দ্বিতীয় স্কারবোরো ফোক ফেস্ট: বৈচিত্র্য ও উৎসবে মুখর

অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময় ছিল বেলা তিনটা। সেই সময়কে অতিক্রম করে ঘড়ির কাঁটা। তখন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা আয়োজক পরম্পরা কানাডার। ক্যামেরা ক্রু, শব্দ প্রকৌশলী ও কলাকুশলীরা প্রতীক্ষায়। প্রস্তুত ছিলেন নাচের দলের সব সদস্য। কোনো কিছুর ধার না ধরে ঝরছিল ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। তার চেয়ে বেশি এগিয়ে ছিলেন অনুষ্ঠান উপভোগ করতে আসা দর্শকেরা। মঞ্চের সামনে পাতা চেয়ারে বসে ছিলেন তাঁর ছাতা মাথায় নিয়ে। তাঁদের হার না-মানা মনোভাব দেখেই কিনা জানা নেই, বৃষ্টি পড়া বন্ধ হলো হঠাৎ। মুচকি হেসে উঠল সূর্য।

নাচের দলগুলো মঞ্চে এল পালা করে, নিজ নিজ দেশের ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে এমন সাজপোশাকে সেজে। তারা একে একে পরিবেশনা নিয়ে হাজির হয় নিজ নিজ সংস্কৃতির লোকজ গানের ছন্দে ছন্দে। এমনই এক ভিন্নধর্মী, তবে শৈল্পিক পরিবেশনায় পর্দা ওঠে ‘পরম্পরা কানাডা’ আয়োজিত দ্বিতীয় স্কারবোরো ফোক ফেস্টের।

নাচের দলগুলো নিজস্ব পরিবেশনা শেষে মঞ্চের সামনের খোলা চত্বরে জড়ো হয় কানাডার পতাকা হাতে। সব নৃত্যশিল্পীর অংশগ্রহণে কানাডার জাতীয় সংগীতের সঙ্গে নেচে এবং জাতীয় পতাকা উড়িয়ে আয়োজনের উদ্বোধন করা হয়।

বৈচিত্র্যময় ও বিভিন্ন জাতিসত্তাকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুই দিনের আয়োজন। উদ্বোধনী পর্বটি পরিচালনা করেন অরুণা হায়দার ও সমন্বয় করেন জামিল বিন খলিল। এতে অংশ নেয় থেরাপিউটিক হিলিং ডান্স, তারানা ডান্স গ্রুপ, গীতাঞ্জলি মিউজিক একাডেমি, নৃত্য প্যালেট, সুকন্যা নৃত্যাঙ্গন, সৃজনশীল নেপালি সমাজ, নৃত্যকলা কেন্দ্র, প্রিমা ডান্স স্কুলের শতাধিক শিল্পী।

শিকড় থেকে শুরু

কানাডার ফার্স্ট নেশনের পরিবেশনা দিয়ে উৎসবে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা শুরু হয়। এ পর্বে কোটি হারপার ও থিও মেকগ্রেগরের পরিবেশনা ছিল অনবদ্য। পর্যায়ক্রমে মঞ্চে আসেন এনসেম্বল টোপাজ, নিমা কোয়ার, ব্রডট্রি ব্যান্ড, গীতাঞ্জলি মিউজিক একাডেমি, ওনিয়ন হানি ব্যান্ড, ডিডিএ কানাডা, ফোকলোরিক মেক্সিকান দলগুলো। তারা নিজ নিজ সংস্কৃতিকে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন পরিবেশনার মাধ্যমে। দোতারা বাজিয়ে শোনান জুনায়েদ আনওয়ার। কাওয়ালির সুরের জাদুতে দর্শক মাতান শাহিদ আলী খান ও তাঁর দল।

দর্শক মাতান পিন্টু ঘোষ

বাংলাদেশ থেকে আসা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া সংগীতশিল্পী পিন্টু ঘোষ যখন মঞ্চে আসেন, তখন অনুষ্ঠানস্থল কানায় কানায় পূর্ণ। দর্শকদের অভিবাদনের উত্তরে একে একে গেয়ে শোনান তাঁর গাওয়া শ্রোতাপ্রিয় গানগুলো। এ ছাড়া সিলেট অঞ্চলের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী ও সাধকদের গাওয়া কয়েকটি গান পরিবেশন করেন। এ সময় প্রচুর দর্শক শিল্পীর গানের সঙ্গে নেচে-গেয়ে আনন্দে মাতেন।

