এই কি আমাদের বাংলাদেশ!
প্রায় ৫৩ বছর আগে ১৯৭১ সালে জর্জ হ্যারিসন গেয়েছিলেন
‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
যেখানে কত মানুষ প্রতিক্ষণে মারা যাচ্ছে’
জর্জ হ্যারিসন বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর গানটি রয়ে গেছে। তেমনি শহীদজননী জাহানারা ইমাম নেই; কিন্তু তার ছোট ছেলে, সাইফ ইমাম জামী ‘কণিকা’ ভবনটি স্মৃতি মিউজিয়াম হিসেবে সরকারের হাতে তুলে দেন। এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হতে পারে?
৫৩ বছর পরের বাংলাদেশে এমনতর খবর হাতে গোনা কটিমাত্র। কিন্তু খবরের কাগজের পাতা ভর্তি খবরে ঠাসাই থাকে। কী সেই সব খবর? আমি সাম্প্রতিক কয়েকটি খবরের হেডলাইন তুলে ধরছি।
> দোকানের কর্মচারী থেকে তিনি প্রতারণার টাকায় সাততলা বাড়ি ও ছয় ফ্ল্যাটের মালিক—সিআইডি।
> ফরিদপুরে নকল জুস তৈরির কারখানা
> এনজিও আড়ালে সমাদ্দার-কাহিনি
> ভেজাল স্যালাইন তৈরির অভিযোগে গ্রেপ্তার ৩
> একজন বড় পুলিশ কর্মকর্তার দুর্নীতির পাহাড়, এভারেস্ট উচ্চতায়
> ১০ কোটি টাকা লোপাট: অগ্রণী ব্যাংকের সেই তিন কর্মকর্তা বরখাস্ত
> দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দুই ধাপ পিছিয়ে এবার বাংলাদেশের অবস্থান দশম—টিআই
> দুর্নীতিতে ১৮০ দেশের মধ্যে ১২তম বাংলাদেশ।
দুর্নীতি নয়, কিন্তু কাজ না করা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তিনটি খবর:
১০ কর্মদিবসের মধ্যে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হবে: রাজউক চেয়ারম্যান
পুরান ঢাকার কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিগুলো সরিয়ে নিতে হবে
কালো বিড়ালের থাবা বনে।
ভাবলে অবাক হতে হয়, সাত দশক পেরিয়েও আমরা বেঁচে আছি কেন? গত সপ্তাহে কথা হচ্ছিল তপনদা ও মৃদুলদার সঙ্গে। আমরা তিনজনই দুই-তিন বছর এদিক-সেদিক। তপনদা বলছিল, আমরা বেঁচে আছি কেন?
আমাদের পরের জেনারেশন; অর্থাৎ নাতি-নাতনি ওদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি? সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ, না বিভীষিকাময়? গ্লোবালি, না ‘বাংলাদেশজ’? গ্লোবালি ভেবে কোনো লাভ নেই। তবে গ্লোবালি রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ভালোই করছে। এমনকি, অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার! বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী একটি দেশের দেউলিপনা রক্ষায় আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে। এমনকি বলিষ্ঠ দেশের দুর্যোগে ওষুধ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম দিয়ে সাহায্য করেছে এবং করছে। আমরা যাঁরা বিদেশে বসবাস করছি, আমাদের বুকটা ফুলে ওঠে।
তা ছাড়া বাংলাদেশ আয়তনে ছোটখাটো দেশ হলেও সুপারপাওয়ার দেশগুলোর সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, কিংবা জার্মানি, ভারত—সবার সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক রেখে চলেছে। প্রয়োজনে নিশ্চয় ডিপ্লোমেসি করতে পারবে।
কিন্তু দুর্নীতি? এটা কি সরকার করছে? না সরকারের কর্মচারীরা করছেন? সত্যি কথা বলতে কী, দুর্নীতি প্রতিটি দেশেই আছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও; কিন্তু দুর্নীতিটা কতটা বিস্তৃত? একটা উদাহরণ দিই। এই যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো স্থানে আমরা বসবাস করি না কেন, ট্রাফিক নিয়মটা একই রকম। আপনি ৭০ মাইল স্পিডের রাস্তায় আপনি ৮০ মাইল স্পিডে চালাচ্ছেন। পুলিশ আপনাকে থামাল এবং টিকিট দিচ্ছে ফাইন হিসেবে। আপনি ভাবলেন, কুড়ি-পঁচিশ ডলার ঘুষ দেন। সর্বনাশ। কখনো এ কাজ করতে যাবেন না। আপনাকে কোর্টে যেতে হবে এবং বেশ কিছু ডলার চলে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রে দুর্নীতি যে হয় না, তেমন নয়। সেটা কোটি কোটি ডলারের।
