স্টকহোমের সিটি হলে সেই সন্ধ্যায়
স্টকহোমের সিটি হলের সামনে তখন এক স্নিগ্ধ সন্ধ্যা। গোধূলির আলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, আর শহরের ল্যাম্পপোস্টগুলো একে একে আলো ছড়াচ্ছে। জলরাশির ওপর প্রতিফলিত আলোর রেখা যেন একচিলতে স্বপ্নের মতো ভাসছে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ক্যামেরা হাতে, স্টকহোমের সেই মুগ্ধকর সন্ধ্যাকে বন্দী করতে। কিন্তু সেদিন প্রকৃত সৌন্দর্য আমার ক্যামেরার লেন্সে নয়, ধরা দিয়েছিল আমার হৃদয়ে।
তুমি ছিলে ঠিক আমার সামনে। সিটি হলের সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে শহরের আলো-আঁধারির মায়ায় নিজেকে যেন এক জীবন্ত স্বপ্নে পরিণত করেছিলে। বাতাসে তোমার চুলের খেলা, তোমার চোখের গভীর টান, আর সেই অদ্ভুত নীরব সৌন্দর্য আমাকে পুরোপুরি স্থির করে দিল। আমি লেন্স দিয়ে তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে অনুভব করলাম—এই দেখা কোনো সাধারণ দেখা নয়। এ যেন কোনো এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির ফিরে আসা।
হঠাৎই আমি ক্যামেরা নামিয়ে ফেললাম। এমন নয় যে ছবি তুলতে ভুলে গিয়েছিলাম; বরং মনে হলো তোমাকে লেন্সের ভেতর দেখে সেই মুহূর্তের জাদু হারিয়ে ফেলব। তুমি ধীরে ধীরে অন্যদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলে। তোমার চলার ছন্দ যেন বাতাসে মিশে এক সুর তৈরি করছিল। পেছনে সিটি হলের আলোকোজ্জ্বল স্থাপত্য আর সামনে তোমার চলার পথ—এটি এক অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। মনে হচ্ছিল, সেই পথ যেন আমার জীবনের নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। প্রশ্ন হতে পারে সিটি হল, সে আবার কি? স্টকহোম সিটি হল (Stockholm City Hall) সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের অন্যতম বিখ্যাত স্থাপত্য ও পর্যটন আকর্ষণ। এটি মেলারেন হ্রদের তীরে অবস্থিত এবং ১৯২৩ সালে উদ্বোধন করা হয়। স্থপতি রাগনার অস্টবার্গের ডিজাইন করা এই ভবনটি সুইডেনের জাতীয় রোমান্টিক স্থাপত্যশৈলীর একটি দৃষ্টান্ত।
সিটি হলের প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—
• ব্লু হল (Blue Hall): এখানে প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের নৈশভোজ অনুষ্ঠিত হয়।
• গোল্ডেন হল (Golden Hall): এই হলে মোজাইক শিল্পে তৈরি ১৮ মিলিয়ন স্বর্ণপাতের টুকরা দিয়ে স্টকহোমের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়েছে।
• টাওয়ার: ১০৬ মিটার উঁচু টাওয়ারটি স্টকহোম শহরের একটি আইকনিক চিহ্ন। এর শীর্ষে তিনটি ক্রাউন–সংবলিত প্রতীক সুইডেনের ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
স্টকহোম সিটি হল শুধু একটি প্রশাসনিক ভবন নয়, বরং এটি সুইডেনের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং আধুনিক স্থাপত্যের এক অনন্য মেলবন্ধন। এটি বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।
আমার চোখের কোণে তোমাকে বারবার খুঁজে পেতে লাগলাম। প্রতিবারই তোমার উপস্থিতি যেন আমাকে স্তব্ধ করে দিচ্ছিল। তুমি একবার আমার দিকে তাকালে, হালকা হেসে উঠলে। সেই হাসি যেন শতাব্দীর পুরোনো কোনো মায়ায় মোড়া। মনে হলো এ হাসি আমি চিনি। কোথা থেকে? জানি না।
