যুক্তরাষ্ট্রের অফিস-আদালতে বাঙালি পেশাজীবী নারীরা
নিউইয়র্কের জ্যামাইকার বিখ্যাত বাঙালি রেস্টুরেন্ট পানসিতে প্রাতরাশের দাওয়াত দিয়েছিলেন প্রবাসী বন্ধু চিকিৎসক শামীম বেগম। পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে নিউইয়র্কে তাঁর বেশ নাম। ব্যস্ত সময় কাটে। পানসি রেস্তোরাঁ থেকে তিন মিনিট হাঁটাপথে জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের কাছে তাঁর অফিস। স্মার্ট মেডিকেল কেয়ারের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক তিনি। পাশাপাশি তিনি অফিস ফর পিপলস উইথ ডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটিসের মেডিকেল পরিচালক। বাংলাদেশ থেকে কলেজজীবনের সহপাঠী এসেছে শুনে আমার জন্য এই সময়টুকু বের করে নিয়েছেন। শামীম সপ্তাহে পাঁচ দিন রোগী দেখেন। পেশার কাজ সেরে আবার সংসার সামলাতে হয়। শুধু চিকিৎসক শামীম নন, যুক্তরাষ্ট্রের সবখানে বাংলাদেশের নারীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নানা ক্ষেত্রে।
পানসি রেস্তোরাঁয় আড্ডা দিতে দিতে এখানকার প্রবাসী বাঙালি নারীদের অবস্থান সম্পর্কে জানালেন শামীম বেগম। তিনি বললেন, ঘরে বসে গৃহবধূর মতো শুধু সংসার সামলানোর অবকাশ এখানে খুব একটা নেই। নানা রকমের রাজস্ব আর ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের কারণে বাড়তি আয়ের প্রয়োজনীয়তা সব সময় অনুভব করেন প্রবাসীরা। সবচেয়ে বড় কথা, কিছু একটা করে স্বাধীন ও সক্ষম মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাই বড় কথা।
পানসি রেস্তোরাঁয় আমাদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল হালিম। তিনি বললেন, ‘আমার অনেক আত্মীয় আছে। তারা কেউ বসে নেই। অড জব, বড় বড় বিপণনকেন্দ্রে বিক্রয়কর্মী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সরকারি–বেসরকারি কাজে ব্যস্ত তারা।
পানসিতে আমাদের আড্ডা চলার সময় নারী পুলিশের দুই সদস্য ঢুকলেন সেখানে। আমাদের পাশের সাজানো চেয়ারে তাঁরা আসন পাতলেন। তাঁদের দেখেই বোঝা গেল বাঙালি। কিন্তু বাংলাদেশি কি না বোঝা গেল না।
নিউইয়র্কের ব্যস্ত একটি এলাকায় বাঙালি চেহারার নারী পুলিশ সদস্য দেখে আমাদের কৌতূহল হয়। তাঁদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লাম। তাঁরাও প্রত্যুত্তরে হাত নাড়েন। বললাম, আমরা বাংলাদেশ থেকে। তাঁরাও ওপাশ থেকে জবাব দিলেন, আমরাও বাংলাদেশের। টেবিল পাল্টে তাঁদেরটায় চলে গেলাম কথা বলার লোভে। আলাপ-পরিচয়ে জানলাম, তাঁরা দুজনেই বাংলাদেশের গাজীপুর থেকে এসেছেন। একজন বন্যা রোজারিও, অন্যজন মরিয়ম সুলতানা। দুজনেই নিউইয়র্কের ট্রাফিক পুলিশ। বন্যা এ দেশে এসেছেন ২০১৩ সালে, মরিয়ম ১৯১৫ সালে। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দেখে তাঁরা আবেদন করেছিলেন। দুজনেই সফল হয়েছেন। ব্রুকলিন, ম্যানহাটন ও জ্যামাইকার মতো লাখ লাখ যানবাহনের একটি এলাকায় পুলিশের ইউনিফর্ম পরে দুই বাঙালি নারীকে দেখে গর্ব হলো।
নিউইয়র্কের অভিজাত আবাসিক এলাকা জ্যামাইকা এস্টেটে খালাতো ভাই আফতাব মান্নানের বাসাটি আমার এখানকার ঠিকানা। নিউইয়র্কে এলে এখানে থাকি। এ বাসাতেই দুজন পেশাজীবী নারী থাকেন। ভাবি নীলুফা বানু এবং তাঁর কন্যা রিসেল মান্নান। নীলুফা বানু একজন সিনিয়ার নার্স। রিসেল একজন ফার্মাসিস্ট, কাজ করেন সেন্ট্রাল ফার্মেসিতে। মা–মেয়ে দুজনেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি কাজে নিয়োজিত। নীলুফা ভাবিকে সপ্তাহের সাতটি দিনেই কাজে যেতে হয় হাসপাতালে। আর রিসেল যান সপ্তাহে পাঁচ দিন। এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরেও ঘরে এসে তাঁদের রান্নাঘর সামলাতে হয়। এ দেশে গৃহকর্মী পাওয়া যায় না।
