স্বপ্নের আমেরিকা

অলংকরণ: আরাফাত করিম

শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাবে তারা। তারা বলতে আশিসের ভাই শিশিরের এবং জয়ার ভাই রবি ও তার স্ত্রী। ৩৫ বছর হলো, আশিস-জয়া যুক্তরাষ্ট্রে আছে। আশিস কুয়েতে আট বছর কাজ করেছে। তার মনিব বিশ্বব্যাংকের বড় কর্মকর্তা ছিলেন। একসময় যুক্তরাষ্ট্রে ট্রান্সফার হন তিনি। একই সময় আশিসও চলে আসে তার মনিবের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার জন্য, তিনিই আশিসের সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরের বছর দেশে গিয়ে বিয়ে করে আশিস। দুই বছর পর, তার স্ত্রী জয়াকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে। আশিসের মনিব পাঁচ বছর পর ইতালিতে চলে যান। কিন্তু আশিস সেখানে যায়নি। পরে জয়া ও ছয় মাসের কন্যা নীপাকে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বাঙালি অধ্যুষিত, মেরিল্যান্ডের সিলভার স্প্রিং এলাকায় চলে আসে। দুই কন্যা নীলা এবং এক পুত্র নিউটনকে নিয়ে এখন এখানেই বসবাস করছে তারা। আশিস মেরিল্যান্ডে এসে ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড ও ভার্জিনিয়ায় বসবাসরত বাঙালিদের নিয়ে গড়ে তোলে ‘ঠিকানা: বাংলাদেশ’ নামে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। তার বস চলে যাওয়ার পর, একটি ক্লাবে কাজ নেয় আশিস। কাজের পাশাপাশি ‘ঠিকানা: বাংলাদেশ’কে সময় দেয়। তার অবসরে নিজের বাড়ির যত্ন নেওয়া ও সামারে সবজি বাগান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সমাজের মানুষের ডাকে সাড়া দিতে চেষ্টা করে।

জয়া যুক্তরাষ্ট্রে আসার ১০ বছর পর, তার ছোট বোন জলি, স্বামী রতনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আসে। রতন এ দেশে উচ্চতর পড়াশোনা করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরে রতন তার মা-বাবাকেও যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও মা-বাবাকে নিয়ে, তারা এখন কালিফোর্নিয়ায় বসবাস করছে। জলি-রতন সামারে-বড়দিনে যেমন মেরিল্যান্ডে বেড়াতে আসে, তেমনই আশিস-জয়া কালিফোর্নিয়ায় যায়। আশিস-জয়ার মতো, তারাও বেশ ভালো আছে সেখানে।

আশিস ও জয়ার সন্তানেরা বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলে, ‘অফকোর্স, বাংলাদেশ ইজ আ বিউটিফুল কান্ট্রি! ইউ ক্যান ভিজিট দিস কান্ট্রি। বাট ইউ কান্ট লিভ দেয়ার পারমানেন্টলি। মেনি পিপল আর লিভিং দেয়ার। বাট উই কান্ট!’ হ্যাঁ ওদের বেলায়, এমন মন্তব্য করাই স্বাভাবিক। তবে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে, বেড়াতে গেছে ওরা। কিন্তু ছয় মাসের বেশি থাকেনি। তারা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। বয়সে যেমন। মানুষ হিসেবেও তেমন। নীপা রেজিস্টার্ড নার্স, নীলা ডাক্তার এবং নিউটন ইঞ্জিনিয়ার। তাদের বিয়েশাদি হয়েছে। আশিস-জয়া, বাংলাদেশ থেকে নীপার, নীলার স্বামী সজল ও মিলনকে এবং নিউটনের স্ত্রী লতাকে পছন্দ করেই এনেছিল। এখন তাদের ঘরে সন্তানাদিও আছে।

আশিসের ছোট ভাই শিশির ও জয়ার একমাত্র ভাই রবি স্বপ্ন দেখে এসেছে, একদিন তারা স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাবে! সেখানে স্থায়ী হবে। আমেরিকান হবে। এবং ‘সেই রকম’ হবে তাদের অবস্থা! তো যুক্তরাষ্ট্র থেকে কয়েক দফায় চিঠি পেয়েছে এই দুটি পরিবার।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

