নোবেল পরিবারের সঙ্গে আড্ডা টেনিসের মাঠে
সমস্যা যে শুধু বাংলাদেশে, সেটা সঠিক নয়, সমস্যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সুইডেনেও আছে। যে সমস্যাগুলো এ মুহূর্তে আমাদের সবার ওপর কম–বেশি প্রভাব ফেলছে, তার মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মুদ্রাস্ফীতি, সুদের ব্যয় বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ধর্মীয় গ্রন্থ পোড়ানো এবং ন্যাটো জোটে যোগদান।
তবে সন্ত্রাস দমনে সুইডেন হিমশিম খাচ্ছে বেশি। প্রতিদিন কমপক্ষে একটা করে জীবন ঝরে পড়ছে। সুইডেনের আইনের বিশ্লেষণ হলো, আইন মানুষের জন্য। অতএব তার ব্যবহার ন্যায্য হতে হবে।
ছয় বছর আগে (৭ এপ্রিল ২০১৭) স্টকহোমে রাহকমাত আকিলো নামের এক শরণার্থী এসেছিল উজবেকিস্তান থেকে। দেশ ছেড়েছে সুইডেনে পারমিশনের জন্য এবং অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছে। একজন শরণার্থী হিসেবে সুইডেন সরকার তার দায়ভার নিয়েছে। থাকা, খাওয়া, ফ্রি-চিকিৎসাসহ প্রতিমাসে তার ভাতা রয়েছে। অথচ সে সেদিন (৭ এপ্রিল ২০১৭) স্টকহোমের ব্যস্ততম রাস্তায় ট্রাক লোকের ভিড়ে চালিয়ে দেয়। এতে এব্বা ওকেরলুন্ডসহ ৫ জন নিহত, ১৫ জন আহত, আশেপাশের অনেক দোকান ক্ষতিগ্রস্ত এবং হাজারো মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
সুইডিশদের আশ্রয়ে খেয়ে–পরে সুন্দর জীবনযাপন করেছে, বিনিময়ে সে এই জঘন্য কাজ করেছে। যে তার নিজের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে জানি না কার বা কিসের লোভে পড়ে সেদিন সে এত বড় অমানবিক কাজ করেছিল! জানি না পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ হলে সেদিন তার কী হতো! জানি না আমরা বাংলাদেশে তাকে কী করতাম! তবে সুইডেনে সে সর্বোচ্চ আইনের সাহায্য পেয়েছে এবং এখনো এখানে রয়েছে। চলছে আলোচনা, তার দেশের সঙ্গে তবে তার জন্মস্থান উজবেকিস্তান তাকে ফেরত নিতে রাজি নয়। সুইডেনের জেলে সে রয়েছে, যা তার জন্য ফোর-স্টার হোটেল, কারণ সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা ভোগ করে চলছে সে বিনা পয়সায়।
সুইডেনে (আকিলোর মত) বড় বড় অপরাধী হওয়া সত্ত্বেও মানবিক সাহায্যসহ হাজারো সুযোগ–সুবিধা ভোগ করছে। এ কেমন বিচার বা অবিচার! অমানুষিক কাজ করার পরেও বিচার–বিবেচনার কাঠগড়ায় বিবেচিত হওয়ার সুযোগ যদি হিউম্যান রাইটস হয়, তাহলে সুইডেনে সেটা আছে। যা পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। যাই হোক, সুইডেন সন্ত্রাস দমনে ভীষণ সমস্যার মধ্যে আছে, কীভাবে হবে এর সমাধান, এটাই ছিলো আড্ডাখানার ‘হট নিউজ’।
আমার ছেলে জনাথান টেনিস প্র্যাকটিস করছে এলিওট নোবেলের সঙ্গে। আমি এলিওটের বাবা জোনাস নোবেলের সঙ্গে বসে টেনিস খেলা দেখছি, সাথে চলছে আড্ডা। আড্ডাখানায় যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয়েছিল মূলত সেগুলোই ওপরে বর্ণনা করেছি, তবে জোনাস নোবেল সবকিছুর পর তার বাপদাদা চৌদ্দগোষ্ঠীর রেফারেন্স টেনে এনে যখন বললো সুইডেন সব সময় সমস্যার সমাধান করে, এবারও করবে। যেমন বিশ্বে যখনই বড় বড় সমস্যা এসেছে, সুইডেন তার সমাধান করেছে।
আমি সব সময় বিশ্বাস করি জানা থেকে শেখা, সে ক্ষেত্রে জোনাস নোবেলের কথায় স্বস্তি পেলাম।
জোনাস আলফ্রেড নোবেলের ভাই লুদভিক নোবেলের বংশোদ্ভূত। আমাদের আলোচনার শেষের বিষয়টি মূলত ছিলো জোনাসের দাদার দাদার ভাই আলফ্রেড নোবেল এবং নোবেল পুরস্কারের ওপর।
