মা লতিফা আজিমকে নিয়ে পাঠশালার মা দিবসের আসরে আলোচনা ‘সাহিত্যে মা’
কানাডার টরন্টোভিত্তিক শিল্পসাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪৯তম ভার্চ্যুয়াল আসরটি ১১ মে অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব মা দিবসে (সদ্য প্রয়াত) সংগ্রামী মা লতিফা আজিম মায়ার স্মৃতিতে নিবেদিত পাঠশালার এ আসরে ‘সাহিত্যে মা’ বিশেষ করে ‘উপন্যাসে মা’ শিরোনামে মা নিয়ে লেখা এবং মায়ের লেখা সাহিত্যের সমাজতাত্ত্বিক-সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক দিক এবং বিশ্বসাহিত্যের মায়ের কোলাজে নিজেদের মাকে ঘিরে স্মৃতিনির্ভর দার্শনিক ভাবনা নিয়ে আলোচনায় করেন প্রাবন্ধিক-অনুবাদক-শিক্ষক আবেদীন কাদের ও লেখক নিজে।
বিশ্বসাহিত্যে মায়ের রূপায়ণ হয়েছে নানাভাবে ও নানা মাত্রায়। রুশ বিপ্লবের পটভূমিতে লেখা ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ (১৯০৬)-তে পাই সন্তান বিপ্লবী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মা থেকে রূপান্তরিত বিপ্লবী-কমরেড মাকে। নোবেলজয়ী ইতালিয়ান লেখক গ্রাৎসিয়া দেলেদ্দার ‘লা মাদ্রে’ (১৯২০) উপন্যাসের মায়ের জীবন পরিক্রমায় উঠে আসে মা-ছেলের সম্পর্কের নির্ভরতা-মাত্রিকতা, মায়ের ত্যাগ স্বীকার, পবিত্রতার অন্বেষণ এবং ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ও সামাজিক প্রত্যাশার মধ্যকার দ্বন্দ্ব। নোবেলজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক-মানবাধিকারকর্মী পার্ল এস বাকের উপন্যাস ‘দ্য মাদার’ (১৯৩৩) গ্রামীণ চীনের রূপান্তরিত হতে চলা সমাজে এক কৃষাণীর জীবনের মাতৃত্ব, লিঙ্গীয় ভূমিকা, পরিবার ও ঐতিহ্যকে তুলে আনে। ইতালিয়ান সাংবাদিক ও লেখক ওরিয়ানা ফাল্লাচির উপন্যাস ‘লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্ন’ (১৯৭৫) জরায়ুতে বেড়ে ওঠা এক ভ্রূণের সঙ্গে অবিবাহিত মায়ের কথোপকথন। মায়ের প্রস্থানের পরপর নিজ মাকে নিয়ে লেখা নোবেলজয়ী লেখক আনি অ্যারনোর ‘আ ওম্যান’স স্টোরি’তে (১৯৮৮) দেখা যায় মা-মেয়ের নিবিড়-দ্বান্দ্বিক বন্ধন এবং জীবনের পরিক্রমায় এর নবরূপায়ণ। মার্কিন সাহিত্যিক লুইজা মে অ্যালকটের ‘লিটল উইমেন’ (১৮৬৮) উপন্যাসে পাই উনিশ শতকের গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিবারের এমন এক মাকে যে অনটন ও আনন্দে যুগপৎভাবে তার চার কন্যাকে বড় করে এবং তাদের স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়ার প্রেরণা জোগায়।
মার্কিন লেখক হার্পার লির পুলিৎজারজয়ী ‘টু কিল আ মকিং বার্ড’ (১৯৬০) উপন্যাসে শ্বেতাঙ্গ ফিঞ্চ পরিবারের আফ্রিকান-আমেরিকান রাঁধুনি ক্যালপার্নিয়া মাতৃহারা সন্তানদের ভিন্ন পথ-মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার শিক্ষা দেয় এবং নিজেই হয়ে ওঠে মাতৃসমা। মার্কিন গৃহযুদ্ধোত্তর সময়ের পটভূমিতে লেখা মার্কিন লেখক টনি মরিসনের ‘বিলাভেড’ (১৯৮৭) উপন্যাসের পালিয়ে যাওয়া ক্রীতদাস