দরজা খোলা রেখে জানালা পাহারার শিক্ষাব্যবস্থা; যেখানে পরিবর্তন প্রয়োজন

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই কোচিং সেন্টার, গাইড বই বিষয় দুটি সামনে আসে। সবাই শুরুতেই কোচিং সেন্টার বা গাইড বইয়ের পক্ষে–বিপক্ষে কথা বলা শুরু করেন, কিন্তু কেনই–বা এগুলোর প্রচলন হয়েছিল বা টিকে আছে কিংবা বিকল্প কী, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।

প্রথমে আসি গাইড বইয়ের ব্যাপারে। গাইড বইয়ের কাজ হচ্ছে প্রশ্নোত্তর দেওয়ার উপায় শেখানো, আরও সোজাসুজি বললে উত্তর বলে দেওয়া। উত্তর জানার মধ্যে ক্ষতি নেই, যদি এটিতে নতুন করে কিছু জানার আগ্রহ তৈরি হয়, অথবা এমন কোনো তথ্য জানা হয়, যেটা জানা ছিল না, অথবা ‘জেনে রাখা ভালো হতো’। কিন্তু গাইড বইয়ের কোনোটাই করে না, এখানেই গাইড বই বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ আসে।

গাইডের ব্যবহার মূলত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই উদ্বুদ্ধ করে। জ্ঞান আহরণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলেও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থাটা কাঠামোবদ্ধ, এখানে শিক্ষার্থীর আগ্রহের খুব বেশি দাম নেই। আর জ্ঞান আহরণের জন্য যে শিক্ষার্জন, সেখানে মূল চালিকা শক্তিই হচ্ছে ব্যক্তির আগ্রহ। প্রচলিত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় আপনার পছন্দের বিষয়ে বাড়তি কোর্স কিংবা অপছন্দের বিষয় বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই এখানে জ্ঞান অর্জন একটি বাইপ্রোডাক্ট মাত্র; মূল কাজ হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানের কতটা আয়ত্ত করতে পেরেছেন সেটা প্রমাণ করা অর্থাৎ পরীক্ষায় ভালো নম্বর তোলা। কারণ, আপনার ঠিক পরের ধাপেই এটা দেখা হবে আপনি গত পরীক্ষায় কত নম্বর পেয়েছেন, কিন্তু এটা কেউ জানতে চাইবে না আপনি ঠিক কতটা শিখতে পেরেছেন, অথবা আপনি পাঠ্যবইয়ের বাইরে কী শিখেছেন। আপনি যদি আপনার পছন্দের বিষয় নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে অপছন্দের বিষয়টিতে আশানুরূপ ফলাফল করতে না পারেন, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপনাকে ভুগতে হবে, কারণ আমাদের জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর অভাব নেই। অতএব, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি মূল্যায়ন ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে। তাই স্বপ্নচারী না হয়ে আমাদের পাঠ্যবইগুলোকে অবশ্যই মূল্যায়ন ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তৈরি করতে হবে।

আমাদের সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নগুলো মূলত চার ভাগে বিভক্ত। জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা। ‘জ্ঞান’ হচ্ছে মূল উত্তরটা এক লাইনে লেখা, ‘অনুধাবন’ হচ্ছে কিছু সাধারণ (জেনারেল) তথ্য দেওয়া বা ‘জ্ঞান’ অংশের লজিক্যাল প্লট উপস্থাপনা করা; ক্ষেত্রবিশেষে ‘জ্ঞান’ অংশের ছোটখাটো ব্যাখ্যা দেওয়া। ‘প্রয়োগ’ তো নাম দেখেই বোঝা যায়; আপনার বই থেকে শেখা জ্ঞান বা ধারণাটা উদ্দীপকে ব্যবহার করা। আরও সহজভাবে বললে দুটি প্লটের তুলনা করে আপনার জানা বিষয়ের দ্বারা নতুনটাকে মূল্যায়ন করা। আর, ‘উচ্চতর দক্ষতা’ আসলে নামের মতো এত উচ্চতর কিছু নয়, সহজভাবে বললে ‘প্রয়োগ’ অংশের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে নিজের মতামত দেওয়া।

