বছরের প্রথম দিন যেভাবে কাটে, সেভাবে নাকি বছরের বাকি দিনগুলো কাটবে। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন কাটল অঞ্জন দত্তের গান শুনে। গল্প ও গানের সঙ্গে এক অদ্ভুত সুন্দর অভিজ্ঞতা দিয়ে। আমি ধরেই নিলাম বাকি বছরটা নিশ্চয় এভাবেই যাবে।
অঞ্জন দত্তের সঙ্গে ছিলেন উনার ছেলে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী নীল দত্ত আর বিখ্যাত গিটারিস্ট অমিত দত্ত। গানের ফাঁকে তিনি গিটারের মূর্ছনায় মাতিয়ে রাখলেন।
গান গাওয়ার আগে শিল্পী শ্রোতাদের গান নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার গল্প ও গানের পেছনের গল্প বলে যাচ্ছিলেন। ‘বেলা বোস’ গানটির আবদার কনসার্টের শুরুতে আসতেই ভেসে এল অঞ্জন দত্তের বুদ্ধিদীপ্ত সকৌতুক জবাব। অডিটরিয়ামভর্তি শ্রোতা কখনো হাসছেন উনার কথায়; আবার গানের পরে তুমুল হাততালি দিয়ে শিল্পীকে ভালোবাসা জানাচ্ছেন।
আমার শোনা অঞ্জন দত্তের প্রথম গান সম্ভবত ‘শুনতে কি পাও তুমি সেই অদ্ভুত বেসুরো সুর?’
আম্মা বাংলা গান শুনতে ভালোবাসতেন। বহু বছর পর এপ্রিল মাসের এক সন্ধ্যাবেলায় গানের পরের লাইন মিলে গেল। ফিরে পেলাম শৈশবের সেই আনচান করা দুপুর। উনি নস্টালজিয়া সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। আমি নিশ্চিত দর্শক সারিতে বসে থাকা অনেকেই আমার মতো গানের সঙ্গে জীবনের মিল খুঁজেছেন। অতীতচারণা করেছেন এপ্রিলের সেই শীতল সন্ধ্যায়।
ঢাকা নিয়ে তাঁর লেখা গান ‘বেইলি রোডের ধারে আমি দেখেছি তোমায়’ যখন গাইলেন, আমার মনে হলো কাঁটাতারের বেড়া বাধা হতে পারেনি। শিল্প যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। আকাশে ঠিক সুর ভেসে আসে। কাঁটাতারের বাধা এভাবেই বিলীন হয়।
আমি অবশ্য অপেক্ষা করেছিলাম ‘খাদের ধারে রেলিংটা’ গানটার জন্য। ২০২১ সালে আমার লেখা উপন্যাসের চরিত্র রুমি অঞ্জন দত্তের গান শুনতে শুনতে ক্যালগেরি থেকে রকি মাউন্টেনের পথ ধরে যাত্রা করেছিল কানানাস্কিসের উদ্দেশে। আমি যেদিন প্রথমবারের মতো রকি পর্বতমালা দেখি, সেদিন আপন মনেই গুনগুন করেছিলাম—
‘জানালার কাচে ঠোঁট চেপে
ছবি এঁকেছি নিশ্বাসে
পাহাড় আঁকা কত সোজা
হারিয়ে গেছে সেই ড্রয়িং খাতা।’
আমি প্রথমবার সবুজ, নীল পাহাড়ের ছবি এঁকেছিলাম বান্দরবান থেকে বেরিয়ে এসে। আমার ছবি আঁকার খাতা বহু বছর আগে হারিয়েছে। অঞ্জন দত্ত তাঁর গানে মানুষের জীবনের গল্প বলে যান। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো যাপিত জীবনের ছায়া খুঁজি তাঁর গানে।
‘ম্যারি অ্যান’ গানটির সঙ্গে গলা মেলালেন দর্শক সারিতে বসে থাকা শ্রোতা–দর্শক। এরপর গাইলেন ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’।
নীল দত্ত স্মৃতিচারণা করলেন আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে তাঁর কলকাতায় সাক্ষাতের। অডিটরিয়ামভর্তি দর্শকেরা উনার সঙ্গে গলা মেলালেন ‘সেই তুমি’ গানে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম একজন শিল্পীর প্রতি আরেক শিল্পীর ভালোবাসা প্রকাশ।
‘মালা’ অথবা ‘নক্ষত্রের গল্প’ শিরোনামে একটা ছোটগল্প ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোতে। গল্পটি লিখতে বসে কতবার ‘মালা’ গানটি শুনেছি, তা গুনে শেষ করতে পারব না।
আমার কাছে সব সময় মনে হতো এই গানের মধ্যে পুরো একটা বড়গল্প আছে। তার উত্তর দিতেই বোধ করি গল্পটি লিখেছিলাম। আমি এত দিন পর যখন মালাকে নিয়ে লিখতে বসেছি, সে তখন এক আধুনিক মেয়ে। মালা নামের চরিত্রের যেমন বর্ণনা তিনি এঁকেছেন, নিঃসন্দেহে সেই মালা অতুলনীয়। মালার জবানিতে আমি উনার গানের জবাব দিলাম ছোটগল্পে।
‘তোমার জঙ্গলা পাড়ের ঢাকেশ্বরী শাড়ি
তোমার পিসিচন্দ্রের ঝুমকো কানের দুল
আজ বারোই মে তাই সকাল থেকে
জন্মদিনের তোড়া তোড়া ফুল।’
মে মাসের ১২ তারিখ আদতে মালার জন্মদিন ছিল না। ১২ মে ছিল মালার বিবাহবার্ষিকী। গানের মধ্যে জন্মদিন শব্দটি মালার জন্মদিন ছিল না; জন্মদিন ছিল কলকাতার একটি ফুলের দোকান। আমি কখনো কলকাতায় যাইনি। নানু সানন্দা পড়তেন, সেই সুবাদে পিসি চন্দ্র জুয়েলার্সের নাম শুনেছিলাম। উনি গানের মধ্যে মালা নামের এক নারীর জীবনছবি আঁকলেন নিপুণ তুলির আঁচড়ে।
‘তোমার কথা বলা যেন মধুবালা,
তোমার হাঁটাচলা সোফিয়া লরেন;
তোমার গন্ধ ফরাসি আনায় আনায়,
অভিমান অপর্ণা সেন।’
আমার পরিচিত এক কার্টুনিস্ট ১২ মে মালার একটি ইলাস্ট্রেশন আঁকলেন। তাঁকে মেসেজ করলাম, ‘জানো তো আজকে কিন্তু মালার অ্যানিভার্সারি; জন্মদিন নয়।’
আকাশলীনা নামের একটা নভেলেট ই–বুক আকারে প্রকাশের কাজ প্রায় শেষ। সেখানেও অঞ্জন দত্তের একটা গান শুনছে গল্পের এক চরিত্র। এত দিনে বুঝলাম, কেন আটকে আছে এর কাজ। শিল্পীর গান শুনলাম; গল্পের কথাও বললাম।
গল্পের চরিত্র রুমীর মতো অঞ্জন দত্ত দেখে এলেন রকি পর্বতমালা। উনি কানানাস্কিতে পাহাড় দেখে এলেন। আমাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যখন কল্পনা মিলে যায় তা অপ্রতিম। এই রকি পর্বতমালার কাছের শহরের মানুষ আবারও অপেক্ষায় থাকবেন কাঞ্চনজঙ্ঘার শিল্পীর জন্য।