যুক্তরাষ্ট্রে এসে জয়া-জলি, ধুমধাম করে তাদের একমাত্র ছোট ভাই রবিকে বিয়ে করায়। রবির স্ত্রী রিতারও স্বপ্ন ছিল, সে স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্রে যাবে। তারপর তার মা–বাবারও যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ হবে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে রবি-রিতার নামে কাগজপত্রও এসেছিল। তাদের নামে আসা কাগজপত্র দেখে রিতার স্বপ্ন আরও রঙিন হতে শুরু করে। কিন্তু তার সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি আর! বিয়ের তিন বছর পর, ব্রেন-হেমারেজে নিঃসন্তান রিতা মৃত্যুবরণ করে। সহসাই রিতার মা-বাবার স্বপ্ন ভেঙে যায়!

রিতা মারা যাওয়ার পর, রবি তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। রিতার মৃত্যুর এক বছর পর, ঝরনাকে বিয়ে করে সে। জয়াই জোর করে ভাইকে বিয়ে করায়। জয়া তার বাউন্ডেলে ভাই, রবির সংসার নিয়ে ভাবে। জলিও তাই করে। ভাইয়ের জীবন সুন্দর করার জন্য, এ যাবৎ সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে এসেছে জয়া ও জলি দুই বোন! জয়া ভাবে, ‘মানুষের ভাগ্য যে কীভাবে মোড় নেয়, তা বোঝা বড় কঠিন বিষয়। কোথাকার মেয়ে ঝরনা। রবির বউ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসছে সে!’ রবি-ঝরনার বিয়ের ছয় বছর চলছে।

বিয়ের আগে, যুক্তরাষ্ট্র কোথায় তাও জানত না ঝরনা। বিয়ের পর, সে জানতে পেরেছে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরের একটি সুন্দর দেশ! সেই দেশের মানুষের অনেক টাকা! টাকা না, ডলার। তার স্বামী রবি, বিশেষ কিছুই করে না। রবির দুই বোন জয়া-জলি যুক্তরাষ্ট্র থেকে রবির নামে ডলার পাঠায়। সেই ডলার বাংলাদেশে এলে, অনেক টাকা হয়! বড় বোনদের পাঠানো টাকায়ই চলে রবি। গ্রামে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেয়। মদ খায়। তাস খেলে। মোটরবাইক নিয়ে মাতামাতি করে। ঘন ঘন মোবাইল ফোন বদলায়! জামা-কাপড় কেনে। আরও কত কী! ঝরনা তার মা-বাবাকে বলে রেখেছে, ‘দিন আর বেশি বাকি নেই! আমাদের মতো তোমাদেরও লাগেজ গোছাতে হবে। তাই এখন থেকেই কেনাকাটা শুরু করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রে অনেক শীত! সেই দেশের মানুষ, স্যুটকোট ও গরম কাপড় পরে! তোমরাও তো বেশ বুড়ো হয়ে গেছো! তাই তোমাদের অনেক কাপড়চোপড় লাগবে। দেশ থেকে নিলে, কম টাকায় অনেক কাপড় কিনতে পারবে। চিন্তা করো না। টাকা যা লাগে, আমিই ব্যবস্থা করব!’ জয়ার মা-বাবাও ভাবেননি, একদিন তাদের মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের লাইনে থাকবে। এখন তাঁরাও স্বপ্ন দেখছেন, মেয়ে জয়ার সুবাদে তাঁরা স্বপ্নের আমেরিকা যাবেন একদিন।

শিশির, তার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা এবং রবি-ঝরনা সবকিছু গুছিয়ে এনেছে। তাদের আশা, খুব শিগগিরই তারা ‘ফাইনাল চিঠি’ পেয়ে যাবে। তারপর সবাই মিলে উড়াল দেবে, স্বপ্নের আমেরিকার উদ্দেশে। আশিস শিশির ও রবিকে বলত, ‘আর কয়েকটা দিন মাত্র! এখানে আমি সবকিছু তৈরি করে রেখেছি। তোরা এলেই হাতের কাছে সব পেয়ে যাবি। এখানে তোদের কাজ, বাচ্চাদের স্কুল, বাড়িঘর সব তৈরি।’ জয়াও রবি-শিশিরকে ঠিক তাই বলত। তাদের সবার একই আশা ও রঙিন স্বপ্ন, আগে তো ‘ফাইনাল চিঠি’ পাওয়া। তারপর ভিসা! বিমানের টিকিট। এবং সবশেষে ‘স্বপ্নের আমেরিকা’, বাস্তবে ধরা দেবে! অল্প সময় মাত্র বাকি!