মা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তার সন্তানদের দাসত্বে ফিরে না যাওয়ার জন্য তাদের হত্যা করার চেষ্টা করে এবং তার দুই বছর বয়সী মেয়েকে হত্যা করে নিষ্কৃতি দেয়। উনিশ শতকের মার্কিন কথাসাহিত্যিক ন্যাথানিয়েল হথর্নের ‘দ্য স্কারলেট লেটার’ (১৮৫০) উপন্যাসের মা ‘অবৈধ’ সন্তান জন্মদানের অপরাধে পিউরিটান কমিউনিটির দণ্ডাদেশ মেনে আত্মহনন না করে, হার না মেনে, নিজের ও তার কন্যার জন্য নিজের মতো করে বেঁচে থাকার পথ খুঁজে নেয়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘জননী’র (১৯৩৫) মা শ্যামার মাতৃসত্তার আত্মপ্রকাশের একপর্যায়ে তিনি খোদ অনিবার্য জননীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সন্তানের জন্য সংগ্রামের প্রয়োজনে তার চারপাশের মানুষ আর সমাজটাকে আবিষ্কার করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেশভাগ কালপর্বে লেখা কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের ‘জননী’ (১৯৬৮) উপন্যাস ‘অবৈধ’ সন্তানকে পৃথিবীতে এনে নিজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা মা দরিয়াবিবির মাতৃত্বের নানা স্বরূপ উদ্ঘাটন করে। বিশ শতকের প্রথমার্ধের ঔপন্যাসিক-নারী অধিকারকর্মী অনুরূপা দেবীর ‘মা’ উপন্যাসে তৎকালীন সমাজকাঙ্ক্ষিত আদর্শ মা, মাতৃত্বের জন্য আকুল মা ইত্যাদি নানা রূপে কয়েক মায়ের দেখা পাওয়া যায়।
সত্তরে পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর অন্যতম আলোচিত ‘হাজার চুরাশির মা’ (১৯৭৪) উপন্যাসে পরিবারের ছোট ছেলে নকশাল আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রাণ হারিয়ে লাশকাটা ঘরে ঠাঁই পেলে তার সিরিয়াল নম্বর অনুযায়ী পরিচয় পাওয়া ‘হাজার চুরাশি’র মা ছেলের মৃত্যুর পর অন্য আলোয় আবিষ্কার করে বিপ্লবী ছেলেকে এবং নিজেকেও। শহীদজননী জাহানারা ইমাম ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে (১৯৮৬) তাঁর সন্তান গেরিলাযোদ্ধা রুমীকে নিয়ে দিনপঞ্জির আদলে লিখেছেন একাত্তরের যুদ্ধগাথার ছায়ায় মা-ছেলের যূথবদ্ধতা এবং এই মা স্বাধীন দেশে হয়ে ওঠেন সব তরুণের মা। বেগম ফাতেমা বারীর নিজ সন্তান গেরিলাযোদ্ধা নৌফেলকে নিয়ে লেখা ‘শহীদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ (১৯৮৩) বইয়ে খুঁজে পাওয়া যায় আরেক শহীদজননীর জীবনের গল্প। একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরীর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘একাত্তরের জননী’ (২০১০) পাকিস্তান বাহিনীর হাতে নির্যাতিতা এক আত্মপ্রত্যয়ী-সংগ্রামী মায়ের প্রাণস্পর্শী কাহিনি। একাত্তরের গেরিলাযোদ্ধা আজাদ ও তার মা সাফিয়া বেগমের জীবনের ঘটনা নিয়ে লেখা কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘মা’ (২০০৩) প্রবল আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও সন্তানের সারথি এক মাকে তুলে ধরে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’–এর (১৯৭৬) মা পাকিস্তানি বাহিনী তার