বাড়িতে ফেরার পথে স্মৃতির জানালায় অনেক কথা ভেসে উঠেছে, যেমন বিশাল বটগাছ অথচ তার জন্ম ছোট্ট একটি বীজ থেকে। বিশাল নাম আলফ্রেড নোবেল ছিলেন একই সঙ্গে একজন সুইডিশ রসায়নবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক এবং অস্ত্র নির্মাতা। বিশ্ব যুদ্ধের প্রথম দিকে নোবেল কোম্পানি অনেক সমৃদ্ধি অর্জন করে, কিন্তু যুদ্ধ শেষে যখন রুশ সামরিক বাহিনী অর্ডার উঠিয়ে নেয়, তখন দেউলিয়া হয়ে যায়। আলফ্রেড নোবেল মরিয়া হয়ে নতুন পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করতে থাকেন। তার রসায়ন শিক্ষক নিকোলাই এন. জিনিন তখন তাকে নাইট্রোগ্লিসারনের কথা মনে করিয়ে দেন।
১৮৬২ সালে নোবেল নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৮৬৩ সালে তিনি প্রথম নাইট্রোগ্লিসারিন-জাত পণ্যের পেটেন্ট করেন। একে ইংরেজিতে বলা হয় ব্লাস্টিং অয়েল, যা এক ধরনের বিস্ফোরক। এরপর ব্লাস্টিং ক্যাপ নামক একটি ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেন যা নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরণের ট্রিগার হিসেবে কাজ করে। এ সময়ই তিনি স্টকহোমে চলে আসেন এবং এখানেই গবেষণা চালিয়ে যান।
১৮৬৪ সালে স্টকহোমের হেলেনবোর্গে নাইট্রোগ্লিসারিন প্রস্তুতের সময় বিস্ফোরণে আলফ্রেড নোবেলের ভাই এমিল মারা যায়। কিন্তু নোবেল পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং স্টকহোমে নাইট্রোগ্লিসারিন এবি নামক একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।
১৮৬৫ সালে নোবেল তার ব্লাস্টিং ক্যাপ নকশাটির আরও উন্নতি সাধন করেন। এ সত্ত্বেও নাইট্রোগ্লিসারিনের ভয়াবহ বিস্ফোরণে জার্মানির হামবুর্গের নিকটস্থ ক্রুমেল শহরে তার কারখানাটি ধ্বংস হয়ে যায়। নাইট্রোগ্লিসারিনের এ ইনস্ট্যাবিলিটির ধর্মের ওপর ভিত্তি করে তিনি বিস্ফোরক সংরক্ষণ করতে শুরু করেন। একদিন নাইট্রোগ্লিসারিনের পাত্র সরানোর সময় নোবেল খেয়াল করলেন, একটি ক্যান ভাঙা, যার কারণে তরল নাইট্রোগ্লিসারিন গড়িয়ে পড়ার কথা। অথচ তা পাত্রের ভেতরে জমাট বেঁধে আছে। এ সময়ই তিনি বুঝতে পারেন, নাইট্রোগ্লিসারিনের সঙ্গে একটি সেডিমেন্টারি রক মিক্সার যার নাম কাইজেলঘুর (kieselguhr) তরলকে শুষে নিয়েছে। কাইজেলঘুর (সিলিকনের মতো অধঃক্ষেপ, ডায়াটোমেশাস মাটি হিসেবেও পরিচিত) স্টাবিলাইজার হিসেবে মিশালে তা স্থিত (স্টাবিলাইজ) হয়।
আলফ্রেড নোবেল এই নতুন মিশ্রণ বিস্ফোরকের নাম দেন ডিনামাইট। ওয়াও! কী বিশাল শক্তি।
ডিনামাইট আবিষ্কারের পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা। সুইডেনসহ বিশ্বের বহু দেশ ডিনামাইটের সাহায্যে বড় বড় পাহাড় উড়িয়ে দিয়ে রাস্তাঘাট তৈরি করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে নিজ দেশের পরিকাঠামোর বিশাল উন্নত করতে সক্ষম হলো। আজ সেই বরফ এবং পাহাড়ের দেশ সুইডেন বিশ্বের সেরা দেশগুলোর তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
অন্যদিকে এই শক্তি খারাপ মানুষের চিন্তায় ঢুকে খারাপ কাজে ব্যবহার করা, মানুষকে পঙ্গু এবং হত্যা করার জন্যই তা বেশি ব্যবহার করা শুরু হলো। এসব দেখে তিনি খুবই ব্যথিত হন এবং ডিনামাইট আবিষ্কারের জন্য অনুতপ্ত হন। শেষে মৃত্যুর আগে তিনি উইল করে গেলেন আর সেই উইলের হাত ধরে প্রবর্তিত হলো নোবেল প্রাইজ। যেটা আজকের বিশ্বের সব থেকে সম্মানিত পুরস্কার। আলফ্রেড নোবেলের মধ্যে স্থানীয় উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল বিধায় তিনি বৈশ্বিক সমাধান করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জোনাস নোবেলের বিশ্বাস সুইডেন সন্ত্রাস দমনের একটি ভালো উপায় খুঁজে বের করবে। তাছাড়া এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞানসম্মত, প্রশিক্ষণে