ছোট নানা সৈয়দ মুজতবা আলী স্মরণে

যাঁরা ক্যালিফোর্নিয়ায় চাকরি-বাকরি করেন, স্প্যানিশ জানা থাকলে তাঁদের জন্য অনেক সুবিধা হয়। কারণ, আমেরিকার এ অঙ্গরাজ্যজুড়ে বিশাল হিস্পানিক জনগোষ্ঠীর অবস্থান। এখানে স্কুলে যেহেতু বয়স ভিত্তিতে শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়, তাই ফোর্থ বা ফিফথ গ্রেড পড়াতে গিয়েও এমন অনেক ছাত্রের দেখা পেয়েছি, যাঁরা স্প্যানিশভাষী, আর ইংরেজিতে খুবই কাঁচা। হয়তো পরিবারটি মাত্র এসেছে মেক্সিকো, সালভেদর বা গুয়াতেমালা থেকে। ভাষা যে যোগাযোগ স্থাপনের কত বড় হাতিয়ার, তা তখন ভালোভাবেই টের পেয়েছি। চেষ্টা করেছি কিছুটা হলেও স্প্যানিশ ভাষাটা আয়ত্তে আনতে। কিন্তু আমার জন্য ব্যাপারটা বড়ই কষ্টকর ছিল! নিজেকে সাহস জোগাতে ভেবেছি আমার পূর্বপুরুষদের এক পুরুষ এক ডজনের বেশি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে জানতেন, আমি কি মাত্র তিনটাও সামাল দিতে পারব না?

সৈয়দ মুজতবা আলী চিরকালই জ্ঞানপিপাসু ছিলেন। শান্তিনিকেতনের প্রথম দিকের শিক্ষার্থী ছিলেন। তখন বিশ্বভারতীতে মুসলিম ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘মহামূল্যবান রত্ন’ চিনতে ভুল করেনি। সব বাধা পেরিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ মোট ১৫টি ভাষা জানা সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। আমার সৌভাগ্য, ছোট নানা, সৈয়দ মুজতবা আলীকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি।

সত্তরের দশক, ঢাকায় তখন হাই রাইজিং বাড়ি ছিল না বললেই চলে। আমরা তখন মগবাজারে থাকতাম। চারদিক সুনসান, নাই কোনো কোলাহল, ট্রাফিক জ্যামের প্রশ্নই আসে না। বাড়িগুলোও ছিল গাছগাছালিতে ছাওয়া। কখনো শুধু মায়ের সঙ্গে, কখনো পুরো পরিবারসহ প্রায়ই যেতাম নানার ধানমন্ডির ১ নম্বর সড়কের বাড়িটিতে। এ বাড়িটিতে যেতে, নানার পাশে বসে তার কথা শুনতে, নানুর দেখা পেতে, আমার বাবা-মায়ের ছিল প্রচণ্ড আগ্রহ। ছোট নানা তামাক খেতেন। মাঝেমধ্যে এ তামাকের জোগান দিতেন আমার আব্বা। তামাক ফুরিয়ে গেলে নানা, বাদামি পোস্ট কার্ডে জানান দিতেন তার জামাতা, আমার আব্বাকে। ছোটবেলায় নানার সেই হাতের লেখা অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখার মতোই মনে হতো আমাদের। মায়ের হাতের চটপটি আর পুডিং খুব মজা হতো। মা প্রায়ই খাবার রান্না করে ছুটতেন তার হুরু মামা আর মামিকে দেখতে। তখন ধানমন্ডি থেকে মগবাজারের দূরত্ব অনেক মনে হলেও যাওয়া যেত নির্ঝঞ্ঝাটভাবে।

বাবা, মা দুজনেই নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকতেন। তারপর ছিল আমাদের তিন ভাই–বোনের স্কুল, লেখাপড়া। বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে সময় নির্ধারণ করে বের হলেও নানার পাশে বসলে সময়ের ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলতেন বাবা মা দুজনই। যত দূর মনে পড়ে নানা নিজেও প্রচণ্ড উপভোগ করতেন এই আড্ডা। সেই গতিময় আড্ডার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িয়ে থাকত রসবোধ, আর জ্ঞানের স্ফুরণ। এ সময়ে আত্মীয়স্বজনসহ আরও অনেকেই ছুটে যেতেন নানার বাসায়, তাঁর সঙ্গে আড্ডায় মশগুল হতে। নানার সাহচর্য, রসবোধ আর জ্ঞানের ভান্ডারে মন্ত্রমুগ্ধ আব্বা আম্মা, একসময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরতেন বাসায়।