ঘরে লুকিয়ে থাকা দুই মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে এলে নিজ ‘বিশেষভাবে সক্ষম’ সন্তানকে তাদের হাতে তুলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পালাতে সহায়তা করে। সেলিনা হোসেনেরই স্মৃতিচারণার ভঙ্গিতে অকালপ্রয়াত নিজের বৈমানিক কন্যা লারাকে নিয়ে লেখা বই ‘লারা’তে (২০১৯) পাই মা-মেয়ের সম্পর্কের সাতকাহন, কখনো মায়ের জবানিতে, কখনো মেয়ের জবানিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস ‘গোরা’র (১৯১০) মা আনন্দময়ী সব জাতভেদ মাড়িয়ে জননীর ভূমিকায় উত্তীর্ণ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ (১৯২৯) ও ‘অপরাজিত’ (১৯৩২) উপন্যাসে প্রচণ্ড অভাবের সংসারে একাই লড়াই চালিয়ে যাওয়া অপু-দুর্গার মা সর্বজয়ার জীবনের নানামাত্রিক দিক উন্মোচিত হয়।
এভাবে মাতৃত্বের নানামুখী মাত্রা এসেছে বিশ্বসাহিত্যে। তবে এ কথাও সত্য, সমাজ-সময়-দেশ-কালভেদে মাতৃত্বের ধরন ও নির্মাণে অবশ্যম্ভাবী ভিন্নতা থাকলেও সমাজ-সময়-দেশ-কালনির্বিশেষে মা-সন্তানের সম্পর্কের সর্বজনীন বৈশিষ্ট্যই সবচেয়ে বেশি।
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
মা নিয়ে লেখা-মায়ের লেখার অনেকগুলো বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। লেখাগুলোর বেশির ভাগই সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। যেমন আন্না জালোমোভা এবং তার ছেলে পিওত্র জালোমভকে ঘিরে রচিত ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’। পার্ল এস বাকের ‘দ্য মাদার’ উপন্যাসের প্রটাগনিস্ট নানজিং-এ বাকের দীর্ঘ বছরের গৃহকর্মীর জীবন দ্বারা প্রভাবিত। ওরিয়ানা ফাল্লাচির ‘লেটার টু আ চাইল্ড নেভার বর্নে’র কাহিনি স্বয়ং ফাল্লাচির নিজের জীবনের ঘটনা বলে ধারণা করা হয়। আনি অ্যারনোর ‘আ ওমেন’স স্টোরি’ নিজ মাকে নিয়ে লেখা। লুইজা মে অ্যালকটের লিটল ‘উইমেন’ উপন্যাসে চার বোন ও মায়ের গল্প লেখক ও তাঁর তিন বোনের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। নিজের পরিবার, প্রতিবেশী এবং ১০ বছর বয়সে, ১৯৩৬ সালে, আলাবামায় হোমটাউনের কাছে ঘটা এক ঘটনা অবলম্বনে হার্পার লি লেখেন ‘টু কিল আ মকিং বার্ড।’ টনি মরিসনের ‘বিলাভেড’ ১৮৫৬ সালে ঘটা সত্য ঘটনার ‘আ ভিজিট টু দ্য স্লেইভ মাদার হু কিলড হার চাইল্ড’ শিরোনামে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক নিবন্ধ। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি,’ বেগম ফাতেমা বারীর ‘শহীদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ ও সেলিনা হোসেনের ‘লারা’ নিজ সন্তানকে নিয়ে লেখা। রমা চৌধুরীর ‘একাত্তরের জননী’ আত্মজৈবনিক। আনিসুল হকের ‘মা’ শহীদ আজাদ আর তার মাকে নিয়ে লেখা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়পর্বে যশোরের কালীগঞ্জ গ্রামের এক মায়ের সত্য ঘটনা অবলম্বনে সেলিনা হোসেন রচনা করেন উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’।