তোমার পেছনে হাঁটতে হাঁটতে আমি যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করলাম। রাস্তার পাশের গোলাপের মিষ্টি গন্ধ আর ড্যাফোডিলের দোলন আমার মনে যেন নতুন রং ছড়াচ্ছিল। আমার মনে হলো এই পথ আমার জন্যই। তোমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রশ্ন করলাম, ‘তুমি কি জানো, এই পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?’ কিন্তু উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। সেই সন্ধ্যার প্রতিটি মুহূর্ত যেন কোনো গল্পের অমোঘ পরিণতি বয়ে আনছিল।
একসময় তুমি থেমে গেলে বাল্টিক সাগরের ধারে। পেছনের আলোর প্রতিফলনে তোমার মুখ আরও রহস্যময় হয়ে উঠল। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে তোমাকে দেখছিলাম। মনে হলো তোমার উপস্থিতি শুধু এই সন্ধ্যার নয়, কোনো চিরকালীন স্মৃতির অংশ। তোমার চোখে যেন আমি আমার নিজের জীবনের প্রতিফলন দেখতে পেলাম।
তুমি পেছন ফিরে তাকালে। তোমার দৃষ্টি আমার দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল। সেই দৃষ্টি যেন ভাষার ঊর্ধ্বে, কোনো অতীত জীবনের গভীর পরিচিতি। তোমার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠল। আর সেই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত হলাম—তুমি কোনো সাধারণ অপরিচিত নও। তুমি সেই, যাকে আমি জন্মজন্মান্তর ধরে খুঁজে চলেছি।
সিটি হলের ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি তখন পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। চারপাশ নীরব হয়ে গেল। তুমি ধীরে ধীরে সরে গেলে ভিড়ের মধ্যে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, নির্বাক। জানতাম, এই দেখা কেবল এক শুরু। হয়তো তুমি আমার সেই চিরদিনের চেনা, যার জন্য আমি এত দিন অপেক্ষা করছিলাম।
এই গল্প এখানেই শেষ নয়। কয়েক সপ্তাহ পরে সেই সিটি হলেই একটি পার্টিতে তোমার সঙ্গে আবার দেখা হলো। এবার আমাদের চোখের ভাষা ছাপিয়ে কথার ভাষা প্রকাশ পেল। আমরা কথা বললাম, পরিচিত হলাম। পরিচিতি থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হলো বন্ধন।
আজ ৩২ বছর পরও সেই সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে। মনে হয়, সেই সন্ধ্যা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সূচনা। মারিয়া, তুমি শুধু আমার সহধর্মিণী নও, তুমি আমার দুই সন্তানের মা, আমার জীবনের সারথি। তুমি আমার সেই চিরদিনের চেনা, যার জন্য আমার এই যাত্রা শুরু হয়েছিল।
সিটি হলের সামনে দিয়ে যখন হাঁটি, সেই সন্ধ্যার বাতাস, সেই ড্যাফোডিল ফুলে বাতাসের দোলন, আর সেই মুহূর্তগুলো এখনো আমাকে বলার চেষ্টা করে—আমি তো তোমার অনেক দিনের চেনা।
এ গল্পের কোনো শেষ নেই। কারণ সেই সন্ধ্যার সেই দেখা আজও আমাদের জীবনের গল্পের প্রতিটি অধ্যায়ে জীবন্ত হয়ে আছে। আসছে তোমার জন্মদিন, দেখতে দেখতে বত্রিশটি বছর একসঙ্গে কাটিয়ে দিলাম তুমি আর আমি—ভালোবাসা চিরন্তন।
দূর পরবাসে লেখা, ভিডিও, ছবি, ভ্রমণকাহিনি, গল্প ও নানা আয়োজনের কথা পাঠান [email protected]এ