এরই মধ্যে শুরু হয়েছে করোনা মহামারি। তার দানবীয় দাপটে পুরো দুনিয়া ওলট-পালট হয়ে গেছে! কী বাংলাদেশ। কী যুক্তরাষ্ট্র। এবং কী বাকি সব দেশ। সবখানেই প্রায় অভিন্ন চিত্র। বাংলাদেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চিত্র তো হয়ে উঠেছিল আরও ভয়ানক! যেন এক মহাপ্রলয় ঘটে গেছে সেখানে! সর্বত্রই শুধু লাশের মিছিল! হাসপাতালে, মরচুয়ারিতে ঠাঁই নেই! এমনকি কবর দেওয়ার জায়গাও নাকি মেলেনি! অনেক জায়গায় এমনকি পার্কেও কোনো রকমে, একসঙ্গে অগণিত লাশ একসঙ্গে মাটি চাপা দিতে হয়েছে! যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় ভাই আশিস ফোনে শিশিরের খোঁজখবর নিত। সে বলত, ‘তোরা থাকিস সাবধানে। বাংলাদেশ বলে কথা!’ শিশিরের জয়া-বউদিও তার ভাই রবিকে, সাবধান করত। ওদিকে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে জলিও রবিকে সাবধান করত।

করোনার দোর্দণ্ড দাপটে সারা জগৎ নাজেহাল! ঘোরতর এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে একদিন শিশির তার ভাইপো নিউটনের ফোন পায়। নিউটন বলে, ‘বাবার করোনা হয়েছে! এখন বাবা হাসপাতালের আইসিইউতে আছেন। অবস্থা খুবই খারাপ! তাঁর জন্য প্রার্থনা কর!’ নিপা-নীলাও ফোন করেছে বারবার। তাদের বাবার জন্য প্রার্থনা করতে বলেছে। শিশির ও তার স্ত্রী মায়া কল্পনাই করতে পারেনি, আশিসের করোনা হবে! যে ভাই বারবার তাদেরকে সাবধান করেছে; আজ সেই করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে! ভাবা যায়? আশিস হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পাঁচ দিনের দিন, শিশির ও রবির পরিবার দুঃসংবাদটি জানতে পারে। নিপা ফোন দিয়ে শিশির ও রবিকে জানিয়েছে, ‘বাবা আর নেই! তাঁকে বাঁচানোর সব ধরনের চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়ে, আমাদের সবাইকে ছেড়ে বাবা চলে গেছে!’ মুহূর্তেই তাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে! এ যেন বিনা মেঘে, বজ্রপাত! তারা বুঝে নিয়েছে, নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার এবং এ জগতের মায়া ত্যাগ করে আশিস পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। শিশির নিজেকে অসহায় ভেবে বুক চাপড়াতে শুরু করে! তার মাথার ওপর যে গাছটা এতদিন ছায়া দিয়ে এসেছে, অকালেই সমূলে তার পতন হয়েছে!

