মোড় ঘুরে পথ খুঁজছে বাংলাদেশ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পদে সরাসরি সামরিক বাহিনী থেকে এসে কেউ যোগ দেননি। রাষ্ট্রযন্ত্রের এত সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের এই বিরল অবস্থান দেখে আমি আত্মবিশ্বাসী ও আস্থা রাখছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা ও গঠনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর। বাস্তব পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে উপদেষ্টারা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পথ খুঁজছে বাংলাদেশের জন্য। যে পথ বাংলাদেশের জনগণকে দেবে মানবাধিকার উপভোগের সুযোগ ও স্বাধীনতা। যে পথ বাংলাদেশকে গড়ে তুলবে বাণিজ্যিক ও কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে।
সংহতি জানাই বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর অবস্থানকে
সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাষ্ট্রের ক্রান্তিলগ্নে সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের বেসামরিক কাঠামোতেও সামরিক বাহিনী মুখ্য ভূমিকায় অনুপ্রবেশ করে। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনী নিজেদের তুলে ধরেছে রাষ্ট্রের একটি সুসংহত প্রতিষ্ঠান হিসেবে, যা দৃষ্টান্তমূলক একটি দিকনির্দেশনা। সামরিক বাহিনীতে কর্মরত কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পদ গ্রহণ করেননি বা ছদ্মবেশে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই। তাঁদের পরিধির মধ্য থেকে সারা দেশে দায়িত্ব পালন করছেন। সামরিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের এই নির্মোহ অবস্থানকে সংহতি জানাই এবং সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আহ্বান জানাই এই দৃষ্টান্ত অনুসরণের।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদে ছাত্র সমন্বয়কদের মধ্য থেকে দুজন উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও নেতৃত্বে তরুণ সমাজের অংশগ্রহণ নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে নীতিগত অবস্থান রয়েছে, এটি তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের মহানায়ক মাহাথির মোহাম্মদের মতো আমাদের ছাত্র সমন্বয়কেরা আবির্ভূত হয়েছেন। শিক্ষক পিতার সন্তান মাহাথির মোহাম্মদ ১৯৫৩ সালে মেডিসিন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেন। ১৯৬৪ সালে ৩৯ বছর বয়সে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। মালয় নৃগোষ্ঠীর বৈষম্য নিয়ে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করায় ১৯৬৯ সালে সংসদ সদস্য পদ হারান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রেখে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং ১৯৭৪ সালে আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং শিক্ষামন্ত্রী হন।
আমাদের ছাত্র সমন্বয়কেরা দেশের পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়ে নিজেদের বীরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন।
উপদেষ্টা হিসেবে তাঁদের দুজন দায়িত্ব গ্রহণ করায় দেশের জনগণ আনন্দচিত্তে স্বাগত জানিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একক নেতৃত্ব নেওয়ার বা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা কারোরই ছিল না। সবার অবদানকে একত্র করে এগিয়ে চলেছিল আন্দোলন। এ জন্য ছাত্ররা নিজেদের পরিচিত করিয়েছিলেন সমন্বয়ক হিসেবে, যেখানে সবাইকে সংগঠিত করতে ও উজ্জীবিত রাখতে অনেক বড় অবদান রেখেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে এবং সবার উন্মুক্ত অংশগ্রহণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রম, কৌশল, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রণয়ন, প্রচার, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও বাস্তবায়িত হয়েছে। বহু মেধার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলেই আজ আমরা স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার প্রচেষ্টায় আছি।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মেধা বা যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ বা নেতৃত্ব। আন্দোলনের সফলতার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আমাদের সেই মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের সময় এসেছে। সামরিক প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে সব নেতৃত্ব ও প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও মেধাবী ব্যক্তির হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার মতো মানসিক শক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। নেতৃত্ব গ্রহণের পর যদি বাস্তবভিত্তিক সীমাবদ্ধতা উন্মোচিত