ফ্যাশন ও আধুনিকতার রাজধানী মিলান

আল্পস পর্বতমালার ছায়াতলে, রুচি, নান্দনিকতা ও উদ্ভাবনের এক মনোমুগ্ধকর নগরী, যার নাম মিলান। এটি কেবল ইতালির ফ্যাশন ও ব্যবসার কেন্দ্র নয়, বরং ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও নন্দনবোধের এক অপূর্ব সংকলন। উত্তর ইতালির লম্বার্ডি অঞ্চলের হৃদয়ে অবস্থিত এই শহর, যেখানে অতীতের গৌরব আর বর্তমানের গতিময়তা মিলেমিশে তৈরি করেছে এক অসাধারণ আবহ। শীতের কুয়াশা আর গ্রীষ্মের রোদে পালটে যাওয়া রঙিন এই শহর যেন এক চলমান চিত্র–ক্যানভাস।

মিলানে বসবাসরত সাংবাদিক কমরেড খন্দকারের আন্তরিক আমন্ত্রণে শহরটি দেখার সুযোগ হলো। বহু বছর ধরে তিনি এই শহরের নিবাসী। সমাজ, সংস্কৃতি এবং অভিবাসী জীবনের নানা স্তরের সঙ্গে গড়ে উঠেছে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মিলানে পৌঁছে তাঁর উষ্ণ অভ্যর্থনা, সৌজন্য এবং সহৃদয় আতিথেয়তা আমাকে আপ্লুত করেছে।

মিলানের ইতিহাস দুই হাজার বছরের বেশি পুরোনো। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে কেল্টিক জাতি ইনসুব্রে এই শহর প্রতিষ্ঠা করে এবং নাম রাখে মেদিওলানুম, যার অর্থ ‘মধ্যস্থল’। খ্রিষ্টপূর্ব ২২২ সালে রোমানরা শহরটি জয় করার পর এটি পরিণত হয় উত্তর ইতালির প্রধান প্রশাসনিক ও সামরিক ঘাঁটিতে।

চতুর্থ শতকে সম্রাট কনস্টানটাইন এখানেই খ্রিষ্টধর্মকে বৈধ ঘোষণা করেন, যা ইউরোপীয় সভ্যতার ইতিহাসে এক মাইলফলক ঘটনা। মধ্যযুগে শহরটি ধীরে ধীরে স্বশাসিত নগররাষ্ট্রে রূপ নেয় এবং পরবর্তী সময়ে ভাইস্কোন্টি ও স্ফোরৎসা পরিবারের শাসনে শিল্প, স্থাপত্য ও বাণিজ্যের উৎকর্ষে পৌঁছায়।

রেনেসাঁস যুগে মিলান হয়ে ওঠে শিল্প, বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রাণকেন্দ্র। এই শহরেই লেওনার্দো দা ভিঞ্চি সৃষ্টি করেন তাঁর অমর কীর্তি The Last Supper, যা আজও বিশ্ব শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলোর একটি। ১৯ শতকে মিলান ইতালির একীকরণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় এবং ২০ শতকে শিল্পায়ন ও আধুনিক অর্থনীতির হৃদয়ে স্থান পায়। আজও একে বলা হয় ‘ইতালির নৈতিক রাজধানী’, কারণ এখানেই দেশের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সবচেয়ে প্রাণবন্ত স্পন্দন অনুভূত হয়।

মিলানের ভূগোল স্বতন্ত্র ও চিত্তাকর্ষক। শহরটি অবস্থিত উত্তর ইতালির পো সমভূমির কেন্দ্রে, চারদিকে বিস্তৃত উর্বর প্রান্তর, যা যুগে যুগে কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্পায়নের বিকাশে ভূমিকা রেখেছে। যদিও সমুদ্র থেকে কিছুটা দূরে, তবু আশেপাশে রয়েছে ইউরোপের মনোমুগ্ধকর কয়েকটি হ্রদ। নীলাভ জল, সবুজ পাহাড়, ছোট ছোট শান্ত শহর ও দৃষ্টিনন্দন ভিলাগুলো মিলে মিলানের প্রকৃতিকে দিয়েছে প্রশান্ত ও রোমান্টিক আবহ। শহরের বুক চিরে প্রবাহিত প্রাচীন খালব্যবস্থা নেভিগ্লি একসময় ছিল বাণিজ্য ও পরিবহনের প্রাণধারা। এখন তা মিলানের জীবনযাত্রার প্রতীক হয়ে উঠেছে। সন্ধ্যা নেমে এলে খালের তীরের ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ও গ্যালারিগুলো আলোয় ঝলমল করে ওঠে; মানুষ গল্পে মাতে, গান গায়, আর কফির কাপে খুঁজে নেয় একটুখানি প্রশান্তি ও জীবনের রস।

বিশ্বের ফ্যাশন মানচিত্রে মিলানের অবস্থান অনন্য। প্যারিস, লন্ডন ও নিউইয়র্কের পাশাপাশি এটি বিশ্ব ফ্যাশনের চার রাজধানীর একটি। গুচি, প্রাডা, আর্মানি, ভার্সাচে ও ডলচে অ্যান্ড গাব্বানা—এসব বিখ্যাত ব্র্যান্ডের জন্মভূমি মিলান। বছরে দুইবার অনুষ্ঠিত মিলান ফ্যাশন উইক কেবল পোশাক প্রদর্শনী নয়, বরং সৃজনশীলতার এক উৎসব।

