‘ও টাঙ্গাইলের তাঁতী, আমার ঘরে নিভেছে আজ বাতি’
টাঙ্গাইলের শাড়ি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সম্পদ। টাঙ্গাইলের শাড়ি কথাটা শুনলেই যে জায়গার কথা মনে পড়ে, যে ভূমির ছবি মানসচোখে ভেসে ওঠে, সে তো বাংলাদেশ; আর কিছু নয়। শুধু বাংলাদেশ, কেবলই বাংলাদেশ।
চারদিকে শোরগোল পড়ে গেছে যে খবরে, তা হলো প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বত্ব পেয়ে গেছে বা অধিকারী হয়ে গেছে। এই জিআই বাংলাদেশের, এটা ফিরিয়ে আনতে হবে।
ভারতের পরিবেশকর্মী বন্দনা শিবা পশ্চিমা মাল্টিন্যাশনালদের নিমের পেটেন্ট জবরদখল করার কুচক্র নস্যাৎ করে নিমের পেটেন্ট ভারতের—এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পশ্চিমাদের দুরভিসন্ধি থেকে বাঁচিয়ে হলুদের পেটেন্টও ভারত নিজেদের করে নিয়েছে।
বাংলাদেশও টাঙ্গাইলের শাড়ি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, এতে জিআই হবে বাংলাদেশের—এ দাবি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কয়েকটি মনছোঁয়া ঘটনা স্মরণ করছি; হয়তো কারও না কারও ভালো লাগবে।
যেদিন এই অসাধারণ শোকগাথা লেখা হয়েছিল, কেমন ছিল দিনটা? মেঘলা ছিল কি সকাল? নাকি সন্ধ্যারাতে জ্যোৎস্না ছিল ম্লান? সেই মেঘলা সকালে শাড়ির স্তূপে বিষণ্ন–অবসাদে চোখ রেখে নাকি জানালা গলিয়ে বিছানায় পড়া ধূসর চাঁদের আলো মেখে টাল হয়ে পড়ে থাকা শাড়িগুলো দেখে কথাগুলোর জন্ম হলো। নানা রং আর নকশা আঁকা স্মৃতিমাখা সব শাড়ি। স্বামী-পুত্র হারিয়ে ব্যথা–বিহ্বল নারীর তখন মনে পড়ল টাঙ্গাইলের তাঁতি তো জানে না এ খবর। সব রং, সব নকশা নিয়ে তাঁতিরা তেমনই অপেক্ষায় আছে। শুধু তার একান্ত নিজস্ব রং-নকশামাখা আনন্দ অজানা ভুবনে চলে গেছে।
কবি রুবি রহমান রহস্যময় দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে মানবদরদি স্বামী শ্রমিকনেতা নূরুল ইসলাম ও একমাত্র পুত্র তমোহর ইসলামকে হারান।
অপূর্ব সৌন্দর্যে স্নাত, অসাধারণ রুচিশীল আবরণে সজ্জিত সবার দেখা কবি রুবি রহমানের অন্তর নিঃসৃত এই সংবাদ শুধু তাঁতশিল্পীর জন্য নয় সবার জন্য—
‘ও টাঙ্গাইলের তাঁতী
আমার ঘরে নিভেছে আজ বাতি।’
কবিতায় হৃদয় নিংড়ে কান্না ঢেলে দিয়েছেন কবি।
প্রায় সবারই কমবেশি জানা আছে কেমন করে গানে গানে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল পুত্রশোকে হাহাকার করেছেন। রবি ঠাকুরের পুত্র শমীর মৃত্যুর এক বছর পর লেখা—
‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে...যদি আমায় পড়ে তাহার মনে।’
আর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের পুত্র বুলবুলের মৃত্যুতে লেখা—
‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।’
এগুলো আজও আমাদের কাঁদায়।
কবি–সাহিত্যিকেরা নানাভাবে মানুষের দুঃখবেদনা প্রকাশের মর্মস্পর্শী চিত্র এঁকে গেছেন। ছোটগল্পের জন্য বিশ্বসাহিত্যে আন্তন চেখভ সুপরিচিত নাম। চেখভের এক গল্পে দেখা যায়, পুত্রকে হারিয়ে ব্যথিত এক বাবা ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। বরফঢাকা তীব্র শীত চরাচরে আর পুত্রহারা একাকী বাবা ঘোড়ার কাছে তার ছেলের গল্প বলছেন, বলেই চলেছেন। পুত্রশোকে ব্যাকুল এক পিতার বর্ণনা শুনে পাঠকের হৃদয় গলে গলে পড়ছে বেদনায়।
রুশ সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি আত্মজীবনী তিন খণ্ডে লিখেছেন—‘আমার ছেলেবেলা’, ‘পৃথিবীর পথে’, ‘পৃথিবীর পাঠশালায়’। খুব ছোটবেলায় মা–বাবাকে হারিয়েছেন। যাঁর কাছে স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েছিলেন, তিনি হচ্ছেন গোর্কির নানি। দারিদ্র্য ছিল ছোটবেলার নিত্যসঙ্গী। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ হয়নি তাঁর কখনো। বাল্যকালেই জীবনযাপনের তাগিদে গোর্কি শ্রমিকের কাজ শুরু করেন। মালিকের (সম্ভবত ঘড়ি মেরামতকারী ছিলেন লোকটি) কাছেই থাকতেন। নানির আদরও তখন অধরা। একদিন খবর পেলেন, নানি মারা গেছেন। সে রাতে বালক গোর্কির চোখে ঘুম নেই। তাঁকে সান্ত্বনা দেবে—এমন আপনজন কেউ ছিল না। বিষণ্ন সে রাতে চারপাশে কেউ জেগে নেই তাঁর দুঃখের ভাগ নেওয়ার জন্য। আকাশে চাঁদ ছিল আর উঠানে ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছিলমাত্র। বালক গোর্কির কীই-বা করার ছিল, তাই ইঁদুরদের কাছে নিজের মর্মবেদনা উজাড় করে দিলেন। দুঃখভারাতুর হৃদয়ে গভীর ভালোবাসা ও যত্ন নিয়ে ইঁদুরদের বলেছিলেন নানির কথা।
**দূর পরবাস–এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]