অপেক্ষা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

‘আপনি কি মুখে চন্দন কাঠ মেখেছেন?’ রাইমার এমন প্রশ্নে চমকে উঠল হাসান।

যদিও সে মুখে চন্দন কাঠ মাখেনি। সেলুনে গিয়ে বলেছে, এমন কিছু দিতে যাতে তাকে আরও ইয়াং লাগে। জালালের এই সেলুনে গত পাঁচ বছরে নিয়মিতই আসে হাসান। ঢাকাতে এসেছে পাঁচ বছর। সমান বয়স সেলুন আর ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের। জালাল প্রথমে কুসুম কুসুম গরম পানি দিয়ে মুখ ধুইল দুবার। যদিও হাসানের মনে হয়ছিল, চা বানানোর জন্য ধোঁয়া ওঠা পানি দিছে। চা-পাতা কপালে দিয়া পানিটা ঢাললে হাসান হালকা ঠোঁট ফাঁক করে চা-ও খেতে পারত।

দুবার ধোয়ার পর হাসানের গালের চামড়া জ্বলছে। সে কিছুই বলছে না। জালালকে সে পছন্দ করে। কিছু বললেই জালাল অভিমান করবে। আগামী এক দিন অন্তত কারও সঙ্গেই কথা বলবে না এই দুঃখে। জালাল গান ছাড়ল।

‘বুঝছেন হাসান ভাই? এমনভাবে আইজকা গালে ফিট দিমু আপনার মা-খালারা কইব কোলে আয়! এত ছোট লাগব।’

‘এত ছোট লাগানোর দরকার নাই জালাল। আমি মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। আমি চাই না মেয়ে গালে আদর দিয়ে চকলেট ধরায়ে দেক। তুমি হালকা কিছু দাও। একটু ফ্রেশ যেন লাগে। দ্যাটস ইট!’
‘ওকে! কিলিয়ার। কোলে উঠান যাইব না। আপনি চউখ বন্ধ লন। উইঠা দেখেন আপনি কেডা?’
হাসান ক্লান্ত! জালাল অনেক কিছু ঘষছে। ভালোই লাগছে। আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। যখন উঠল ঘড়িতে দুইটা বাজে। হাসানের ঠিক ২টা ১৫-তে টিএসসিতে যাওয়ার কথা। কোনোরকমে উঠে দৌড়। এত সব কথা ১ মিনিটের পরিচিত মেয়েটাকে বলা যাবে না।

‘মুখে ফ্রেশ রাখার ক্রিম মেখেছি! চন্দন না।’

রাইমা হেসে বলল, ‘আপনার কি ধারণা আপনাকে অনেক ফ্রেশ লাগছে? না। মোটেই না। আপনাকে লাগছে যাত্রার অভিনেতাদের মতন। তা-ও আপনার রোল ১ মিনিটের। একটু পরেই যাবেন মঞ্চে, মিনিটের মধ্যেই প্লাস্টিকের তলোয়ারের গুঁতো খেয়ে মরে যাবেন। আহ আহ!’

‘আপনি এত রেগে যাচ্ছেন কেন? গুঁতা খেয়ে মরব আমি। ব্যথা পাব আমি। আহ আহ!’
‘মশকারি করবেন না। আমি মশকারি করি না। চিপ জোকস বইলা পটানো ২০ বছর আগে গল্পের বইতে হইত। প্লিজ! মশকারি করবেন না!’

‘আমি কোনো মশকারি করছি না। আপনি যা বললেন তাই মেনে নিলাম!’

‘আমাকে বিয়ে করতে চান কেন?’

‘বিদেশ যাব। ফ্যামিলির সবাই চায় আমি বিদেশ গিয়ে হাল ধরি। আমার ফকিরি হালত। আপনাকে দেখার করার জন্য ফোনটাও আমি এক অপরিচিত লোককে অনুরোধ করে করেছি। আপনি আমেরিকার সিটিজেন। বিয়ে করে আপনার হাত কিংবা আঁচল যাই পাই, তাই ধইরা মুসলিম ওবামার দেশে চলে যাব! নামাজ-কালাম, কাজকর্ম আর সংসার। সব সুন্দর হয়ে যাবে। কী বলেন?’

রাগে রাইমার চোখ যে কোন সময় বের হবে হয়তো। একটা বড় শ্বাস নিল সে। ‘আপনার লজ্জা করে না? এই কারণে একটা মেয়েকে বিয়ে করবেন?’

‘না। করে না। কারণ, আমি যদি বলতাম আপনাকে আমার ভালো লাগছে। 4R ছবিতে আপনার চোখ দেখে ৩ রাত, ২ দিন ঘুমাতে পারি নাই। আপনার ছবি দেখলেই আমার কানে গান বাজে ‘মে হুনা’ সিনেমার মতোন। এদিক-ওদিক তাকালেই দেখি এই চৈত্র মাসে স্নোফল হচ্ছে আর আপনি ছোট ছোট বরফকুচি দিয়া আমার দিকে আসতেছেন…কেমন লাগবে শুনতে?’

কী আজব। রাইমার হাসি আসছে। একটু মুচকি হেসেই দিল। কোনোরকমে সামলে কিছু বলার আগেই হাসান বলল, ‘এক কাজ করেন। চলেন চা-টা খাই। টুকটাক গল্প করি। আপনাকে একটা রিকশা ধরায়ে দি। আপনি চলে যান। আমাদের বিয়ে হচ্ছে না, এটা আপনার জন্য কোনো বিষয় না। আপনি কালকে আরেকটা শাড়ি পরে চলে আসবেন। আরেকজন এসে ইন্টারভিউ দেবে। আমিও আমার কাজ করব। পত্রিকা খুঁজে বেড়াব অন্য পাত্রীর খোঁজে। হুম?’

রাইমা বসে আছে চায়ের কাপ নিয়ে। কত হাজার অজানা মানুষের ঠোঁট ছুঁয়েছে এই কাপ! এটা ভাবতেই সে কোনোভাবেই চুমুক দিতে পারছে না। কাপ পাশে রেখে উঠে দাঁড়াল।

‘আমি যাই। ভালো থাকবেন হাসান সাহেব।’

‘ওকে। আপনিও ভালো থাকবেন। আর শুনুন, এত রেগে যাবেন না। আপনাকে আরও সুন্দর লাগে। এই সুন্দরের মায়া যদি কারও লেগে যায়, সে সারা জীবন আপনাকে রাগিয়ে বেড়াবে। দোষটা তখন তার হবে না। এতটাই সুন্দর লাগে আপনাকে রাগলে। সাবধানে যাবেন।’

এই ঘটনার প্রায় দুই মাস হয়ে গেল। রাইমা প্রতিদিন একবার করে আসছে লাস্ট দুই সপ্তাহে। সেইম জায়গায় বসে কাপের পর কাপ চা খাচ্ছে। হাসানকে তার ভালো লেগেছে। দেখা হলে বলবে। সে কোনোভাবেই রাগ ধমে রাখতে পারছে না!

* লেখক: মাঈনুল ওয়াদুদ সুমন, ডার্ডফোর্ড, ইংল্যান্ড

* দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]