তাইওয়ানে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা: প্রকৃতি, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির মিলনমেলা

তাইওয়ান—একটি ছোট দ্বীপরাষ্ট্র, কিন্তু প্রযুক্তি, প্রকৃতি এবং সংস্কৃতির দিক থেকে সমৃদ্ধ। সম্প্রতি আমার তাইওয়ান সফর ছিল একটি বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা। ন্যাশনাল তাইওয়ান নরমাল ইউনিভার্সিটিতে (এনটিএনইউ) অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের পাশাপাশি আমি প্রকৃতি, প্রযুক্তি, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন প্রত্যক্ষ করেছি।

তাইওয়ান সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাইপেইতে অবস্থিত ন্যাশনাল তাইওয়ান নরমাল ইউনিভার্সিটিতে (NTNU) ২৬-২৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত 19th International Student Conference on Science and Technology (ICAST) ২০২৪ সম্মেলনে যোগ দেওয়া। সহ-আয়োজক কুমামোটো ইউনিভার্সিটি এবং আমাদের অংশীদার প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল তাইওয়ান নরমাল ইউনিভার্সিটির উদ্যোগে এই মর্যাদাপূর্ণ ইভেন্টটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উদ্ভাবনী ধারণা এবং গবেষণা বিনিময়ের জন্য গবেষকদের একত্র করে।

আমি শুধু একজন উপস্থাপক নয়; বরং আয়োজক কমিটির সদস্য হিসেবেও সম্মেলনে অবদান রাখতে এবং সারা বিশ্বের গবেষকদের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে গভীরভাবে সম্মানিত। সম্মেলনে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নেটওয়ার্কিংয়ের ও সুযোগ হয়েছিল। NTNU-এর প্রকৌশল ও বিজ্ঞান ল্যাব পরিদর্শন ছিল সফরের অন্যতম আকর্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল ও বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি পরিদর্শন করে জানতে পারি, তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), রোবোটিকস এবং পরিবেশগত টেকনোলজির মতো ক্ষেত্রে অগ্রগামী। এই উদ্ভাবনী পরিবেশ আমার গবেষণার প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। অত্যাধুনিক গবেষণাগারগুলোতে বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের যুগান্তকারী গবেষণার সাক্ষী হওয়া ছিল এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

টিএসএমসি: আধুনিক প্রযুক্তির স্বপ্নরাজ্য

তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুবই কম। বিশ্বের শীর্ষ সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (TSMC) ভিজিট ছিল একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে মরিস চ্যাংয়ের হাতে। প্রতিষ্ঠানটির প্রযুক্তি-উন্নয়ন কার্যক্রম, বিশেষত মাইক্রোচিপ (যা আধুনিক ইলেকট্রনিক্সের প্রাণশক্তি) তৈরির উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। ২০২২ সালে তাইওয়ানের ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট রপ্তানির পরিমাণ পৌঁছায় ১৮৪ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশের সমান। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি বর্তমানে তাইওয়ান স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকের প্রায় ৩০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব করে।

এনটিএনইসি ও টিএএম: শিক্ষা এবং মহাকাশের রহস্য উন্মোচনের এক জানালা

সফরের অংশ হিসেবে ন্যাশনাল তাইওয়ান সায়েন্স এডুকেশন সেন্টার (NTSEC) এবং তাইওয়ান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জাদুঘর (TAM) পরিদর্শন আমাকে তাইওয়ানের শিক্ষা ও মহাকাশের রহস্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে। NTSEC-এর বিজ্ঞান শিক্ষার নানা উদ্যোগ। এখানে বিভিন্ন ইন্টারেকটিভ প্রদর্শনী এবং বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষামূলক কার্যক্রম রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। Taiwan Astronomical Museum (TAM) আমার সফরের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান ছিল। এটি তাইওয়ানের বৃহত্তম এবং আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জাদুঘর, যা মহাকাশ এবং তারার রহস্য জানতে আগ্রহীদের জন্য এক দারুণ স্থান। জাদুঘরের প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল প্ল্যানেটারিয়াম, ইন্টাঅ্যাকটিভ ডিসপ্লে, অ্যাস্ট্রো ফান জোন এবং টেলিস্কোপ প্রদর্শনী।

ইয়েলিউ জিওপার্ক: প্রকৃতির এক অপূর্ব সৃষ্টি

তাইওয়ানের ইয়েলিউ জিওপার্ক প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এক স্বর্গরাজ্য। ইয়েলিউ জিওপার্ক ছিল আমার ভ্রমণের অন্যতম স্মরণীয় অংশ। সমুদ্রের ঢেউয়ের প্রভাবে পাথরের গঠনে সৃষ্টি হওয়া নানা আকৃতি, বিশেষ করে ‘কুইনস হেড’ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ভাস্কর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এটি প্রকৃতির এক আশ্চর্য নিদর্শন, যা দেখলে মনে হয় যেন প্রকৃতি নিজে শিল্পী হয়ে উঠেছে।

তাইপেই ১০১: আকাশছোঁয়া স্থাপত্যশৈলী

তাইপেই ১০১, একসময় বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন, তাইওয়ানের আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর প্রতীক। ভবনটির শীর্ষে উঠে পুরো তাইপেই শহর দেখার অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই অন্যরকম। এর ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি তাইপেই ১০১-কে স্থাপত্যশিল্পের অনন্য উদাহরণে পরিণত করেছে।

তাইপেই গ্র্যান্ড মসজিদ: ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন

তাইপেইয়ের গ্র্যান্ড মসজিদ পরিদর্শন আমার জন্য বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করেছে। এটি তাইওয়ানের মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র। মসজিদের স্থাপত্য এবং শান্ত পরিবেশ আমাকে আধ্যাত্মিকভাবে স্পর্শ করেছে।

শিলিন নাইট মার্কেট: খাবার ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র

তাইওয়ান ভ্রমণ যদি নাইট মার্কেটে না যায়, তবে তা অসম্পূর্ণ। তাইওয়ানের নাইট মার্কেট সংস্কৃতি দারুণ জনপ্রিয়। শিলিন নাইট মার্কেট তার মধ্যে অন্যতম। এখানকার বৈচিত্র্যময় খাবার, যেমন হটপট, বেবিকর্ন এবং স্টিকি রাইস আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এ ছাড়া হস্তশিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাকের দোকানগুলোও বেশ আকর্ষণীয়।

উপসংহার

তাইওয়ান সফর ছিল জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং স্মৃতির এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। এখানকার মানুষদের আন্তরিকতা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রযুক্তি উৎকর্ষ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ তাইওয়ান আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ অভিজ্ঞতা আমাকে নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়েছে এবং আমি আশা করি, ভবিষ্যতে তাইওয়ান আবারও যাওয়ার সুযোগ হবে।

*লেখক: আল-আমিন, স্নাতকোত্তর গবেষক, কুমামোটো ইউনিভার্সিটি, জাপান (জাইকা স্কলার) এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট আইটি অফিসার, বিআইজিএম

**দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]