আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস: কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দিন নয়
শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের ইতিহাস ও তাৎপর্য আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা সাধারণভাবে মে দিবস নামে পরিচিত। এটি বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, অধিকার ও মর্যাদার প্রতীক। প্রতিবছর ১ মে দিবসটি পালিত হয়, যা শ্রমিকশ্রেণির ন্যায্য দাবি ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি বৈশ্বিক প্রতীকী দিন। এটি শুধু ছুটির দিন নয়, বরং একটি ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী দিন, যেখানে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ, লড়াই ও বিজয়ের গল্প জড়িয়ে আছে।
মে দিবসের সূচনা ১৮৮৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে। সেই সময়ের শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ১ মে হাজার হাজার শ্রমিক কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসেন। এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ হলেও ৪ মে হে মার্কেট স্কয়ারে এক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশ ও শ্রমিকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে অনেকেই নিহত হন। এ ঘটনার পর বেশ কয়েকজন শ্রমিকনেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যাঁদের পরবর্তী সময়ে শিকাগোর শহীদ হিসেবে স্মরণ করা হয়। এ রক্তাক্ত আন্দোলনই আজকের মে দিবসের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বর্তমানে ৮০টিরও বেশি দেশে মে দিবস জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। এ ছাড়া অনেক দেশে এটি অঘোষিত বা বেসরকারিভাবে পালন করা হয়। এদিন শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন ও বিভিন্ন সমাজিক-রাজনৈতিক সংগঠন মিছিল, সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করে। বিভিন্ন দাবি, যেমন ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা হয়।
বাংলাদেশে মে দিবস ১৯৭২ সাল থেকে সরকারিভাবে পালন করা হচ্ছে। এ দেশের শ্রমিকসংগঠনগুলোও এদিন র্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও অন্যান্য কর্মসূচি পালন করে। ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, উন্নয়নের শপথ করি’—এ ধরনের স্লোগান দিয়ে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
১ মে শুধু একটি তারিখ নয়, এটি শ্রমিকশ্রেণির অধিকার–সচেতনতা, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও ঐক্যের প্রতীক। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে শ্রমিকেরা শুধু উৎপাদনের একটি অংশ নন, তাঁরা সমাজের ভিত্তি। তাঁদের অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্মান নিশ্চিত করা প্রতিটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
বাংলাদেশ সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে শ্রম আইন ২০০৬ প্রণয়ন করেছে, যা পরবর্তী সময়ে সংশোধন করে আরও আধুনিক করা হয়েছে। তা ছাড়া ন্যূনতম মজুরি বোর্ড, শ্রম আদালত, পেনশন ও বিমা পরিকল্পনা, কল্যাণ তহবিল এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু রয়েছে। সরকার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) অনেকগুলো কনভেনশনেও স্বাক্ষর করেছে। বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন ও সিভিল সোসাইটি সংগঠন দিনটি ঘিরে মিছিল, আলোচনা সভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করে। এসব কর্মসূচিতে শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক উন্নয়ন, ন্যায্য মজুরি, শ্রমিকদের সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়।
মে দিবসে শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বাস্তব কর্মসূচি ও সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে শ্রমিকদের সম্মান ও অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শ্রমিকদের উন্নয়নে যা করা উচিত—
১. শ্রমিকদের সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
যাঁরা কঠোর পরিশ্রম করে সমাজ ও দেশের উন্নয়ন ঘটান, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো উচিত। অফিস, কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের জন্য বিশেষ বক্তব্য বা সম্মাননা আয়োজন করা যেতে পারে।
২. সচেতনতামূলক কর্মসূচি
শ্রমিকদের অধিকার, দায়িত্ব, শ্রম আইন, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে সেমিনার ও ওয়ার্কশপ আয়োজন করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মিডিয়ায় মে দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করা।
৩. বাস্তবিক দাবিদাওয়া ও সমাধান খোঁজা
শুধু শোভাযাত্রা নয়, শ্রমিকদের প্রকৃত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া। ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ছুটির নিশ্চয়তা ইত্যাদি বিষয়ে সরকার ও মালিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ।
৪. সম্মিলিত আলোচনা ও সংলাপ
শ্রমিক, মালিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সংলাপের আয়োজন। শ্রম বিরোধ বা আন্দোলন এড়াতে পরস্পরের অবস্থান বোঝা এবং যৌক্তিক সমাধান খোঁজা।
৫. সাংস্কৃতিক ও মানবিক কর্মসূচি
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, গান বা কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম ফুটিয়ে তোলা। গরিব বা অসহায় শ্রমজীবীদের মধ্যে খাবার, বস্ত্র বা অর্থসহায়তা বিতরণ।
৬. ভবিষ্যতের উন্নয়ন–পরিকল্পনা
শ্রমিকদের জন্য প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে শ্রমিকদের অধিকার ও সুযোগ নিয়ে ক্যাম্পেইন চালানো।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি ও মর্যাদার স্বীকৃতি দেওয়ার এক ঐতিহাসিক দিন। এটি আমাদের শেখায়, অধিকার কেউ দেয় না, তা আদায় করে নিতে হয়। শ্রমিকদের সম্মান না দিলে উন্নয়ন কখনোই টেকসই হতে পারে না। তাই আসুন, মে দিবসে আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি—শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও সম্মান রক্ষায় আমরা সচেতন ও সক্রিয় থাকব।
বাংলাদেশে মে দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিক দিন নয়, এটি শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগ, অধিকারবোধ ও সংগ্রামের প্রতীক। দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে উন্নয়ন কেবল ভবন, রাস্তা বা বৈদেশিক মুদ্রায় সীমাবদ্ধ নয়; আসল উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন প্রত্যেক শ্রমিকের জীবনমান, অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত হবে। তাই মে দিবসে আমরা কেবল মিছিল বা শোভাযাত্রা নয়, শ্রমিকদের জীবনে বাস্তব পরিবর্তন আনার প্রতিজ্ঞা করি। শ্রমিকেরাই আমাদের অর্থনীতির চালিকা শক্তি এবং তাঁদের প্রতি সম্মান ও ন্যায়বিচার প্রদর্শন করেই আমরা একটি ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
লেখক: হাসিবুর রহমান, শিক্ষার্থী, ভারত