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

যুক্তরাষ্ট্র যাবে বলে দেশ থেকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও শেরাটনের শেফের সার্টিফিকেট জোগাড় করে রেখেছিল রবি। এমনিতেই রান্নার কাজ ভালো জানে সে। কুয়েত থেকে দুই বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। গ্রামেও কিছুদিন ‘উৎসব-ডেকোরেটর’ প্রতিষ্ঠানে হেডবাবুর্চির কাজ করেছে। এখন তার ডায়াবেটিসের শরীরটা এত কিছুর ধাক্কা নিতে পারছে না। তাই ওসব ছেড়ে দিয়েছে রবি। সময় নিয়ে তার স্ত্রী মায়াও সেলাই কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছে। মেরিল্যান্ডে নাকি, নারীদের ব্লাউজ, পেটিকোট তৈরি ও শাড়ির ফলস লাগানোসহ সেলাই কাজের অনেক চাহিদা। আবার চিতই পিঠা, চেপা-শুঁটকি কষানি, গরু-মুরগির পোলাও-বিরিয়ানি, সালাদ ইত্যাদি ফরমায়েশি রান্নার কাজ করে ঘরে বসে আয়ও হয় ভালো! নগদ ক্যাশ ডলার কামানোর মোক্ষম উপায়! এ পথে আয়ও যেমন হয়, আবার সরকারকে ট্যাক্সও নাকি দিতে হয় না। জয়ার পরামর্শ মতো, মায়ার মতো রীতাও রান্নার পাশাপাশি সেলাইয়ের কাজটা শিখে নিয়েছে। এখন তাদের অপেক্ষার পালা মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রে নেমেই, কোমরে আঁচল বেঁধে টাইটসে কাজে লেগে যাবে! তাদের প্রশ্ন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে, হাত বাড়ালেই ডলার! ওপর দিকে উঠতে লাগে কতদিন…?’ এ সময় আশিসের মৃত্যুসংবাদ শুনে, সবকিছুই ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের! এ যেন, ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত!’ তার একটাই প্রশ্ন, ‘এখন আমাদের কী হবে?’

শিশির সামনে অন্ধকার দেখে! যুক্তরাষ্ট্রে যাবে বলে, এক নৌকায় উঠেছিল তারা। প্রায় ঘাটের কাছে এসেই, নৌকাটা তলিয়ে গেল! তার মনে বড় প্রশ্ন, এখন কী হবে তাদের? কী হবে দুই সন্তানদের? তপতী ও তপন তো বড় আশা নিয়ে, তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তারা প্রতিষ্ঠিত হবে। তাদের জীবন হবে অনেক সুন্দর। মায়াও ভেঙে পড়েছে। তপতী-তপন বারবার বাবাকে জিজ্ঞেস করে, এখন তাদের কী হবে? তারা কি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারবে? শিশির বলে, ‘ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা কর। নিশ্চয় যেতে পারব!’

জয়া জানে, রবি ও তার স্ত্রী ঝরনা ঠিকই যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, শিশির ও তার পরিবারকে নিয়ে! তাদের কী হবে? এবং কী হবে আশিসের নেতৃত্বে বেড়ে ওঠা ‘ঠিকানা: বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের? এটি ছিল তার নিজের হাতে গড়া একটি সংগঠন। পরে অনেকের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ‘ঠিকানা: বাংলাদেশে’র মধ্য দিয়ে এখানে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে আশিসের প্রচেষ্টার অবদান সর্বজনবিদিত। বৃহত্তর ডিসি মেট্রোপলিটান এলাকায় বসবাসরত বাঙালিদের প্রিয় এই সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশেও অনেক দুস্থ ছেলেমেয়ে পড়াশোনার সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছে। অসুস্থদের চিকিৎসাসহায়তা করা হয়েছে। এই প্রবাসে বাংলাদেশি বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায়, আশিসের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘ঠিকানা: বাংলাদেশ’ দেশেও ব্যাপক পরিচিত হয়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন প্রধান জাতীয় দৈনিক ও অনলাইনভিত্তিক প্রকাশনায় ‘ঠিকানা: বাংলাদেশ’-এর পরিচিতি ও কার্যক্রম প্রচারিত হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও সমর্থন কুড়িয়েছে। বলা যায়, আশিসের উদ্যোগেই এত কিছুর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। সবার প্রিয়ভাজন সেই আশিস, এভাবে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল! তার অকালমৃত্যু, সমাজে এক শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, যা সহজেই পূরণীয় নয়! আশিসের অনেক স্বপ্ন ছিল। ছিল কর্মপরিকল্পনাও। ছোট ভাই শিশিরকে কিছু বলে গেছে সে। তার গ্রামের, এমনকি ঢাকায় যেখানে সে বাস করত, সেখানকার মানুষও অনেক বিষয় অবগত ছিল। করোনা এভাবে সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেবে, কে তা জানত!