পাঠশালার এবারের আসরে আলোচনা হয়েছে কয়েকটি ভাগে। প্রথম ভাগে মাকে নিয়ে রচিত সাহিত্য ও মা রচিত আত্মজৈবনিক ধরনের লেখা নিয়ে আলোচনা। দ্বিতীয় ভাগে নিজেদের মাকে নিয়ে স্মৃতিনির্ভর দার্শনিক আলোচনা, তৃতীয় ভাগে সাহিত্যে মায়ের কোলাজে আমাদের মায়ের-মায়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অন্বেষণ এবং সবশেষ অংশে ছিল মাকে নিয়ে লেখা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণ।
মাকে নিয়ে রচিত-মায়ের রচিত সাহিত্য নিয়ে আলোচনায় আবেদীন কাদের বলেন, বিশ্বের কথাসাহিত্যে বা উপন্যাসে বা গল্পে মাকে নিয়ে, মা-সন্তান নিয়ে, মায়ের সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক নিয়ে লেখার চর্চা খুবই নবীন। কারণ, উপন্যাস বা কথাসাহিত্য খুব সাম্প্রতিক একটি মাধ্যম। এর আগমন শিল্পবিপ্লব-নগরায়ণ ও পুঁজিবাদের আবির্ভাবের পর। এর আগে ছিল কবিতা। কিন্তু কবিতায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা খুব একটা স্থান পায়নি। কথাসাহিত্যই প্রথম ব্যক্তিমানুষ ও সমাজের নানা দিক তুলে ধরে। ব্যক্তির মনোজাগতিক-দ্বান্দ্বিক দিক এবং ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক প্রথম পাঠক দেখতে পায় শিল্পমাধ্যম কথাসাহিত্যে। মায়ের কথা প্রথম আসে ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত হেনরি ফিল্ডিংয়ের লেখা উপন্যাস ‘টম জোন্স’–এ। বাংলা সাহিত্যে আসে উনিশ শতক থেকে।
বিশ্বসাহিত্য এবং আত্মজৈবনিক গ্রন্থে মায়ের রূপায়ণ প্রসঙ্গে আলোচনায় আবেদীন কাদের মূলত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘জননী,’ শওকত ওসমানের ‘জননী’, ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’, আনিসুল হকের ‘মা’ এবং ফাতেমা বারীর ‘শহীদ মেজবাহ উদ্দিন নৌফেল’ পাঁচটি বই নিয়ে সবিস্তার আলোচনা করেন।
আবেদীন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবীন বয়সে লেখা উপন্যাস ‘জননী’ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জননী’তে মা শ্যামাসহ অন্য চরিত্রের রূপায়ণের সঙ্গে সমাজের-সমাজচিত্রের রূপায়ণও ছিল সার্থকভাবে। শওকত ওসমানের উপন্যাস ‘জননী’ প্রসঙ্গে আবেদীন বলেন, এই উপন্যাসের মূল বিষয় কলকাতার এক মুসলিমপ্রধান এলাকার মা চরিত্র দরিয়াবিবির সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দুটি উপন্যাসের নাম এক হলেও এদের আঙ্গিকগত ভিন্নতা নিয়ে তিনি আলোচনা করেন।
আনিসুল হকের ‘মা’ প্রসঙ্গে আবেদীন বলেন, এটি জনপ্রিয় ঘরানার লেখা নিঃসন্দেহে। এর ঘটনা কমবেশি সবার জানা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঢাকায় গেরিলা গ্রুপ ‘অপারেশন ক্র্যাক প্লাটুন’–এর অন্যতম সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আজাদের (মাগফার আহমেদ চৌধুরী) মা সাফিয়া বেগম এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। আজাদের ধনী বাবা আরেকটি বিয়ে করলে দৃঢ়চেতা সাফিয়া বেগম ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। যুদ্ধে