কিন্তু বাংলাদেশে তো ১০ টাকা থেকে শুরু করে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিটি পদক্ষেপে এবং এই ঘুষের পার্সেন্টেজ উপরিমহল কত দূর পর্যন্ত যায়? অনেক ওপর পর্যন্ত যাওয়ার কথা। কিন্তু সরকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয় না কেন? কখনো না কখনো ব্যবস্থা নেয়। এটা হয়তো একটা পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি। সে রকম অপজিশন পলিটিক্যাল পার্টি থাকলে নিশ্চয় ব্যবস্থা নিত। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, অপজিশন পলিটিক্যাল পার্টি নেই বললেই চলে।
এবার অন্য প্রসঙ্গটা; অর্থাৎ সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজটা কী? এই যেমন ধরুন, রাজউক চেয়ারম্যান কোথাও বিল্ডিং ধসে পড়লে অথবা আগুন লেগে পুড়ে গেলে প্রায়ই বলে থাকেন, এই ১০ দিনের মধ্যেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে, আপনারা কোনো কাজই করেন না অথবা করতে পারেন না। আপনাদের এই প্রতিষ্ঠান আজকের নয়? আপনাদের ১০ দিন হয়তো ১০ মাসও হতে পারে। সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কথাটি হলো আমরা সত্যিটা জানলেও প্রকাশ করতে পারি না।
তারপরের বিষয়টি হলো, পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা নিয়ে কয়েক দশক ধরেই সরিয়ে নেওয়ার কথা হচ্ছে। অতিসম্প্রতিও এ নিয়ে প্রশ্ন হচ্ছে, কবে সরানো হবে? খবর নিয়ে দেখুন, টাকার খেলা কেমন চলছে?
শেষ বিষয়বস্তুটি হলো, কালো বিড়ালের থাবা বনে। একজন সংসদ সদস্য কথাটি বলেছিলেন। বন নিয়ে কেলেঙ্কারি? বনে গিয়ে মেডিটেশন করবেন। বুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করুন। কালো বিড়ালের প্রয়োজন আছে কি? কথায় বলে, কালো বিড়াল শুভ লক্ষণ নয়। প্লিজ, আর যা-ই করুন, বন উজাড় করবেন না। তাহলে বিপদ সবারই।
পরিশেষে, আমি আবার বন্ধুর কথাতে ফিরে যাই। আমাদের প্রজন্ম মোটামুটি পার পেয়ে যাচ্ছি। বড়জোর এক দশক। কিন্তু আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, কিংবা তার পরের প্রজন্ম? আমরা কি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে পারি না? আমরা কি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করতে পারি না? আমরা কি ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে রাখতে পারি না? বিপর্যয় রোধে প্রতিটি ক্ষেত্রে একটা প্রটোকল তৈরি করতে পারি না? আমরা কি শিক্ষাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে শিক্ষিত দেশে পরিণত করতে পারি না?
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এশিয়াতে ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে না থাকলেও চিন্তার কিছু নেই। এই র্যাঙ্কিংয়ে অনেকগুলো বিষয়, যা আমাদের দেশের জন্য এতটা প্রয়োজনীয় নয়, তাই হয়তো এগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। কিন্তু আমার বিশ্বাস, প্রকৃত শিক্ষা ঠিক পথেই আছে। এসব বিষয়ে একজন দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিলেই আগামী বছর বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে উন্নীত হবে।
*লেখক: অধ্যাপক জীবন রায়, বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র
*দূর পরবাসে ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]