তো শিশিরের জন্য বড় কষ্টের কারণ, তার বড় ভাই আশিসের চলে যাওয়া। এই মানুষটার অকালমৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, সমাজের জন্যও অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাণঘাতক করোনা তো চলেই গেছে। কিন্তু তার রেশ এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে বিশ্বের সবাইকে! এই করোনার কারণে, পুরো দুনিয়াতেই ছন্দপতন হয়েছে।

করোনার পর ধীরে ধীরে সবকিছু, ধীরলয়ে আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। এত বড় একটা ঝড় বয়ে গেছে, পুরো পৃথিবীর সব মানুষের ওপর দিয়ে! চিন্তাই করা যায় না। অকালে কত মানুষ চলে গেছে! ছোট-বড় কোনো ভেদাভেদ মানেনি এই করোনা-দানব! ধনী-গরিব, সাদা-কালো, পরাশক্তি-তৃতীয় বিশ্ব কেউ ছাড় পায়নি!

এরই মধ্যে আবার, অন্য মুসিবত শুরু হয়ে গেছে! রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তার কারণে পুরো বিশ্বে জ্বালানি ও খাদ্যসংকট শুরু হয়ে গেছে। মানুষের মনোজগতেও বড় প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। দেশের রাজধানীতে জেলায় জেলায়, পাড়ায় মহল্লায় এমনকি পরিবারে পরিবারে, শুরু হয়ে গেছে নানান সংঘাত।

শিশিরের পরিবার পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। আগের মতো, সে আর কোথাও যায় না। তার গ্রামে, এমনকি ঢাকার মহল্লাতেও খুব বেশি বের হয় না। তার স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে সবার মন ভেঙে গেছে! তাইতো। কী হতে যে কী হয়ে গেল! কত স্বপ্ন, কত আশা ছিল তাদের! শিশিরের স্বপ্ন ছিল, তার ও বউদির ভাই রবি-ঝরনা একই দিনে বিমানে চড়ে বসবে। একসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে যেয়ে নামবে। আশিস-দাদা, জয়া-বউদি তাদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি এবং আরও আত্মীয়স্বজন তারা হাতে ফুল নিয়ে এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকবে। হাসিমুখে তারা, সবাইকে বরণ করে নেবে। ছবি তুলবে। কিন্তু না! তা আর হলো না! তাদের সবার রঙিন স্বপ্ন ভেঙে গেল! তার আক্ষেপ, ‘একেই বলে ভাগ্য! এটাই আমাদের জন্য, কঠিন বাস্তবতা! অন্তত এ সময়ের জন্য, তাকে মেনে নিতেই হবে! তার কোনো বিকল্প নেই!’

আশিস মারা যাওয়ায় শিশিরের সবকিছুই পাল্টে গেল! সে জানতে পারল, এখন তাদের যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে! তবে রবি-ঝরনা যেতে পারবে। শিশিরের জয়া-বউদি ফোনে বলেছে, ‘ভাই, তোমার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর তথ্য, এ দেশের সরকারের নথিতে চলে গেছে! এখন কী হবে, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন! তবুওঅপেক্ষা করো ভাই। বাকিটা তাঁরই হাতে। আর রবির জন্য যেহেতু আমি অ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম, তার সম্ভাবনা শতভাগই। তবু প্রার্থনা করি। তোমাদেরও যেন একটা গতি হয়।’ শিশির বুঝতে পেরেছে, জয়া-বউদির এ কথা সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়! এখন সবকিছুই তার সামনে, দিনের মতো খোলাসা হয়ে গেছে। সহজে তারা যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছে না! রবিদের সঙ্গে যাওয়া হবে না, এটাই খাঁটি সত্য কথা!