উৎসবে অংশ নেওয়া অতিথিরা

উৎসবে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন সিটি অব টরন্টোর মেয়র অলিভিয়া চাও, স্কারবোরো সাউথইস্টের এমপিপি ডলি বেগম, টরন্টো ডিস্ট্রিক স্কুল বোর্ডের (টিডিএসবি) ট্রেজারার নেথান সান, সিটি অব টরন্টোর স্কারবোরো সেন্টারের কাউন্সিলর মিসেল থমসন, কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপের ভাইস প্রেসিডেন্ট টুলা ব্যাটম্যান, দেশে-বিদেশে টিভির সিইও নজরুল মিন্টু, ফিড স্কারবোরোর প্রতিষ্ঠাতা সুমন রয়, টরন্টো দুর্গা বাড়ির পরিচালক ড. সুশীতল চৌধুরী, এনআরবি টিভির সিইও ও বাংলা মেইল পত্রিকার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম মিন্টু প্রমুখ।

অনবদ্য তবলা পরিবেশনায় দ্বিতীয় দিনের শুরু

দ্বিতীয় দিন অনুষ্ঠান শুরু হয় নির্ধারিত সময় বেলা তিনটায়। শুরুতে চপলা-বসন্তের তবলা পরিবেশনা দর্শকদের মুগ্ধ করে। এরপর একে একে পরিবেশনা নিয়ে হাজির হয় উইলসন অ্যান্ড দ্য ক্যাস্ট অলওয়েজ ব্যান্ড, নৃত্য ঝংকার। পদাবলি কীর্তন উপস্থাপন করে গৌর সম্প্রদায় টরন্টো। ওত ইজভরা, বুলগেরিয়ান কোয়ার, রশ্মি ডান্স একাডেমির পরিবেশনাগুলো ছিল মনোমুগ্ধকর।

টরন্টোর মঞ্চে নানা-নাতি

বাংলাদেশের জনপ্রিয় লোকজ পরিবেশনা গম্ভীরা পরিবেশন করে ‘অন্য থিয়েটার টরন্টো’। নানা-নাতির টরন্টোতে বেড়াতে আসা গল্প নিয়ে পরিবেশনাটি দারুণ উপভোগ করেন আগত অতিথিরা। এ ছাড়া কাচাডা ব্যান্ড, উর্মি স্কুল অব ডান্স, ডোনা বোডে দর্শকদের প্রশংসা পায়। সাবু শাহ গেয়ে শোনান বেশ কিছু লোকসংগীত। জারা আহমেদ ও রচনা দেশপান্ডে সংগীত পরিবেশন করেন। দিনের শেষ পরিবেশনা ছিল লাভলী দেবের ধামাইল গান।

আর্ট কোয়েস্টের ছবি অঙ্কন ও প্রদর্শন

উৎসব আগত দর্শকদের বাড়তি আনন্দ দেয় আর্ট কোয়েস্টের সদস্য বাংলাদেশি-কানাডিয়ান ১৫ জন শিল্পী। তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে আসা ক্যানভাসে ছবি আঁকেন দর্শকদের উপস্থিতিতেই। দুই দিন ধরে তাঁদের আঁকা ছবিগুলো প্রদর্শিত হয়। এ ছাড়া চিত্রশিল্পীরা আয়োজনে অংশ নেওয়া শিশু-কিশোরদের মুখচিত্র এঁকে দেন।

পরম্পরা কানাডার সম্মাননা

দ্বিতীয় স্কারবোরো ফোক ফেস্টে এ বছর তিনটি সম্মাননা জানানো হয়। সম্মানপ্রাপ্তরা হলেন মুন্নী সোবাহানি, সাংস্কৃতিক সংগঠন ইসাই কালালামরাম ও নাচের স্কুল সুকন্যা নৃত্যাঙ্গন। তারা তিন দশক ধরে বহুমাত্রিক সংস্কৃতিক চর্চায় বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছে।

আয়োজকদের কথা

বেসরকারি সংস্থা ‘পরম্পরা কানাডা’র উদ্যোগ এবং ওন্টারিও কালচারাল অ্যাট্রাকশনস ফান্ড, ফ্যাক্টর কানাডা, স্কারবোরো আর্টস, ডিজিটিউন ইভেন্টসের সহায়তায় এ আয়োজনের উপকারভোগী দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্কারবোরো হেলথ নেটওয়ার্কের লাভ স্কারবোরো ক্যাম্পেইন।