আজাদ মায়ের অনুমতি নিয়েই যায়, একপর্যায়ে গ্রেপ্তার হয়, পাকিস্তান বাহিনীর চরম নির্যাতনের শিকার হয়, তবু মায়ের প্রেরণাতেই আজাদ তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারাগারে মা-ছেলের শেষ সাক্ষাতে আজাদ ভাত খেতে চেয়েছিল, মা শুনেছিলেন ছেলে মাদুরে ঘুমায়। স্বাধীন দেশে আমরণ মা সাফিয়া বেগম ভাত না খেয়ে, খাটে না শুয়ে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শুতেন। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত হলেও পাঠকের কাছে এই লেখা কিছুটা ‘টিয়ার জার্কার’ মনে হতে পারে। অবশ্য ঐতিহাসিক উপন্যাসে এ ঘটনা বিরল না। তবে এর কাহিনির হৃদয়বিদারক ছবি পাঠককে দ্রুত টেনে নিয়ে যায়।
আসরের আলোচনার দ্বিতীয় ভাগে নিজেদের মাকে নিয়ে স্মৃতিনির্ভর দার্শনিক আলোচনায় আলোচক আবেদীন কাদের প্রথমেই কৃষিনির্ভর বাঙালি সমাজে মায়ের সঙ্গে ছেলে ও মেয়েসন্তানদের সম্পর্কের ভিন্নতার দিক তুলে ধরেন। নিজের মা সম্পর্কে বলেন, মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা অন্য ভাইবোনদের চেয়ে আলাদা ছিল। কয়েক সন্তান মারা যাওয়ার পর তাঁর জন্ম এবং সময়ের আগেই জন্মেছিলেন বলে তাঁকে নিয়ে মা শৈশব থেকেই একধরনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। ওদিকে বাবা স্কুলশিক্ষক ছিলেন বলে শিক্ষা বিষয়ে তাঁর একধরনের উচ্চাভিলাষ ছিল এবং বাবা চেয়েছেন ছেলে শহরে গিয়ে স্কুলে পড়ুক। কিন্তু মা একদমই রাজি ছিলেন না। বাবার ইচ্ছেমাফিক তিনি ১১ বছর বয়সেই গ্রাম ছেড়ে ঢাকার স্কুলে ভর্তি হন। এরপর থেকে তিনি আর গ্রামে ফিরতে চাইতেন না, আবার ঢাকা ফেরার সময় মাকে ছেড়ে আসতে কষ্ট হবে বলে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মা-ছেলের নিয়মিত চিঠি বিনিময় হতো। আমেরিকায় পড়তে আসা মনস্থির করার সময় থেকে মায়ের সঙ্গে তিনি অন্য রকম সংযুক্তি অনুভব করেন এবং মায়ের কষ্ট হবে জেনে মাকে একরকম না বলেই বিদেশ চলে আসেন। পড়াশোনা শেষে আমেরিকাতেই শিক্ষকতায় যোগ দেন। ২০১৯ সালে সিদ্ধান্ত নেন, সব ছেড়ে দেশে মায়ের কাছে ফিরে যাবেন। কিন্তু করোনাকালে আমেরিকা ছেড়ে যেতে পারেন না এবং মা মারা যান সেই সময়েই—২০২১ সালে। এ সময়টা যেন একটা দেয়ালের মতো। মা বেঁচে থাকতে আর মা মারা যাওয়ার পর মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। তিনি যে মায়ের সেভাবে একদমই কাছে থাকতে পারেননি, সে জন্য নিজেকে এখনো ক্ষমা করতে পারেন না এবং মায়ের ব্যাপারে খুব নৈর্ব্যক্তিকও হতে পারেন না। শারীরিক ও মানসিক—দুইভাবেই তিনি মায়ের বেশি কাছাকাছি। মাকে নিয়ে স্মৃতিচারণা ইত্যাদি লিখলেও কোনো কিছুই তাঁকে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দেয় না।