আমার স্মৃতিতে নানা, মুজতবা আলী দেখতে ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল, একজন চৌকস মানুষ। অবাক হতাম নানা যখন প্রিয় কোনো খাবারের রেসিপি বলে দিতেন গড়গড় করে। আমার তখন হালকা হলুদ রঙের টপস আর বেলবটমের একটা প্রিয় সেট ছিল। প্রায়ই পরতাম সেটা। মনে পড়ে নানা বলে ছিলেন, এটার সঙ্গে একটা বেল্ট মন্দ লাগবে না। আসলেও টপসের বেল্টটা প্রথম দিনই কোথাও হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি, যার জন্য মায়ের বকুনিও সয়েছিলাম। এখনো মনে আছে সেই ছোট্ট বয়সে অবাক বনেছিলাম প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের বহর দেখে। দুর্ভাগ্য আমার অল্প বয়স আর অপরিপক্ব মেধার কারণে, সম্যকভাবে নানা, সৈয়দ মুজতবা আলীর পাণ্ডিত্য, মেধা ও সৃজনশীলতার ব্যাপকতা পুরোপুরি উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি আমার।

যত দূর মনে পড়ে পিতলের বার দিয়ে তৈরি ছিল নানার খাটের হেডরেস্ট। কখনো নানা সে খাটে বসে, বাকিরা তাঁকে ঘিরে, কখনো বা খাবার টেবিলে চলত আড্ডা। ওই বাসার বাড়তি আকর্ষণ ছিল বাগানের ডাসা পেয়ারা! আমার দুই মামা ফিরোজ আর কবির বরাবরই নিপাট ভালো মানুষ। গান ভালো বসেন দুজনই। ফিরোজ মামার হাত ধরে গিয়েছি ‘বাংলাদেশ বেতারের’ ছোটদের আসর, পরে ‘স্কুল ব্রড কাস্টে’ অংশ নিতে। আমাকে গান শেখাতে উৎসাহ দিতে মামা তাঁর চেনা অনেক স্বনামধন্য ক্ল্যাসিক্যাল শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বলা বাহুল্য, কোনো সুযোগই কাজে লাগাতে পারিনি আমি।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, নানু রাবেয়া খাতুনের কথা আমার স্মৃতিতে আরও বেশি স্পষ্ট। ১৯৭৪–এ নানা চলে যাওয়ার পর নানু আর মাত্র দুই বছরের মতো বেঁচে ছিলেন। নানুর ছিল বিশাল বইয়ের ভান্ডার। মনে আছে নানু দু–চারটি করে বই ধার দিতেন বাড়িতে নিয়ে পড়ার জন্য। তখনকার দিনে এ ছিল অনেক বড় পাওয়া! নানু সব সময় উৎসাহ দিতেন, বই পড়ার জন্য আর বইয়ের যত্ন নিতে। মনে পড়ে নানুর মৃত্যুর পরদিন স্কুলে আমরা সবাই তাঁর সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেছিলাম। ছোটবেলায় নিজের নাম জানাতে গিয়ে, নামটি যে মা, বাবা ‘আমার নানার’ লেখা বই ‘শবনম’ থেকেই নিয়েছিলেন, সে প্রসঙ্গ টেনে আনতে কখনো ভুল হতো না। আরও অনেক পরে, ‘শবনম’ পড়ার পর অনুধাবন করেছিলাম আসলেই, ‘এমন শিক্ষণীয় প্রেমের উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে আর একটিও নেই।’ ফিরোজ মামার কাছে জেনে ছিলাম, তার বাবা সৈয়দ মুজতবা আলীকে এক উৎসাহী পাঠক নাকি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘শবনম ভাবি কি পরে ফিরে এসেছিলেন?’ এ প্রশ্নটি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে আপনাকে ‘শবনম’ পড়তে হবে।

আমার যখন নানার বই পড়ার ও বোঝার বয়স হয়, তত দিনে নানা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। শৈশবে স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ‘দেশ-বিদেশে’ থেকে নেওয়া সৈয়দ মুজতবা আলীর কাবুলবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর সরস বর্ণনায় লেখকের পরিচারক ‘আবদুর রহমানকে’ আমরা যেন চোখের সামনে দেখতে পেতাম। ধানমন্ডির সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই গোলাকার আকৃতির বাড়িটি আজ আর নেই, নেই সেদিনের অনেক প্রিয় জন। আমার স্মৃতি থেকে হারিয়ে গেছে অনেক ঘটনা।

স্মৃতির ব্যাপারটা বড়ই অদ্ভুত, অতীতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই আমরা মনে রাখতে পারি না। কিন্তু মস্তিষ্ক অতীত থেকে বেঁছে নেওয়া কিছু ঘটনা যেন ‘হাই লাইটার’ দিয়ে রাঙিয়ে চির জীবন্ত করে রাখে আমাদের স্মৃতির পটে। আমার এখনো কানে বাজে নানা চলে যাওয়ার পর অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে নানুর উক্তি, ‘ফিরোজ, কবির তোরা কী হারালি বুঝলি না।’

সময়টা ছিল ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস।

*লেখক: শবনম চৌধুরী, এলিমেন্টারি স্কুল টিচার, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র