ইত্তিহাদে সুপার সানডে
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের একজন দর্শক হিসেবে স্বপ্ন ছিল সুপার সানডেতে একটা হাইভোল্টেজ ম্যাচ উপভোগ করা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ম্যানচেস্টার সিটি-আর্সেনাল ম্যাচের টিকিট হাতে পাওয়ার পর অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি। অবশেষে ৩১ মার্চ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে হাজির। ম্যাচ শুরুর আড়াই ঘণ্টা আগে আমার বাসা থেকে ইত্তিহাদের দিকে যাত্রা শুরু করি। আমার বাসা থেকে হেঁটে ৫০ মিনিটের পথ। কিছুটা পথ পেরিয়ে মূল সড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। রাস্তায় সারি সারি গাড়ি। সিটি সমর্থকেরা ক্লাবের গেঞ্জি গায়ে চাপিয়ে মনের আনন্দে ড্রাইভ করে চলেছে। ইত্তিহাদ স্টেডিয়ামের কাছে যেতেই দেখলাম মাইক্রোবাসের মতো ছোট গাড়িতে করে কান্ট্রি সাইড থেকে প্রচুর মানুষ তাদের প্রিয় দলের খেলা দেখতে হাজির হয়েছেন। আসলে ফুটবল এখানেও আমজনতার খেলা। ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবলের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী, তবে টিকিটের দামের ক্ষেত্রে ক্রিকেট ফুটবলকে অনায়াসে টেক্কা দেয়। আমি প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে হাইভোল্টেজ ম্যাচের টিকিট অফিশিয়াল চ্যানেলে ৭৭ পাউন্ড দিয়ে কিনেছি। অথচ লর্ডসে ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের টেস্ট ম্যাচের টিকিটের দাম দেখে অবাক হয়েছি, প্রায় তিন গুণ! এ প্রসঙ্গে সেদিন আমার সুপারভাইজারকে বলছিলাম, এখানে ক্রিকেটের টিকিটের দাম এত বেশি কেন? তখন উনি হাসতে হাসতে বলছিলেন, এখানে ক্রিকেট আসলে অভিজাত শ্রেণির খেলা। মজার বিষয় হলো, উপমহাদেশে গিয়ে অভিজাত শ্রেণির এই ক্রিকেট আমজনতার খেলা হয়ে গেছে।
স্টেডিয়ামের কাছে যেতেই বড় ম্যাচের উত্তাপ টের পেলাম। যে গেটের সামনে খেলোয়াড়দের বাস এসে দাঁড়ায়, সেখানে ভিড় অনেক বেশি। সমর্থকেরা গলা ছেড়ে গান গাইছে, আনন্দ করছে। আমি ভিড় এড়িয়ে নিরাপত্তাতল্লাশি শেষে স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমার সিট পূর্ব দিকের গ্যালারির একেবারে ওপরের অংশে পড়েছে। প্রথমে সিটের অবস্থান দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম, এত ওপর থেকে বোধ হয় ভালো খেলা দেখতে পারব না। তবে সিটে বসার পর মন ভালো হয়ে গেল, কারণ ওখান থেকে পুরো মাঠের অবয়বটা চমৎকারভাবে অবলোকন করতে পারছিলাম। ম্যাচটি নিয়ে অধিক উত্তেজনা ছিল। কারণ, আর্সেনাল, ম্যান সিটি এবং লিভারপুল খুব কাছাকাছি পয়েন্ট নিয়ে একে অপরের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছিল। নির্ধারিত সময়ে খেলা শুরু হলো। শুরুতেই সিটির একক আধিপত্য। আর্সেনালের ডি-বক্সের সামনে একের পর এক আক্রমণ করে চলেছে কিন্তু আর্সেনালের জমাট ডিফেন্স ভাঙতে পারছে না। মাঝে আর্সেনাল প্রতি-আক্রমণে কয়েকবার বল নিয়ে সিটির গোলের সামনে হানা দিয়েছে তবে ফিনিশিংয়ের অভাবে গোল করতে পারেনি। আর্সেনাল সিটির মাঠে হারতে চায়নি বোধ হয়। এ কারণে কিছুটা রক্ষণশীলভাবে খেলে ১ পয়েন্ট নিয়ে গেল।