এবারের পর্বটি যে মায়ের জন্য নিবেদিত, তাঁর নাম লতিফা আজিম। ডাকনাম মায়া। তিনি লেখকেরই মা। মায়ের স্মৃতিতে লেখকের ভাষ্যে উঠে আসে—মায়ের জন্ম চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের সম্ভ্রান্ত পরিবারে। সেই পরিবারে শিক্ষার আবেদন ছিল, রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল। শিক্ষা সমাপনের আগেই মায়ের বিয়ে হয়ে যায় কুমিল্লার দেবীদ্বার সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক তরুণ অধ্যাপকের সঙ্গে। বাবা আনোয়ারুল আজিম। তিনি অধ্যাপনা, পাঠ আর লেখাজোখা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। কিছুকাল পর অনিশ্চয়তা, বাড়ন্ত সংসারের কথা বিবেচনায় এনে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়য়ের কর্মকর্তা। আজিমপুরের সরকারি বাসভবনে পাঁচ সন্তান নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল এই দম্পতির। লেখকের দুই বছরের মাথায় বাবার প্রস্থানে মা পাঁচ সন্তানকে নিয়ে এসে ওঠেন কুমিল্লা শহরের ঝাউতলায় শ্বশুরবাড়িতে। একসময়ের পৌর চেয়ারম্যান, ব্রিটিশ আমলের এন্ট্রান্স পাস শ্বশুর তখনো বেঁচে ছিলেন। এ সময় থেকেই শুরু হয় মায়ের সংগ্রামের জীবন। বাবার অনুপস্থিতিতে মা হয়ে ওঠেন মা-বাবা দুই–ই। পাঁচ সন্তানের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক-শিক্ষাজীবন অধ্যায়ে মায়ের অবদান, অংশগ্রহণ ও পৃষ্ঠপোষকতা উল্লেখ করার মতো। তিনি সব প্রতিকূলতার ভেতরও ছেলেমেয়েদের সর্বোচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করেছেন। এ ব্যাপারে কোনোরকম আপস করেননি। ওদিকে বাবার অকালপ্রয়াণে নানামুখী কঠিন বাস্তবতা তৈরি হলেও পরিবারের সাংস্কৃতিক অভিভাবক হয়ে ওঠেন মা। লেখকের গান থেকে শুরু করে, বিতর্ক, গার্ল গাইডস ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে মা যে শুধু উৎসাহ দিতেন, তা না, তিনি মেয়েকে রীতিমতো নিয়ে যেতেন চট্টগ্রাম-ঢাকায় বিভাগীয়-জাতীয় সংগীত প্রতিযোগিতায়, কখনো টিভির অডিশনে, টিভির রেকর্ডিংয়ে ইত্যাদি। কঠিন আর্থিক বাস্তবতায়ও মেয়েকে ওস্তাদ রেখে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গান শিখিয়েছেন। ওয়াহিদুল হকের কাছে প্রতি সপ্তাহান্তে কুমিল্লায় গানের ক্লাসে মেয়ের যোগ দেওয়ায় ছিল মায়ের পুরো সমর্থন। শুধু পড়াশোনার ব্যাপারটা নিশ্চিত করলেই আর বাকি সবকিছুতে মায়ের উদার সমর্থন মিলত। টরন্টোর ‘পাঠশালা’র জন্ম থেকেই মা ছিলেন এর শুভার্থী।
সামরিক জান্তাবিরোধী আশির দশকব্যাপী আন্দোলনে লেখকের ভাইরা ছিলেন প্রচণ্ড সক্রিয়। সে সময় নানান সভা-সমাবেশে গণসংগীত গাইতে শামিল হতেন লেখকও। মা কখনোই সন্তানদের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বাসাতেই সভা হয়েছে, সাংস্কৃতিক আয়োজনের মহড়া হয়েছে। বাসায় রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় নেতা-নেত্রী এলে মা নিজেই রেঁধে সবাইকে খাইয়েছেন।
মা ছিলেন সন্তানদের সব উদ্যোগ-প্রয়াসের প্রথম পর্যবেক্ষক, সাক্ষী এবং অংশগ্রহণকারী। কুমিল্লার ঝাউতলায় লেখকের পারিবারিক ভবন ‘অজন্তা’র বেজমেন্টে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘লিংকবাংলা’ গড়ে তোলার পেছনে ছিল মায়ের উদার সমর্থন। শুধু তা–ই নয়, ‘লিংকবাংলা’র সব কর্মকাণ্ডে-প্রদর্শনীতে মা নিজে এসেছেন, উদ্বোধন করেছেন, দর্শক-উপভোগকারী হয়েছেন।
লেখকের জীবনের বিভিন্ন মাইলস্টোন পর্বগুলোতে মায়ের ছিল খুব শক্তিশালী-প্রত্যক্ষ ভূমিকা। মা ছিলেন অর্গানিকেলি, খুব অনায়াসভাবে একটা মিনিমাল সত্তা—প্রসাধনে, পরিধানে, জীবনযাপনে, রন্ধনে, সূচিকর্মে। তিনি আজীবন বিলাসিতার আবর্জনামুক্ত মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দারুণ ‘অর্গানিক মিনিমালিস্ট’। তাঁর ধর্ম ছিল ঘোমটাময়-মৃত্তিকালগ্ন লোকজ ইসলাম যেখানে কোরআন তিলাওয়াত আছে, সুরের আহ্বান আছে, অন্য অনেক কিছুর বাড়াবাড়ি নেই। তিনি ছিলেন জীবনচর্চায় আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। মা কেমন করে এতটা মুক্ত, অসাম্প্রদায়িক-মিনিমাল-মানবিক সামর্থ্যে ভরপুর ছিলেন, এর সমাজতাত্ত্বিক অন্বেষণ করা যেতে পারে। মায়ের মিনিমাল জীবন নিয়ে শিক্ষণীয় তথ্যচিত্র নির্মিত হতে পারে।
মা মাঝেমধ্যেই নীরব সময় কাটাতেন। কাটিয়েছেন প্রস্থানের কয়েক দিন আগেও। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই মা চলে গেছেন। সারা জীবন তিনি যে আত্মনির্ভরতার সঙ্গে, সম্মানের সঙ্গে বেঁচেছেন, প্রস্থানেও তিনি কারও ওপর আর্থিক বা কোনোরকম ভার বা ন্যূনতম চাপ রেখে যাননি। মা শিখিয়ে গেলেন প্রস্থানই সত্য। কিন্তু তা এত অবিচ্ছেদ্য আর মায়ার বাঁধনে জড়ানো, তা ভাবা যায়নি আগে কখনো। মায়ের প্রস্থান আবার মৃত্যুর সত্যতা শিখিয়েছে। মায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে পরিবারের উদ্যোগে পারিবারিক ভবন ‘অজন্তা’র প্রবেশ করিডরে স্থাপন করা হয়েছে কোলাজ মাধ্যমে শিল্পী জোনায়েদ-জানভী নির্মিত ম্যুরাল ‘মায়ার ভুবন’।
এ পর্যায়ে লতিফা আজিম মায়া যখন ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫), তাঁকে নিয়ে তাঁর বড় ছেলে মনজুরুল আজিম পলাশের লেখা ‘আম্মা’ কবিতাটি পাঠ করে শোনানো হয়।
আসরের আলোচনার তৃতীয় ভাগে সাহিত্যে মায়ের কোলাজে আমাদের মায়ের-মায়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অন্বেষণ পর্বে আবেদীন কাদের বলেন, কথাসাহিত্যে-নাটকে-কবিতায় মায়ের যে রূপায়ণ, তাতে দেখা যায় সন্তানের বেলায় মায়ের চরিত্রটা একদমই ভিন্ন। বিভূতিভূষণের উপন্যাস বা সত্যজিতের চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’ বা ‘অপরাজিত’–এর সংগ্রামী মা সর্বজয়া চুরি করতে পারে বা মানিকের শ্যামা কখনো কোন অপকর্ম করতে পারে, তা পাঠকের কল্পনায়ও আসবে না। কিন্তু সাহিত্যে আমরা দেখি মায়েরা কঠিন বাস্তবতায় সন্তানকে খাওয়াতে খাবার চুরি পর্যন্ত করে এবং পাঠক তা দেখে এক চরম মানবিক মাত্রার প্রকাশ হিসেবে।
আসরের আলোচকদের আলোচনায় দর্শক-শ্রোতা পুরোটা সময় মন্তব্য করে সক্রিয় থাকেন। (সদ্য প্রয়াত) লতিফা আজিম মায়াসহ সবার মায়েদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানিয়ে সমাপ্তি টানা হয় পাঠশালার ৪৯তম আসরের।