লক্ষ্মীপুরের নাদিরা আকতার ফারজানা ১৮ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছেন। তিনি সার্টিফায়েড মেডিকেল বিলিং অ্যান্ড কোডিং স্পেশালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন ১০ বছর ধরে। এ পেশায় যোগ দেওয়ার আগে তিনি মেডিকেল বিলিং অ্যান্ড কোডিংয়ের ওপর এক বছরের একটি ডিপ্লোমা কোর্স করেছেন। তাঁর মূল কাজ চিকিৎসকদের বিল মেডিকেল কোডের মাধ্যমে ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে পাঠানো। সম্প্রতি ক্লেইম অ্যাডজাস্টমেন্ট বিশেষজ্ঞ হিসেবে একটি বিখ্যাত মেডিকেল ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে তাঁর। ডাউনটাউন ম্যানহাটনের ওয়ালস্ট্রিটে তাঁর অফিস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য স্নাতকোত্তর করা রওশন হাসানের অফিস ম্যানহাটনে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। তিনি সিভিল সার্ভিস হিউম্যান রিসোর্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একজন কর্মকর্তা। বাংলাদেশ থেকে ২০১০ সালে এসে উত্তর আমেরিকায় থিতু হয়েছেন। চাকরিবাকরির বাইরে বাংলা–ইংরেজি দুই ভাষাতেই সাহিত্য চর্চা করে যাচ্ছেন। কবিতা, গল্প, ছড়াও নিয়মিত অনুবাদ করছেন।
ওয়াশিংটন ডিসির ভার্জিনিয়ার থাকেন সরকারি আমলা সারোয়ার আলম (একসময়ের সাংবাদিক) ও তাঁর স্ত্রী নাজমা আলম। নাজমা আলম একসময় বাংলাদেশের চট্টগ্রামে ব্রিটিশ কাউন্সিলে চাকরি করতেন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে (ফেডারেল) কাজ করছেন। সাত বছর ধরে তিনি এখানকার ফেডারেল এজেন্সিগুলোয় কাজ করছেন। এ কাজের পাশাপাশি তিনি খণ্ডকালীন আরেকটি মজার কাজ করছেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার সন্তান বলেই এই কাজ তাঁর জন্য সহজ হয়েছে। অর্থাৎ চট্টগ্রামের ভাষা জানেন বলেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে তিনি এ কাজ করতে পারছেন। আর এ কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের দোভাষী হিসেবে তাদের কথা ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলা। এ কাজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, রোহিঙ্গাদের ভাষা আমাদের চট্টগ্রামের মতোই প্রায়। চিকিৎসক কিছু নিষেধ করলে, আইনের কথা বললে তারা প্রায় বলে, তুই হইলি অইবু না। আই পাইত্তাম নঅ (তুমি বললে হবে? আমি পারব না)। এ রকম আরও অনেক অভিজ্ঞতার কথা জানালেন নাজমা। তবে মূল চাকরির বাইরে এ চাকরি তিনি খুব এনজয় করেন। নিপীড়নে–নির্যাতনে পূর্বপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে আসা এ মানুষগুলোর জন্য কাজ করে অন্য রকম একটা আনন্দ পান তিনি। ওদের সংস্কৃতি, আচার–আচরণ, দেশ সম্পর্কে তাঁর ধারণা হয়।
নাজমা, শামীম, রওশনরা আমাদের গৌরব। দেশের সম্পদ। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস-আদালতে শোভা বাড়িয়েছে এসব পেশাজীবী নারী।
একসময়ে অন্দরমহলে অসূর্যম্পশ্যা হয়ে থাকা বাঙালি নারী আজ দেশে–বিদেশে দাপটে কাজ করে যাচ্ছেন, সক্রিয় রয়েছেন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অবদান রাখছেন। এমন খবর আমাদের প্রাণিত করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাঁরা পথপ্রদর্শক।
*লেখক: লেখক ও সাংবাদিক
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]