জন্মদিনটা মেঘের ওপরে কেমন কাটল, প্রিয় লেখক
গতকাল রাতে বহু মাস পর আমাদের তিন বান্ধবীর একসঙ্গে রাতে কাজ ছিল। চাকরিজীবনের প্রায় শুরু থেকেই আমরা একসঙ্গে আছি। কিন্তু তিনটি হাসপাতাল হওয়ার পর ডিউটি পড়ে আলাদা আলাদা। জীবনের গত কয়েক মাসের ঘটে যাওয়া সব ঘটনার খোঁজ নেওয়া শেষ এমন সময় কিচি বলল, খুব আনমনা যে?
বললাম, আজ আমার প্রিয় লেখকের জন্মদিন (হুমায়ূন আহমেদ: ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)। চান্নি পসর রাত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দেখছি জোছনা। এমন দিনে চন্দ্রাহত লেখক কত গল্প–উপন্যাস লিখেছেন। কিটি আর জয় ধরেই বসল, তাহলে একটা প্রিয় গল্পের কথা শোনাও। ‘কোথাও কেউ নেই’ বইটি গত কয়েক দিন অসংখ্যবার পড়েছি। ওদের শোনাতে শুরু করলাম—মোড়ের দোকানে উচ্চ স্বরে গান, সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছে মুনা আর বাকের ভাইয়ের বেহিসাবি জীবনের তুমুল ভালোবাসাময় আদিখ্যেতা দেখানো একটা ছবি। মুনা বিরক্ত।
বিরক্ত হতে হতেই মানুষটার গভীর ভালোবাসা আর কেয়ারের কাছে মুনার হার মেনে যায় একটু একটু করে। এর মাঝে মুনার ছোট বোনের খুব অল্প বয়সে বিয়ে, ডাক্তার স্বামীকে অকারণে সন্দেহ (হ্যালুসিনেশন প্রেগন্যান্সি রিলেটেড)। আবার সেই স্বামীই যখন অসুস্থ হয়ে গেলেন, তখন পরম ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা করল বোনটা। মুনা সঙ্গেই ছিল ছায়া হয়ে। এতটুকু শুনে খুব খুশি দুজন।
সবাই খাবার গরম করে বসলাম।
খেতে খেতে জাহানারা নামের মেয়েটার গল্প বললাম। ছোট্ট সংসারে সামান্য আয়োজনে প্রাণপণে ভালোবাসার মানুষটার জন্য কিছু করছে ও। পা পুড়িয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এরপরই জাহানারা খুঁজে পেল নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে।
এতটুকু বলার পরপর কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম আমরা। মাঝরাতে আবার ফুরসত হলো কথা বলার। তখন বললাম সামাজিক অবক্ষয়, তিন কন্যার জীবন আর বাকের ভাইকে অযথা পণ বানিয়ে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার অসৎ প্ল্যানটুকু।
বইয়ের শেষাংশ শোনার জন্য রাত চারটায় আবার ওরা বসল। বললাম জ্বরতপ্ত মুনার বাকের ভাইয়ের কাছে ভালোবাসা প্রকাশের সেই রাতের গল্প। তারপর? বললাম, এরপর আর না শোনো। ওরা নাছোড়বান্দা। বললাম খুনের মিথ্যা অভিযোগে বাকের ভাইকে জেলে নেওয়ার গল্প, দীর্ঘ অপেক্ষার পর শেষ পর্যন্ত লাশ পাওয়া। নিজের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। মুছে তাকিয়ে দেখি কন্যাদ্বয় চোখ মুছছে। বলে দিল তোমার লেখককে বলো সত্যিকার ভালোবাসার জয় দেখাতে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি মানি না। হাসলাম। বললাম, উনি তো নেই। মন কাঁদছে আমার খুব। গাইছি—
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো এক বরষায়’
প্রিয় লেখক, আজকে আপনার বেঁচে থাকা খুব জরুরি ছিল। ছাত্র আন্দোলনে সঙ্গী হতেন, তাঁদের শিক্ষার মূল্য বোঝাতেন, দেশ গড়তে কাজ করতেন, একটা ক্যানসার হাসপাতাল বানাতেন, আর...গল্পের মাধ্যমে জীবনে সব কষ্ট মুছে দিতেন। ভালো থাকুন মেঘের ওপরে, প্রিয় লেখক। শুভ জন্মদিন। বাসায় এসে ঘুমিয়ে নিলাম, গোধূলিলগ্নে বাইরে বসে গেলাম আবার ‘কোথাও কেউ নেই’ নিয়ে।