তাহলে গাইড বইয়ের দরকার মোটাদাগে তিন জায়গায়; ১. কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে সেই ধারণা নেওয়া, ২. জ্ঞান এবং অনুধাবন অংশে কী লিখতে হবে তা জানতে এবং ৩. কীভাবে গুছিয়ে লেখা যায় সে ধারণা নিতে। এখন আমরা যদি গাইড বই কিনতে না চাই তাহলে খুব স্বাভাবিকভাবেই পাঠ্যবইয়ে প্রতিটি টপিকের জন্য কমপক্ষে একটি করে ‘উচ্চতর দক্ষতা’ প্রশ্ন থাকতে হবে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পাঠ্যবইগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেন আপনাকে মূল্যায়ন ব্যবস্থা বোঝার জন্য এবং প্রশ্নের উত্তর করার জন্য গাইড বইয়ের শরণাপন্ন হতে হবে। যেখানে আমাদের মূল্যায়ন ব্যবস্থা হচ্ছে সৃজনশীল পদ্ধতি, সেখানে প্রতিটি পাঠ্যবইয়ে ১৫-২০ টপিকের একটা অধ্যায়ে সব মিলিয়ে সৃজনশীল প্রশ্ন থাকে একটি কিংবা সর্বোচ্চ দুটি। বলা বাহুল্য, এত অল্পসংখ্যক প্রশ্ন থেকে পরীক্ষার সময় প্রশ্নগুলো কেমন হতে পারে, তা ধারণা করা অসম্ভব। তাই সৃজনশীল প্রশ্ন কেমন হতে পারে, এ ধারণার জন্যও অন্তত শিক্ষার্থীদের গাইড বই কিনতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি আসে তা হচ্ছে, প্রশ্নোত্তর করার পদ্ধতি এবং কোন ধরনের উত্তর সেরা হবে, সেটি জানা।

দুঃখজনকভাবে আমাদের কোনো পাঠ্যবইয়ে ভুলেও কোনো সৃজনশীল প্রশ্নের নমুনা উত্তর দেওয়া নেই। যদি আগের শিক্ষাব্যবস্থার মতো রচনামূলক প্রশ্নোত্তর থাকত, তবে এই উদ্বেগটা আসত না। কারণ, সেখানে শুধু জ্ঞানটাই যাচাই করা হতো, সুতরাং আপনাকে শুধু মুখস্থ করে সেটা উত্তরপত্রে উগরে দিতে হতো, এর বেশি কিছু নয়। অথচ সৃজনশীল পদ্ধতি পুরোপুরি ভিন্ন; তাহলে শিক্ষার্থীরা কীভাবে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং কী উত্তর দিতে হয়, এগুলো খোয়াবে পাবে? আমরা মূল্যায়নপদ্ধতি পরিবর্তন করেছি কিন্তু মূল্যায়নপদ্ধতির আলোকে পাঠ্যবই যে পরিবর্তন করতে হবে, সেটা অনুধাবন করতে পারিনি। ঠিক এ কারণেই সৃজনশীল মূল্যায়নপদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও গাইড বই বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।

