বিশ্বকাপের দরবার
বিশ্বকাপের আসর দুই দশক বা ২০ বছর পর এশিয়ার কাতারে অনুষ্ঠিত হলো অনেক বিবাদ, বিতর্ক ও জিজ্ঞাসাচিহ্ন রেখে। এ বিশ্বকাপের আয়োজন কাতার ১০ বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে, শুধু এই বিশ্বকাপের আসরকে মসৃণ, নিখুঁত, মর্যাদাসম্পন্ন ও স্মরণীয় করে বিশ্বের ক্রীড়া অঙ্গনের দরবারে তুলে ধরতে সুপ্রয়াসের অভাব ছিল না।
২২তম এ বিশ্বকাপের আসর সত্যি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে রাউন্ড লিগ, কোয়ার্টার ও সেমিফাইনাল রাউন্ড, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থান নির্ধারণকারী চিত্তাকর্ষক খেলার উপস্থাপনায়।
এশিয়ার দেশগুলো নজিরবিহীন খেলার চমক ছিলই, নামীদামি দেশগুলোর সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার স্কিল, ইচ্ছা ও মনোবাসনা দেখে। আমাদের মহাদেশে দীর্ঘ দুই দশক পর ফুটবলের সেরা আসর আয়োজিত হওয়ায় যারপরনাই রোমাঞ্চিত, আপ্লুত। ফিফাকে ধন্যবাদ, এ ধরনের আসর আমাদের মহাদেশে আয়োজনের মস্ত বড় সুযোগ দেওয়ার জন্য। এ মহাদেশে বিশ্বকাপের মতো মহাযজ্ঞের আসর আয়োজিত হওয়ায় এশিয়ার দেশগুলোর কাছে সুযোগ এসেছিল নিজেদের সেরাটা তুলে ধরতে, তুলে ধরতে চেষ্টা করেছে জাপান, সৌদি আরব তাদের ম্যাচের প্রতিদ্বন্দ্বী অভিমুখ থেকে।
মরক্কো তাদের উন্নত ক্রীড়া নিপুণতা প্রদর্শন করে আজ চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে এ বিশ্বকাপে। লুকা মদরিচের ক্রোয়েশিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত থেকেও তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে।
ট্র্যাজেডি নায়কের ভূমিকায় ফ্রান্সের এমবাপ্পে দলের জন্য হ্যাটট্রিক করেও শেষ রক্ষা করতে পারলেন না এই ফাইনালে। তাঁর ক্লাব সতীর্থ লিওনেল মেসির কাছে তাঁদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হলো। ট্র্যাজেডি নায়কদের কেউ মনে রাখে না, শুধু ইতিহাস লিপিবদ্ধ থাকে পাতায়। নায়ককে সভ্যতা মনে রাখে, পূজা করে, বীরের সম্মান দেয়, যা মেসি তাঁর দেশ, তথা বিশ্বদরবারে আজ সমাদৃত হচ্ছেন। দেশের নায়ক হিসেবে তিনি সমাদৃত হবেন। ফুটবলের ১০ নম্বর জার্সিটা তাঁর তোলা থাকবে সাজঘরে চিরদিনের জন্য। বুটজোড়া আর ফুটবলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, মেসির ফুটবলের সঙ্গে কথা বলার শিল্প কেউ দেখতে পারবেন না।
বিশ্বকাপের ট্র্যাজেডি নায়কেরা বিশ্বকাপ অধরা থেকে যাওয়ার বেদনা হারে হারে অনুভব করেছেন, দেশে শূন্য হাতে প্রত্যাবর্তনের পর। দেশবাসী আশায় বুক বেঁধে থাকে তাদের প্রিয় দল ও খেলোয়াড় দলের ও দেশের জন্য খুশির খবর নিয়ে দেশে ফিরবেন চার বছর ও তার বেশি অপেক্ষার পর। ট্র্যাজেডি নায়কেরা সবাই দক্ষ খেলোয়াড়, তাঁদের শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দেশ ও দলের জন্য সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন ও চালিয়ে যান। বর্তমান বছরের বিশ্বকাপে ফ্রান্সের এমবাপ্পেকে দেখলাম, ম্যাচের ৭৭ মিনিটে দল দুই গোলে পিছিয়ে থাকা সত্ত্বেও নিজের সেরাটা দেওয়ার জন্য কীভাবে জ্বলে উঠলেন এবং শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়েননি, প্রতিপক্ষকে চাপে রেখে নিজের দলকে আবার ম্যাচে ফিরিয়ে নিয়ে আসার নিরন্তর চেষ্টা করে গেছেন বারংবার গোলের রাস্তা দেখিয়ে, নিজে হ্যাটট্রিক করে, দেশবাসীর মনে আবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা জাগিয়ে তুলেছিলেন। বিধিবাম হলে যা হয়, বিশ্বকাপের তাজ লিওনেল মেসির জন্য যেন নির্ধারিত ছিল। বারবার ম্যাচে ফিরে এসেও ফ্রান্স ও এমবাপ্পেকে মেনে নিতে হলো আর্জেন্টিনার কাছে বেদনাবিধুর হারের জ্বালা ও চ্যাম্পিয়নের তাজ তাঁদের প্রতিপক্ষ দলের হাতে উঠছে সেই ছবি দেখা ও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হওয়া থেকে আরেকবার চাম্পিয়ন নয়, পরাজিত ও রানার্সআপ দলের খতিয়ানে ফ্রান্সকে লিপিবদ্ধ হতে দেখা।