রবি শিশিরের খোঁজখবর নেয়। তার বাড়িতে তো আসেই। ঢাকায় গিয়েও ফোনে শিশিরের খোঁজখবর রাখে। আশিস মারা যাওয়ার তিন বছর পর, রবি শিশিরকে জানায় সে কাগজ পেয়েছে। রবি শিশিরের বাড়ি যায়। কথা প্রসঙ্গে রবি শিশিরকে জানায়, সে একাই যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে। ঝরনা পরে যাবে।

রবির শরীরটাও খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। হার্টের বড় একটা অসুখ বাধিয়ে নিয়েছে সে। শরীরটার দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে তার। তাই জয়া বলেছে, আগে সে একাই যেন যুক্তরাষ্ট্রে আসে। তার চিকিৎসা হবে এখানে।

সুদীর্ঘ উনিশ বছরের অপেক্ষার পর রবি যুক্তরাষ্ট্রে চলে এসেছে একাই। তাকে বিদায় জানাতে, ঝরনার মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই ঢাকার বিমানবন্দরে গিয়েছিল। শিশিরও ছিল সঙ্গে। তো, যুক্তরাষ্ট্রে এসে রবি উঠেছে তার বড়বোন জয়ার বাড়িতে। তার জন্য কাজও ঠিক হয়েই আছে। তবে এই অসুস্থ শরীর নিয়ে, আপাতত কাজ নয়। আগে চিকিৎসা। সেরে ওঠা। তারপর কাজ ও অন্য সব।

মেরিল্যান্ডের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা ঘুরেফিরে দেখেছে রবি। এখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এসে গেছে। বাঙালিদের আয়োজনে, নানান অনুষ্ঠানে ও বনভোজনে যোগ দিচ্ছে। জয়া ও ভাগ্নে-ভাগ্নিদের সঙ্গে, হোয়াইট হাউস, ন্যাশনাল মনুমেন্ট, ভার্জিনিয়ার সেনানদোয়াহ ন্যাশনাল পার্কের স্কাইলাইন ড্রাইভ, লুরে ক্যাভার্নসসহ আরও কিছু দর্শনীয় জায়গা দেখেছে। এখানে তার বন্ধু-বান্ধব সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটায়। রবিকে নিয়ে জয়া ও তার ছেলেমেয়েরা মিলে শিগগিরই নিউইয়র্ক যাবে। সেখানে যেয়ে, নাইন ইলেভেন মেমোরিয়াল, লিবার্টি স্ট্যাচু, স্ট্যাটেন আইল্যান্ডসহ আরও দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়াবে। রবির বন্ধু উলুখোলার রঞ্জন ব্রংক্সে এবং টাহরদিয়ার সিরাজ লং-আইল্যান্ডে পরিবার নিয়ে থাকে। তারা রবির ছোটবেলার বন্ধু-সহপাঠী। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর, ফেসবুকে যোগাযোগ হয়েছে তাদের সঙ্গে। মেসেঞ্জারে কথাও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রবির আগমনের কথা জানতে পেরে তারা তো মহাখুশি। এতদিন পর রবির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মুখিয়ে আছে তারা। তাই তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বলে রেখেছে। পরে যাবে, কানেক্টিকাট ও ক্যালিফোর্নিয়ায়। এত সবের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে রবি তো মহাখুশি! তবে সে তার স্ত্রী ঝরনাকে খুব মিস করছে। তার বেয়াই শিশিরকেও। আহা শিশির! সে তো সহজে যুক্তরাষ্ট্রে আসতে পারবে না। তবে ঝরনা চলে আসবে তাড়াতাড়ি।

জয়া রবির চিকিৎসার ব্যাপারে খুবই সচেতন। ইতিমধ্যে তার ডাক্তার, ওষুধ সবকিছু শুরু হয়ে গেছে। জয়া বলল, ‘দেখো ভাই। এখানে বাঙালিদের সঙ্গে মিশবে তো তোমার সর্বনাশই হবে! এই আমি বলে দিচ্ছি, হ্যাঁ। এখানে যেখানে যার বাড়িতে যাবে, সেখানেই হুইস্কি, ভদকা, বিয়ার দিয়ে আপ্যায়ন। এগুলো ছাড়া কোনো কথা নেই। তুমি হিসাব করে চলবে। আর হিসাব করেই খাওয়া-দাওয়া করবে।’ রবি সায় দেয়। অর্থাৎ ঠিক আছে।