এবার আসি কোচিং সেন্টারের ব্যাপারে। কোচিং সেন্টারের ভালো–খারাপ দুই দিকই আছে। খারাপ দিক হচ্ছে কোচিং সেন্টার বাণিজ্যিক কারণে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বেশি করে মূল্যায়ন ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকিয়ে দেয়। কিন্তু এ কারণে কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করে দেওয়া সমীচীন নয়। কারণ, অন্তত কোচিং সেন্টারগুলোতে প্রতিযোগিতা শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে। বাণিজ্যিক প্রয়োজনে পাঠদান কার্যক্রমকে আরও বেশি জ্ঞাননির্ভর এবং আনন্দদায়ক করতে অধিকাংশ কোচিং সেন্টারের শিক্ষকদের ‘কন্টিনিউয়াস লার্নিং’ এবং ‘ইফেক্টিভ টিচিং’ মেথডগুলো ফলো করতে হয়। আমি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল-কলেজে দু–একজন শিক্ষক ছাড়া কাউকেই লেকচারের আগের দিন ওই বিষয় সম্পর্কে পড়ে আসতে দেখিনি বা শুনিনি। কলেজে তো অনেকে আবার নিজের চাকরিজীবনের শুরুতে তৈরি করা শিট অথবা পাঠ্যবই দেখে দেখে বোর্ডে লিখে এবং সেই লেখা মুখে বলেই ক্লাস টাইম পার করে দিতেন। অবশ্য মুদ্রার ওপিঠের শিক্ষকেরাও ছিলেন, যাঁরা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে পড়াতেন এবং পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক কিছু পড়িয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন আদর্শ শিক্ষকের পরিমাণ খুবই কম থাকায় আমার কোচিং সেন্টারে পড়তে হয়েছিল। সে জন্য কোচিং সেন্টার সম্পর্কে আমার অবজারভেশন আর শিক্ষাবিদদের অবজারভেশনের মধ্যে অনেক তফাত রয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী কোচিং সেন্টারে পড়েছে এবং যারা কোচিং সেন্টারে পড়েনি, তাদের পরীক্ষার রেজাল্টের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা অথবা এইচএসসি পরীক্ষায় কোচিং সেন্টার পড়ুয়া এবং কোচিং সেন্টারে না পড়া শিক্ষার্থীদের রেজাল্টের তুলনা করেন, তাহলে বুঝতে পারবেন কোচিং সেন্টারগুলো পড়ানোর ব্যাপারে কতটা আন্তরিক। ‘বেসিক ক্লিয়ার করে পড়া’ আইডিয়াটা কিন্তু বাংলাদেশে কোচিং সেন্টারগুলোই প্রথম শুরু করেছে। আর টেন মিনিট স্কুল, অন্য রকম পাঠশালার মতো উদ্যোগগুলো কিন্তু কোচিং সেন্টারগুলোরই তৈরি।

এবার প্রশ্ন হলো যদি কোচিং সেন্টারগুলো এতই ভালো হয় তাহলে উন্নত বিশ্বে কেন কোচিং সেন্টারের বিরোধিতা করা হয়। উত্তর হচ্ছে প্রেক্ষাপট, তাদের শিক্ষাব্যবস্থা আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে দিন-রাত তফাত রয়েছে। তারা শিক্ষাকে আনন্দময় করে তুলতে পেরেছে কিন্তু আমরা পারিনি, আর সেটা করাও অনেক কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। তাই আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কোচিং সেন্টার বন্ধ করার কোনো কারণ দেখি না, তবে প্রশ্ন ফাঁসের কারণে পাবলিক পরীক্ষাকালীন কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। ভালো করে শেখার কিংবা শেখানোর মধ্যে তো কোনো দোষ নেই। দ্বিতীয়ত, যে বিষয়টি আসে তা হচ্ছে স্কুল-কলেজশিক্ষকদের নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো। এখানে মূলত দুটি বিষয়ের কাজ করতে পারে।

১. বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা বিষয়বস্তুগুলো ভালোভাবে বোঝানোর মতো যথেষ্ট সময় পান না, ২. শিক্ষকেরা নিজেদের বেতন-ভাতা নিয়ে সন্তুষ্ট নন, জীবন পরিচালনার জন্য তাঁদের অধিক অর্থের প্রয়োজন। প্রথম কারণটি সমাধানের জন্য বিদ্যালয়ে বিষয় সংখ্যা এবং প্রতিটি বিষয়ে টপিক সংখ্যা কমানো কাজে দিতে পারে। পাশাপাশি প্রতিটি ক্লাসের জন্য সমান ৪৫ মিনিট করে সময় বরাদ্দ না রেখে মূলধারার বিষয়ে অধিক সময় এবং অন্যান্য বিষয়ে কম সময় দেওয়া যেতে পারে। আর দ্বিতীয়টির জন্য শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো উচিত। এ খাতে ব্যয় বাড়ানোর সহজতম উপায় হচ্ছে সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি কমানো।

বি. দ্র. আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত নই। অদূর ভবিষ্যতে কোচিং সেন্টার রিলেটেড কোনো কিছু শুরু করার পরিকল্পনাও নেই। সুতরাং কোচিং সেন্টার–সম্পর্কিত আমার মতামতে কোচিং সেন্টারকে রক্ষা করার মতো কোনো প্রভাবকই কাজ করেনি।

*লেখক: মো. জুবায়ের আহমদ, শিক্ষার্থী, মেমোরিয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউ ফাউন্ডল্যান্ড, কানাডা