মাঠে বসে খেলা দেখার সময় কিছু বিষয় বোঝার চেষ্টা করছিলাম। বিশেষ করে দুই দল কোনো ফরমেশনে খেলছে এবং কীভাবে মাঝেমধ্যে ফরমেশন বদল করছে। চকিতে খেলার পরিস্থিতি অনুযায়ী কখনো ৪-৪-২ থেকে ৩-৫-১ কিংবা অন্য ফরমেশনে যখন সুইচ করছিল তখন চোখের সামনে এটি ঘটতে দেখে খুব ভালো লাগছিল। এই টেকনিক্যাল বিষয়গুলো গ্যালারির ওপরের অংশ থেকে এত ভালো বোঝা যায় যেটি উল্লেখ না করলেই নয়। ম্যান সিটি এত বেশি বল পজিশন রেখে খেলে এবং ডি-বক্সের সামনে এত পাস খেলে যে প্রতিপক্ষ দলের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। ফলে প্রিমিয়ার লিগের অন্য দুই সমশক্তির দলের খেলায় যে গতি থাকে, সেটি এই ম্যাচে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে সিটির খেলায় একটি বিষয় লক্ষণীয় ছিল, সেটি হলো হাই-প্রেসিং। ওরা বিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিতে ওস্তাদ দেখলাম। সঙ্গে নিজেদের পায়ে বল রাখার নিরন্তর প্রয়াস। ৬৮ মিনিট থেকে ৭২ মিনিট এই সময়ের মধ্যে সিটি একটানা নিজেদের মধ্যে পাস খেলে গেল। আর্সেনাল বলের ধারেই যেতে পারল না।
এই একটানা পাসিং ফুটবলকে কিছুটা যান্ত্রিক মনে হলো। পেপ গার্দিওলার বার্সার সেই স্বপ্নের দল যে ব্র্যান্ডের ফুটবল খেলত, সেখানে সৃষ্টিশীলতার অনেক বাতাবরণ ছিল কিন্তু সিটির এই ম্যাচে সেই সৃষ্টিশীলতার কোনো ছিটেফোঁটার দেখা পেলাম না। যেটি আমাকে হতাশ করেছে। ফুটবল মাঠে একজন সৃষ্টিশীল খেলোয়াড় যখন তার পায়ের জাদুর ছোঁয়ায় বিশেষ মুহূর্ত তৈরি করেন, সেগুলোই সমর্থকদের মনে বিশেষ দাগ কেটে থাকে। ফলনির্ভর আধুনিক ফুটবলে সেই সৃষ্টিশীলতা বোধ হয় হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে পুরো ম্যাচে সে ম্যাজিক্যাল টাচের কোনো দেখা পেলাম না। তবে এই পাসিং ফুটবলে দেখলাম সবচেয়ে ভালো মুহূর্ত তৈরি হচ্ছিল, যখন বিপক্ষ দলের জটলার মধ্যে সিটির তিনজন খেলোয়াড় নিজেদের মধ্যে তড়িৎ গতিতে পাস খেলে ট্রায়াঙ্গুলার শেপ তৈরি করছিল। এটি মাঠে বসে দেখতে অনবদ্য লাগছিল।
মাঠে বসে খেলা দেখার সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় হলো দর্শকের একাত্মতা। খেলার প্রতিমুহূর্তে দর্শকের প্রতিক্রিয়া বদলে যায়। বিপক্ষ দলের ডি-বক্সের সামনে বল গেলে সব দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে দলকে করতালি এবং গানের সুরের মাধ্যমে দলকে উজ্জীবিত করছে, আবার বিপক্ষ দল আক্রমণে উঠলে বিদ্রূপের সুরে এক অদ্ভুত শব্দব্রহ্ম তৈরি করছে। ওদিকে রেফারি নিজেদের বিপক্ষে ফাউলের বাঁশি বাজালে পুরো মাঠের গ্যালারি এমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে যে সামনে পেলে বোধ হয় উত্তমমধ্যম দিয়ে ছাড়বে। এভাবে আশা-নিরাশার দোলায় দোল খেতে খেতে ৯০ মিনিট পেরিয়ে গেল কিন্তু কোনো গোলের দেখা মিলল না। গোলের দেখা না পাওয়ায় সুপার সানডের উত্তাপ তেমনটা ছড়াল না। তারপরও একজন ফুটবলপ্রেমী হিসেবে চমৎকার কিছু সজীব স্মৃতি নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে সিটি সমর্থকদের সঙ্গে পায়ের তালে পা মিলিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম।
* লেখক: সুব্রত মল্লিক, পিএইচডি শিক্ষার্থী (১ম বর্ষ), ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য এবং সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান ৩১তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার।