মেয়ের স্কুলে প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাবা

ছবি : সংগৃহীত

মেয়ের স্কুলে প্রথমবারের মতো প্রবাসী বাবা। মুনতাহিনা জাহান—আমার মেয়ে, তার জন্মের পর থেকে বাবাকে তেমন কাছে পায়নি। আমার আট বছর ধরে দেশে যাওয়া হয়নি। এর মধ্যে অবশ্য তারা ভিজিট ভিসায় সৌদি আরব এসে কিছুদিন থেকে গেছে। সব মিলিয়ে আমার কন্যা তার প্রবাসী বাবাকে কাছে পেয়েছে মাত্র ৯ মাস। এখন তার বয়স ৯ বছর! প্রবাসজীবনের এই ইতিকথা, এই সব দিনরাত্রি প্রায় প্রত্যেক প্রবাসীর নিয়তি।

আট বছর পর আমার দেশে যাওয়া। প্রথমবার মেয়ের স্কুলে যাওয়া। মুনতাহিনা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী, তার ক্লাস তখনো শুরু হয়নি। আমাকে এক স্যারের কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, ‘আমার বাবা।’ আমার চোখে তখন জল টলমল করছিল, যেখানে আমার স্যারকে বলার কথা, আমার মেয়ে মুনতাহিনা! প্রবাসী বাবারা দেশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অধিকাংশ সময়ই দীর্ঘ বিরতির নিয়তিতে সন্তানের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এ অশ্রু আসলে বেদনা ও আনন্দের যৌথ অনুভূতি।

সেই ক্লাস টিচার আমাকে অফিসে গিয়ে বসতে বলেন। আমি অফিসের দিকে রওনা হলাম। মেয়েকে বললাম, আসো, বাবা। তার হাতে ছিল খাওয়ার কিছু একটা। আমি গেটের সামনে থেকে তাকে ডাকছি, মুমতাহিনা না এসে একটু দূরে চলে গেল। আমি দাঁড়িয়ে খেয়াল করলাম, সে তার হাতের খাবারটি খেয়ে তারপর অফিসের ভেতরে এসেছে। আমার কন্যার এ সামান্য কাজটিও আমার খুবই ভালো লেগেছে। প্রবাসী বাবাদের সন্তানের সবকিছুই ভালো লাগে!

কিছু সময় অফিসে কথা বলে বিদায় নেওয়ার সময় সিএনজিচালিত গাড়ির কাছাকাছি আসে মুনতাহিনা। গাড়িতে বসে ছিল তার ছোট ভাই মুসতাকিম। সে এখনো স্কুল যাওয়া শুরু করেনি। তার হাতে ১০০ টাকা ছিল। নিজের টাকা! আপু দিয়ে দিয়েছে কিছু খেতে। বন্ধন!

প্রবাসী বাবাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠা, স্কুলের খোঁজখবর নেওয়া মন চাইলেও হয়ে ওঠে না। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও খুব কম প্রবাসীর ভাগ্যে জোটে দেশে যাওয়া। অধিকাংশই আমার মতো।

ছবি: সংগৃহীত

উন্নত জীবনের আশায় বাইরে পড়ে থাকা প্রবাসীদের সন্তানেরা বেড়ে ওঠে বাবার আদরবিহীন মায়ের আঁচলে। প্রবাসে সুখের আশায় রক্তের বাঁধনের মানুষদের পেছনে রেখে কষ্ট আর হাহাকার নিয়ে সুখের আশায় এ দৌড়ঝাঁপ দিতে দিতেই আমাদের জীবন নিভে যায়।

আট বছরে মাত্র এক মাস দেশে, ছুটি শেষে ফিরে এসেছি নিজ কর্মস্থল জেদ্দায়। নিজের মা-বাবা আর সন্তানদের ও তাদের মায়ের কথা বারবার মনে পড়ে। যখন আকাশে বিমান ওড়ে, আবারও চলে যেতে মন চায়। কিন্তু অল্প বেতনের চাকরি করা ছেলেটি উড়তে পারে না, কেবল চেয়ে থাকে—কবে মাস শেষ হবে, বেতন হাতে পাবে, বছর কবে শেষ হবে, দেশে যাবে।

প্রবাসজীবনে আজ পর্যন্ত অনেক চাহিদাই আল্লাহ পূরণ করেছে। একটাই কমতি ছিল, পরিবারের সঙ্গে দৈনন্দিন সময় বিভিন্ন উদ্‌যাপন উপভোগ করে কাটানো। সেটাও কিছুটা পূরণ হয়েছে। পরিবার ছেড়ে ছয় হাজার মাইল দূরে মরুর দেশ সৌদি আরবে এসেছি এক যুগের বেশি সময়। চলছে জীবন নামের আশায় প্রবাসজীবনের রেলগাড়ি। অতিসম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সর্বজনীন পেনশন স্কিম সেই আশার প্রদীপকে রঙিন করেছে। প্রবাসীদের সর্বজনীন পেনশন স্কিম সফল হোক।