদের হাতে রয়েছে নতুন ভোরের সম্ভাবনা।