এভাবে দেড় বছর কোনোভাবে কেটে গেছে। তারপর রবির স্বাস্থ্যের চরম অবনতি দেখা দেয়। তাকে নিয়ে জয়াকে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয়। একদিকে আশিসের মৃত্যুর কারণে সংসারে অগোছালো ভাব, অন্যদিকে অসুস্থ রবি। মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছে জয়া। তার পরিবারের ভালো-মন্দ ইত্যাদি নিয়ে কমিউনিটির লোকজনও খুব বেশি ভাবে না এখন! তা ছাড়া কে কী করবে? বর্তমান সময়টা তো যাচ্ছে খুবই খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে। আশিসের হাতে গড়া সংগঠন, ‘ঠিকানা: বাংলাদেশ’ও স্থবির হয়ে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা, জিনিসপত্রের দামের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, সবকিছু মিলিয়ে প্রায় সবাইকেই হাবুডুবু খেতে হচ্ছে। তাই ‘ঠিকানা: বাংলাদেশ’ এখন গতি পাচ্ছে না। সংগঠনটির কর্মকর্তাদের মধ্যে নেতৃত্বের কোন্দল, দলাদলি ইত্যাদি সাধারণ সদস্যদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে অনেকেই সংগঠন ত্যাগ করেছে।

রবির অবস্থা সংকটজনক হয়ে পড়েছে। তাকে নিয়ে আশিস-জয়ার সন্তান সবাই হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় বাঙালি কমিউনিটির অনেকেই এগিয়ে এসেছে। কিন্তু কে কত আর করবে?

হঠাৎ করেই রক্তবমি শুরু হয় রবির। ঘরে শুধু জয়া। নাইন-ইলেভেনে কল দিলে অ্যাম্বুলেন্স আসে। রবিকে নিয়ে যাওয়া হয় সিলভারস্প্রিংস্থ হলি ক্রস হাসপাতালে। দীর্ঘ পাঁচ দিন চলে মানুষের যুদ্ধ। তারপর ডাক্তাররা বলে দিলেন, ‘রবির সব শেষ হয়ে গেছে, যেকোনো সময় তার অঘটন ঘটে যাবে।’

রবি মারা গেছে। দেশে রেখে আসা তার স্ত্রীর অবস্থা এখন শিশিরের পরিবারের মতোই হয়ে গেছে। তারাও যুক্তরাষ্ট্রে আসার জন্য যে পথে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই থমকে যায় সবাই। তাদের পরম আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের যুক্তরাষ্ট্র-যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই তো মানুষের ভাগ্য!

রবিকে হারিয়ে জয়া ভেঙে পড়েছে। ওদিকে জলির অবস্থাও একই। তাদের একই স্বপ্ন ছিল, তিন ভাই–বোন নিজেদের পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে আনন্দে যুক্তরাষ্ট্রে জীবন কাটিয়ে দেবে। দেশ থেকে আশিসের ভাই শিশির ফোন দিয়েছিল জয়াকে। রবির মৃত্যুর সংবাদ শুনে সেও ভেঙে পড়েছে। রবি তার জয়া-বউদিকে বলেছে, ‘এই তো আমাদের ভাগ্য! যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে স্থায়ী হয়ে সুখে-শান্তিতে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন আমাদের পূরণ হলো না! আমরা তো সেখানে যেতে পারব না! যদিও রবি সেখানে গেল। কিন্তু তার স্বপ্নও সফল হলো না! আমার বড়ভাই আশিসের স্বপ্নও পূরণ হলো না! তোমরাও আমাদের কাছে পাওনি। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য “স্বপ্নের আমেরিকা” হয়েই রয়ে গেল! এই অপূরণীয় স্বপ্ন বুকে নিয়েই মরতে হবে আমাদের! হ্যাঁ বউদি, আমাদের জন্য এটাই চূড়ান্ত সত্য!’

জয়া শিশিরকে বলেছে, ‘ঠিকই বলেছো ভাই তুমি! ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে আমাদের! “ভাগ্যের লিখন, যায় না খণ্ডন” কথাটি আমাদের সবার বেলায় “দুর্লঙ্ঘ্য-সত্য” বলেই প্রমাণিত হয়েছে! তোমরা ভালো থাকো ভাই! আমরা দেশে গেলে, তোমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ তো হবেই! তোমাদের জন্য আমাদের প্রার্থনা ও শুভকামনা সব সময়ই থাকবে!’