কারচুপি হয় না এবং শিক্ষকেরা সেসফ মোটিভেটেড তাদের কর্মে, যেমন এবার (২০২৩ সালে) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী পিয়ের আগোস্তিনি, হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী ফেরেন্স ক্রাউজ ও ফ্রান্সের বিজ্ঞানী অ্যান লিয়ের। নোবেল পুরস্কার জয়ের খবর দেওয়ার জন্য যখন অ্যান লিয়েরকে নোবেল কমিটি ফোন করে, তখন তিনি ক্লাস নিচ্ছিলেন। ক্লাস চলাকালে ফোন ধরেননি তিনি। অ্যান লিয়েরকে ফোন করার বিষয়টি নোবেল কমিটি নিজের এক্স–এ (সাবেক টুইটার) পোস্ট দিয়েছে—২০২৩ সালের পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অ্যানকে তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আলাদা করা যায়নি। নতুন নোবেল বিজয়ী ক্লাস পড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। অ্যান লিয়ের সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, সুইডিশ-ফ্রেন্স নাগরিক এবং একজন পদার্থবিজ্ঞানী। জন্ম ১৯৬৪ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। ফ্রান্সের পিয়েরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে পিএইচডি অর্জন করেন তিনি এবং ঘটনাটি ঘটে তখন!
যাই হোক ক্লাসের নির্ধারিত বিরতির সময় তিনি খবরটি শুনেছেন তবুও ক্লাস ছাড়েননি। সুইডেনের শিক্ষা পদ্ধতি এমনই এবং এ পেশার সবাই একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক! আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা ক্লাস বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি-উপকমিটির পদ পাওয়ার জন্য তেলবাজি করে বেড়াচ্ছে। টেলিভিশনের টকশোতে মুখ দেখাতে পারলে এরা মনে করছে বিশাল কিছু! বাংলাদেশের শিক্ষকদের অনেকেই ক্লাসে যান না ঠিকমতো। ক্লাসে গেলেও পড়াযন না। পড়ালেও কেউ কিছু বোঝে না! কারণ, তাঁরা শিক্ষক হয়েছেনই ভিন্ন উপায়ে! আমাদের শিক্ষকদের এই সব কর্মকাণ্ডই আসলে বুঝিয়ে দেয় জাতি হিসেবে আমরা কোনদিকে যাচ্ছি! এতকিছুর পর আমিও জোনাস নোবেলের মতো মনেপ্রাণে লাখো তরুণ ও সৃজনশীল আদর্শ শিক্ষক দেখতে চাই সারা বাংলাদেশে।
আলফ্রেড নোবেলের মতো অনেকেই বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করতে স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ যার গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখলে মন ভরে যায়, সারাদেশ ঘুরে দেখলে মনে হতো যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা! সেই সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা যেখানে এসে ব্রিটিশ, পর্তুগিজ আরও কত দেশ শোষণ করেছে এবং সঙ্গে নিশ্চিত অনেক কিছু সঙ্গে করে নিয়েও গেছে। আমরা হয়তো প্রথম দিকে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছি কিন্তু কোনো একসময় তাদের তাড়িয়েছি। এখন শুরু হয়েছে কীভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রুত বড়লোক হতে হবে। এখন চলছে ধর, মার, খাও এবং এর ওপর প্রাকটিস করতে করতে দেশটি এখন দুর্নীতি, দূষণযুক্ত বাংলাদেশ হয়েছে। কিন্তু কেন এমনটি হলো এমন তো কথা ছিল না!
এদিকে আমরা সুইডেনের জনগণ যে খুব শান্তিতে আছি, সেটা বললে ঠিক হবে না। এখানেও রয়েছে সমস্যা, এখানেও রয়েছে জটিলতা। জানিনে বাংলাদেশ কেমনভাবে দেখছে এ সময়ে সুইডেন এবং সুইডিশ জাতিকে! তবে ভাবুন ছোট্ট একটি দেশ জনবসতির দিক দিয়ে। অথচ পৃথিবীর সব দেশের মানুষের বাস এখানে। গোটা বিশ্বের বর্তমান সমস্যাগুলোর সব কিছুর সমন্বয়ে সুইডেন। চাঁদে যদি দাগ থাকতে পারে, তবে কেন সুইডেনে থাকবে না?