শুধু ফ্যাশন নয়, স্থাপত্য ও নকশায়ও মিলান তার নিজস্ব পরিচয় তৈরি করেছে। কাচ আর স্টিলের সুউচ্চ ভবনের ভেতরেও ইতিহাসের ছাপ টিকে আছে। গথিক স্থাপত্যের বিস্ময় ডুমো ডি মিলানো তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

মিলানিজ জনগণ নান্দনিকতাপ্রেমী। সংগীত, চিত্রকলা, অপেরা কিংবা সাহিত্য; প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা রুচির পরিচয় দিয়েছে। লা স্কালা অপেরা হাউস বিশ্বের অন্যতম সেরা সংগীত মঞ্চ, যেখানে মোৎসার্ট, ভের্দি, পুচিনি প্রমুখের সুর এখনো অনুরণিত হয়।

ইতালীয় ভাষাই এখানে প্রধান, তবে ব্যাবসা, শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগে ইংরেজিও সমানভাবে ব্যবহৃত হয়। প্রায় তেরো লাখ মানুষ এই শহরের অধিবাসী এবং এর আশপাশে বসবাসকারী মিলিয়ে জনসংখ্যা চার মিলিয়নের বেশি।

মিলান বহুজাতিক ও বহুভাষিক সমাজ। এখানে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার নানা প্রান্ত থেকে আগত অভিবাসীরা বসবাস করে। চীনা, আরব, ফিলিপিনো, মরোক্কান, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি সম্প্রদায় শহরের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশি অভিবাসীরা মিলানের রেস্তোরাঁ, টেক্সটাইল ব্যাবসা ও ফুড ডেলিভারি সার্ভিসে অত্যন্ত দৃশ্যমান। বিশেষ করে নেভিগ্লি ক্যানেলের দুই তীরজুড়ে সন্ধ্যা নামলেই যে ভ্রাম্যমাণ হকারদের দেখা মেলে, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশি। পরিশ্রম, সততা ও নির্ভরযোগ্যতার জন্য তারা ইতালীয়দের কাছে এক বিশ্বাসযোগ্য কর্মশক্তি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অনেক পরিবার ইতোমধ্যে মিলানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। সন্তানরা স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করছে, ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে ইতালীয় সমাজে আত্তীকরণের পথে, গড়ে তুলছে পরিচয় ও সম্ভাবনার নতুন সেতুবন্ধ।

উচ্চশিক্ষার জন্যও এক আকর্ষণীয় গন্তব্য মিলান। এখানে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব মিলান, পলিটেকনিকো ডি মিলানো ও বোকোনি ইউনিভার্সিটি, যেগুলো ইউরোপের শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে।

প্রতিবছর অসংখ্য আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিষয়ে পড়তে আসেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও রয়েছেন, যাঁরা মিলানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের মেধা ও পরিশ্রমের ছাপ রেখে যাচ্ছেন। তাঁরা শিক্ষা শেষে কেউ দেশে ফিরছেন, কেউ–বা ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছেন।

মিলানের যোগাযোগব্যবস্থা ইউরোপের অত্যন্ত উন্নত। শহরজুড়ে রয়েছে চারটি মেট্রো লাইন, আধুনিক ট্রাম, বাস ও রেল সংযোগ। জনপরিবহন এতই কার্যকর যে ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়াও জীবন সহজভাবে চলতে পারে। সাইকেল ও ইলেকট্রিক স্কুটার এখন শহরের নতুন ট্রেন্ড।

মিলানে জীবনযাত্রার মান উন্নত ও আধুনিক। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও নাগরিক সেবা সবই উৎকৃষ্ট মানের। তবে শহরের জীবনব্যয় তুলনামূলক বেশি, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় এলাকায় বসবাস ব্যয়বহুল। তবু মানুষ এখানে থাকতে চায়, কারণ এই শহর জীবনকে দেয় গতি, মর্যাদা এবং অনুপ্রেরণা। সকালের সূর্য যখন কাচের টাওয়ারে ঝলমল করে ওঠে, মনে হয় এখানে স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেখা যায়। রোমের রাজকীয়তা আর ভেনিসের রোমান্টিকতার মাঝখানে মিলান যেন আধুনিক বাস্তবতার প্রতীক।

দিন শেষে মিলান কেবল একটি শহর নয়, এটি এক অনুভূতি। সন্ধ্যার নীল আলো যখন নেভিগ্লির খালের জলে প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয়, এই শহর যেন রোমান্টিক বাস্তবতার জীবন্ত প্রতীক। অপেরার সুরে ডুবে থাকা রাত, কফিশপের উষ্ণ আলাপ, কিংবা ফ্যাশনের ঝলমলে প্রদর্শনী; সবকিছু মিলিয়ে মিলান যেন আধুনিকতার একসময়ের গাঁথা। এ শহর শেখায় যে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা কখনো পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং তারা একে অপরের পরিপূরক।

*লেখক: নজরুল মিন্টো, কানাডা প্রবাসী

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]