রমজান মাসের স্মৃতি
আমাদের শৈশবে পবিত্র রোজা ছিল শীত ঋতুতে। রমজান মাসের ভোররাতে আব্বা ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। শীতের জন্য বিছানায় বসে পিঠে লেপ জড়িয়ে ভাত খেয়েছি। ঘুম থেকে ডেকে তোলার সময় আব্বা বলতেন, তুই দুপুরে আবার ভাত খাবি, তাহলে তোর দুইটা রোজা হবে। পরে বুঝেছি, রোজা রাখতে অভ্যাস তৈরি করার জন্য এটি একটি প্রশিক্ষণ। আমার ছেলেমেয়ের বেলায়ও আব্বার এই সহজ পদ্ধতি অনুসরণ করেছি। প্রতিবছর রমজান মাসের প্রথম চাঁদ দেখার পর মা বারান্দায় চেয়ারে বসে মোনাজাত করতেন। অভিবাসী হওয়ার কারণে ২২ থেকে ২৩ বছর যাবৎ রমজান মাসের প্রথম চাঁদ না দেখেই রোজা শুরু করি এবং দুই ঈদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
১৯৭২ সালে এসডিও অফিস থেকে সাইরেন বাজানোর জন্য একটি যন্ত্র দেওয়া হলো মসজিদে। ওস্তাদজি বললেন, তুই বিয়াইন্না রাইতে আইয়া সাইরেন বাজাবি। কৈশোরে রমজান মাসের ভোররাতে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে মসজিদের ছাদে উঠে সাইরেন বাজিয়েছি। মধ্যরাতে ছাদে দাঁড়িয়ে ম্যানুয়েল মেশিনের হাতলে ঘুরিয়ে শরীরের শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হতো। ব্যাটারিচালিত হ্যান্ডমাইকের প্রচলন শুরু হয়নি সে সময়ে। মাইকের আদলে তৈরি হাতলবিশিষ্ট টিনের চোঙা নিয়ে মহল্লার উত্তর থেকে দক্ষিণে ভোররাতে হেঁটেছি। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সাহ্রির জন্য ডেকেছি, রাত তিনটা বাজে, উঠুন সাহ্রি খান।
স্বাধীনতার আগে সাহ্রির জন্য ভোররাতে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মহল্লায় এসে গান গেয়ে ডাকত সবাইকে। এই দলকে কাসিদা বলা হতো তখন। শবে কদরের রাতের পর থেকে দিনের বেলায় মহল্লায় এসে ভিন্ন সুরে গান গেয়ে সালামি চাইত।
মসজিদে তারাবিহর নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিতে হতো। দিনের বেলায় মসজিদ পরিষ্কার করে সন্ধ্যার আগে মসজিদের বারান্দায় হোগলা বিছিয়ে দিয়েছি। তারাবিহর নামাজ শুরুর দিকে মসজিদ ভরে যেত।
রাতে নামাজ শেষ হলে যথারীতি হোগলা টেনে নিয়ে গুছিয়ে রাখতে হতো। তারাবিহর নামাজের পর বন্ধু শফিউদ্দিনকে নিয়ে হেঁটে নিউ মেট্রো সিনেমা হলের মোড়ে গিয়ে আখ কিনেছি। আখ চিবানো ও আড্ডা—একসঙ্গে দুটোই চলত আমাদের তখন।
অনেকেই মসজিদে ইফতারি দিয়ে যেতেন। আসরের নামাজের পর থেকে ইফতারি গ্রহণ ও বণ্টন সেশন চলত। ইফতারি খাওয়ার জন্য মসজিদে মাটির তৈরি ছোট পাত্র ব্যবহৃত হতো তখন। এটির নাম খোরা।
খোরায় ইফতারি দেওয়া হতো মুসল্লিদের। বালতিতে রাখা হতো আখের গুড়ের শরবত। মাগরিবের নামাজের পর সব ধুয়ে গুছিয়ে রেখে বাসায় ফিরেছি। এ ছাড়া আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বাসায়ও ইফতারি দেওয়ার প্রচলন ছিল।
মসজিদে তারাবিহর নামাজ পড়ানোর জন্য পবিত্র কোরআনের হাফেজ রাখা হতো। রমজান মাসের চাঁদ দেখার আগে আসরের নামাজের পর হাফেজ সাহেবের ইন্টারভিউ হতো। তিনি মাগরিব ও এশার নামাজের ইমামতিও করতেন। চন্দ্রবর্ষ ছোট হওয়ার কারণে স্বাধীনতার পর রমজান মাস এল গ্রীষ্মে। সবার ঘরে রেফ্রিজারেটর ছিল না। মহল্লার মোড়ে চটের বস্তার ওপর বরফ রেখে তুষ দিয়ে ঢেকে নিয়ে বিক্রি করত। বিক্রেতা বরফ ভাঙার জন্য বড় গজাল ও বাটখারা ব্যবহার করতেন। ঠান্ডা পানি ও শরবত খাওয়ার জন্য ইফতারের একটু আগে সবাই বরফ কিনে নিত। শেষ মুহূর্তে বরফ ক্রয়ের জন্য সবাই দৌড়ে আসত।
‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’। ঈদের চাঁদ দেখাটাও ছিল উৎসবের মতো। চাঁদ দেখা গেলে শিশু–কিশোরদের দল রাস্তায় এসে পটকা ফুটাত। আব্বা ডাকতেন, আয় চাঁদ দেখি। ঈদের দিন সকালে জাতীয় পতাকা বাঁশের কঞ্চিতে বেঁধে আমাকে ডেকে বলতেন, আয় ধর। ঈদ উপলক্ষে দৈনিক পত্রিকা ও সাপ্তাহিক পত্রিকা ঈদসংখ্যা প্রকাশ করত। ঈদের আগেই সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সন্ধানী, রোববার সংগ্রহ করেছি। বিটিভি সাদা কালোয় ঈদ অনুষ্ঠান প্রচার করত। ছিল আমজাদ হোসেনের নাটক, জবা কুসুম রোকন দুলালের মা–বাবার গল্প। এবং সপ্তবর্ণা অনুষ্ঠানে জুয়েল আইচের মনভোলানো হাসি।