সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের ডায়ালাইসিস ফান্ডরেইজিং অনুষ্ঠানে আমরা
সময়টা ২০০৮ সালের এক বিকেল, আমেরিকার স্যানহোসে শহরের স্ট্যানফোর্ড অ্যাফিলিয়েটেড কাইজার পার্মানেন্ট হাসপাতালে আমি রেসিডেন্সি করছি। ডা. গেস্ট নামক একজন নেফ্রোলজির ডাক্তারের সঙ্গে রোটেশন। আউট পেশেন্টের রোগী আসছে, এর মধ্যে এক রোগী আসেননি সেদিন। অপেক্ষার সময়টুকুতে ডা. গেস্ট জানতে চাইলেন, কিসে ফেলোশিপের ইচ্ছা ফারহানা? বললাম, রেসিডেন্সি শেষ করে আমি চাকরি করব। বাচ্চা ছোট, ওদের সময় দিতে চাই। তিনি হাসলেন, বললেন কোন দেশ থেকে এসেছ বলো তো? বললাম, বাংলাদেশ। তিনি অবাক চোখে তাকালেন। বললাম, শুদ্ধ উচ্চারণে ঢাকা থেকে এসেছি? তুমি আগে বলবে না? আমি তো পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস প্রথম চালু করেছিলাম ঢাকায়। কত সুন্দর স্মৃতি আছে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন গেছ আমার দেশে? তিনি বললেন, কিডনি কাজ না করলে মানুষের কী কষ্ট! প্রযুক্তি শেখাতে গেছি, যাতে তোমার দেশের মানুষ সুস্থ থাকে। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম ওনার কথাগুলো। কোথায় ছিলেন, কার কার সঙ্গে কাজ করেছেন ইত্যাদি। মানুষের মহানুভবতা আমাকে মুগ্ধ করে।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড ২০২৫ সালে সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার একঝাঁক অ্যানথুসিয়াস্টিক ডাক্তারদের সঙ্গে আমি হোয়াটসঅ্যাপে একটা গ্রুপে জড়িত। সেদিন দেখলাম, সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন বাপ্পা মজুমদারকে আনছেন, ফান্ড রেইজ করবেন দেশে গরিব রোগীদের ডায়ালাইসিস–সেবা দেওয়ার জন্য। জানতে চাইলাম, ফাউন্ডেশন সম্পর্কে। ডা. লতা আপু লিংক শেয়ার করলেন। জানলাম, দেশের বহু জেলায় ওনারা ডায়ালাইসিসসহ (বেসরকারি সবচেয়ে বড় ডায়ালাইসিস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান) স্বাস্থ্যসেবা দেন, বাচ্চাদের পড়াশোনায় বৃত্তি দিয়ে সাহায্য করেন ইত্যাদি। তাঁদের আল্টিমেট গোল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে রিসার্চসহ হাসপাতাল হবে, মেডিকেল কলেজ হবে বিশ্বমানের, যাতে রোগপ্রতিরোধ, প্রতিকার, ল্যাব টেস্টসহ আধুনিক টেকনিক শেখানো হবে মানুষের সেবায়। বাপ্পা মজুমদার গায়ক হিসেবে আমার ভীষণ প্রিয়, কিন্তু সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের ফান্ড রেইজিংয়ের কারণগুলো আমাকে মুগ্ধ করেছে। বন্ধুরা আগে টিকিট করেনি, ডা. ঝিমলি আপুকে বললাম, আপু জানালেন ব্যবস্থা হয়েছে টিকিটের। তোমার বন্ধুরা ভেন্যুতে গিয়ে টিকিট পেয়ে যাবে। লতা আপু জানালেন, আমরা ২২ নম্বর টেবিলে একসঙ্গে বসতে পারব।