স্কারবোরো ফোক ফেস্টিভ্যালের প্রতিষ্ঠাতা এবং আর্টিস্টিক ডিরেক্টর উজ্জ্বল দাশ জানান, দুই দিনের এ আয়োজনে কানাডার আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে শুরু করে অভিবাসী—নানা কমিউনিটির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তবে উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে ছিল বাংলাদেশি সংস্কৃতির পরিবেশনা। বিভিন্ন কমিউনিটির প্রায় তিন শতাধিক শিল্পী এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন বলে জানান তিনি।

দুই দিনের উৎসবটির বিভিন্ন পর্ব সঞ্চালনা করেন পরম্পরা কানাডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যোতি পুরকায়স্থ, স্যাম হারভার্ট, এন্থনিও লাউস, বর্ণমালা।

উৎসব নিয়ে দর্শকদের অভিমত

২৯ ও ৩০ জুলাই ওন্টারিওর স্কারবোরোতে অবস্থিত থমসম মেমোরিয়ার পার্কে অনুষ্ঠিত উৎসবে আগত দর্শকেরা আয়োজনের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সুব্রত কুমার দাশ বলেন, ‘দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত স্কারবোরো ফোক ফেস্টে এসে আমি খুব খুশি। কেননা এ আয়োজনের আয়োজকেরা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটির। তা ছাড়া এটি দারুণ একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যেখানে অন্যান্য অনেক দেশের সংস্কৃতির পরিবেশনা উপস্থাপনের পাশাপাশি আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি দারুণভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনুষ্ঠানস্থলের একটি অংশে বাংলাদেশি কমিউনিটির চিত্রশিল্পীরা বসে ছবি আঁকছেন। সেটি খুবই ভালো লেগেছে। সব মিলিয়ে দারুণ উপভোগ করছি।’
ফয়জুল করিম বলেন, ‘গত বছরও এ উৎসবে এসেছিলাম। এ বছর সেই তুলনায় আরও পরিচ্ছন্ন, গোছোনোভাবে আয়োজনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দেখে ভালো লাগছে, একই মঞ্চে অন্য অনেক দেশের শিল্পীদের সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটির শিল্পীরা দারুণ সব পরিবেশনা নিয়ে হাজির হয়েছেন।’

নওশের আলী বলেন, ‘একই মঞ্চে বহুজাতিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরার যে প্রয়াস সেই ধরনের একটি আয়োজনে আসতে পেরে আমি খুবই গর্বিত ও আনন্দিত। শুধু তা-ই নয়, এ আয়োজনের পেছনে উদ্যোক্তারাও আমাদের বাঙালি কমিউনিটির। সব মিলিয়ে এ আয়োজন নিয়ে নিজে যেমন গর্বিত, তেমনি পুলকিত।’

উৎসবে ঘুরতে আসা টড বলেন, মঞ্চের যে ধরনের গান ও নাচের পরিবেশনা দেখলাম, তা খুব ভালো লেগেছে। শুধু তা-ই নয়, এখানে দোকানিরা নানান দেশের পোশাক, ঐতিহ্যবাহী গয়না, খাবার নিয়ে হাজির হয়েছেন। পুরো এলাকাটি উৎসবে মুখর হয়ে উঠেছে। এটি বহুজাতিক সংস্কৃতিকে তুলে ধরার সফল একটি প্রয়াস হিসেবে দেখছি আমি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখানে এসে সাউথ এশিয়ান, উজবেকিস্তান, আফ্রিকান মিউজিক উপভোগ করেছি। আমি এখানে শুধু ঘুরতে এসেছিলাম। এখন পুরো আয়োজনটিকে দারুণ উপভোগ করছি। আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই এ ধরনের দারুণ একটি শো আয়োজন করার জন্য।’

হায়া লোশিনস্কাই বলেন, ‘আমি মিউজিক ভালোবাসি। এ আয়োজনে মিউজিকের বৈচিত্র্য তুলে ধরা হচ্ছে। সেসব দেখতে ও শুনতে ভালো লাগছে।’

দুই দিনের এ বর্ণাঢ্য আয়োজন বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রায় কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। তারা নেচে-গেয়ে পুরো আয়োজনটি উপভোগ করেন। সেই দিক থেকে বৈচিত্র্যময় উৎসবে মুখর এক আয়োজন হিসেবেই প্রশংসা কুড়াচ্ছে স্কারবোরো ফোক ফেস্ট ২০২৩।