আজকে এখানে রোববার দুপুর। আমরা তিন বান্ধবী (মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা তিনজনই ফারহানা) রওনা দিলাম লুক্সর ব্যানকুয়েট হল, বুয়েনা পার্কের কাছে। গিয়ে দেখলাম, চমৎকার আয়োজন, পার্কিংয়ে একটু সমস্যা, আয়োজনে ব্যস্ত স্প্যানিশ ভদ্রলোক ওদের গাড়ির পেছনে বন্ধুর গাড়ি পার্ক করতে দিলেন।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ভেন্যুতে পৌঁছে দেখি. ডা. নওশিন আপু বসা আমাদের টেবিলে, এরপর ডা. রুবি আপু , ঝিমলি আপু, আমার মেডিকেলের বৈশাখী আপুসহ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের অনেকে আছেন। এই কাউন্টির কাউন্সেল মেম্বার লামিয়া হক এসেছেন, যিনি বাংলাদেশি ডিসেন্ট, স্মার্ট ও অমায়িক। ছবি তুলেছি আমরা, শেয়ার করলাম।
এরপর জানলাম, সোনার বাংলা ফাউন্ডেশনের জন্মলগ্নের কথা। দেশের অনেক জেলায় ডায়ালাইসিস–সেবা তখন নেই। কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষ কৃত্রিম রক্ত পরিশোধনের এই সেবা পাচ্ছেন না। ফান্ড রেইজিং, প্রযুক্তি, মেশিনসহ বিশেষজ্ঞ টিম আমেরিকা ও বাংলাদেশের কোয়ালিশনে শুরু করলেন এই সেবা। এখন দেশের ২৩টি জেলায় এ সেবা আছে, সঙ্গে আছে নার্সিং স্কুল। ২০২৬–এর মাঝামাঝি মহাখালীর করোনা সেবার হাসপাতালে ৫০ বেডের ডায়ালাইসিস ইউনিট চালু হবে। হচ্ছে ল্যাব টেস্ট, ফলোআপসহ সব সেবা। দেখলাম এই অগ্রযাত্রার পথিকৃৎ সবাইকে। ডা. গেস্টকে ছবিতে দেখলাম, জানলাম উনি আর নেই, ভিডিও বার্তা দিতে দেখলাম আমার মেডিকেলের প্রাক্তন ছাত্র ডা. ইমরুল কায়েস ভাইকে। জানলাম, অতি আধুনিক হাসপাতাল, রিসার্চ সেন্টার হবে দ্রুতই।
ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালকে চিনলাম (পাশে বসা বুয়েটিয়ান বন্ধু পরিচয় দিল ওনার, বহু বছর ধরে সৎ দেশপ্রেমী কর্মী হিসেবে যাঁর সুখ্যাতি আছে), যাঁরা বহু দূরে থেকেও দেশকে ধারণ করেন হৃদয়ে। বায়োটেক প্রযুক্তি দেশে নেবেন উন্নত মেমোগ্রাম মেশিন, যা ব্রেস্ট ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে সহায়তা করবে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ক্যানসার সেল ডিটেক্ট করবে অনেক অ্যাকুরেটলি, অযথা বায়োপসির ঝুঁকি কমাবে। আর্টারির ক্যালসিফিকেশন হৃদ্রোগের ঝুঁকি কেমন, জানাতে পারবে।
ফান্ড রেইজিং হয়েছে ৩ কোটি ২৫ লাখ, এস্টিমেশনের বেশি। দেশের মানুষগুলো অনেক ভালো থাকবেন এই সেবা পেয়ে।
রাত ১০টায় বাপ্পা মজুমদার এলেন। অসাধারণ গায়কি, মুগ্ধ হয়ে গানগুলো শুনলাম, তারপর নীড়ে ফেরার পালা। কন্যা মা আর বাবাটা দেখি টেক্সট দিয়ে রেখেছে, কখন আসবে বাসায়, মা?
টিল নেক্সট টাইম বাপ্পা
‘দিন বাড়ি যায় চড়ে পাখির ডানায়
যদি না হয় কথা, জমে নীরবতা…
আমার এ নোঙর বাধাঁ
তোমার ওই সে সীমানায়
যেতে পথে আজ এইটুক বলি
যত দূরে যাই , জানি না তো কবে
জেনে রেখ শুধু ফের দেখা হবে।’