হয় তাহলে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার মতো উদারতা ও দৃঢ়তা থাকতে হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাব রাখছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সহযোগিতা করার জন্য ‘বিশেষ সহকারী’ নিয়োগের। বিশেষ সহকারী শুধু ছাত্র সমন্বয়কদের মধ্য থেকে হতে হবেন এমন নয়, বরং হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশে অথবা বিদেশে বিশেষ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন, এমন ব্যক্তিদের সরকার পরিচালনায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষ সহকারী হিসেবে তাঁরা বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আমলাতন্ত্র ইত্যাদি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন ও অবদান রাখবেন। এই অভিজ্ঞতা ও অবদানের আলোকে তাঁরা পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবেন।
কাটিয়ে উঠি সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশের বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, একটি বড় জনগোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে শোষক অথবা শোষণের শিকার। বাকি জনগণ নিজেদের অবদমিত করে রেখেছে। এই তিন শ্রেণির কাউকে দিয়েই মৌলিক গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। পরিবর্তনের আশায় অনেকবার এ দেশে গণজাগরণ হয়েছে, রক্ত দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনা হয়েছে, কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন আসেনি। শোষক, শোষিত অথবা অবদমিত ব্যক্তি বা শ্রেণিকে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের যেখানেই দেওয়া হোক সেখানে সর্বজনগ্রহণযোগ্যতা তৈরি সময়সাপেক্ষ বিষয় এবং কার্যক্রম পরিচালনা নীরব বা প্রকাশ্য বাধার সম্মুখীন হয়। এর ফলে নেতৃত্ব প্রদানে সর্বোচ্চ সৃজনশীলতা ও উচ্চবুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সম্ভব হয় না। এভাবে নেতৃত্বের প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা কমতে থাকে এবং রাষ্ট্র আবর্তিত হতে থাকে এক পঙ্কিল চক্রে।
এশিয়ার নগররাষ্ট্র সিঙ্গাপুর মাত্র তিন দশকে ‘জেলেপল্লি’ নাম ঘুচিয়ে পৃথিবীর সর্বোন্নত ১০টি দেশের তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছে। ১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পথচলা শুরু করে তখন রাষ্ট্র গঠনের জন্য প্রথমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা যোগ্য নাগরিকদের যথাযথ সুবিধা ও সম্মানসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। এরপর গুরুত্বপূর্ণ যেসব পদে যোগ্য নাগরিকদের পাওয়া যায়নি সেসব পদে যোগ্যতাসম্পন্ন বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্বায়নের যুগে বাংলাদেশের নাগরিক যেমন পৃথিবীর প্রায় সব দেশে কর্মরত আছেন তেমনি ভিন্ন দেশের অনেক নাগরিক এ দেশে চাকরি ও ব্যবসা করছেন। আস্থার সংকটে থাকা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী পদে বিদেশিদের নিয়োগ দিলে তিনি যেমন বস্তুনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারবেন, তেমনি সব নাগরিকের আস্থা অর্জনও সহজ হবে। সে ক্ষেত্রে স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যেসব দেশের সঙ্গে কম, সেসব দেশের নাগরিকদের প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে। যেমন সুইজারল্যান্ড, ভ্যাটিকান, বেলারুশ প্রভৃতি। শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তি, ভূমি, বিদ্যুৎ, বেসামরিক বিমান, পর্যটন, ভারী শিল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রের নির্বাহী পদে বিদেশিদের নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
ভিত্তি হোক বাস্তবতা
‘এক দিনের মিনিস্টার’, ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’জাতীয় সিনেমা এ দেশে খুবই জনপ্রিয়তা পায়। ভূতের রাজা বর না দিলে আমরা পরিবর্তন আনতে পারি না। এ জন্যই বিপ্লব করে, রক্ত দিয়ে বারবার স্বাধীনতা অর্জন করার পরও সে স্বাধীনতা কুক্ষিগত হয়ে যায়। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক, দায়িত্ব-কর্তব্য ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা খুবই কমসংখ্যক নাগরিকের আছে। ভূতের বর নিয়ে রাজার পতন ঘটানোর পর রাষ্ট্র গঠনে নাগরিকরা কীভাবে অংশগ্রহণ করবে, সেই প্রক্রিয়া আজও তৈরি হয়নি। এ জন্য নতুন নেতৃত্বের কাছে জনগণের আশা অসীম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে গ্রামের একজন তরুণ বা তরুণী জানতে পারছেন নেতৃত্বের নির্দেশনা এবং জানাতে পারছেন তাঁর নিজের অবস্থা। তেমনিভাবে বিশ্বের সুশৃঙ্খল ও উন্নত জাতিরাষ্ট্রের নেতৃত্ব কীভাবে পরিচালিত হয়, নাগরিকেরা কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার উপভোগ করেন, তা ছড়িয়ে পড়ছে সব শ্রেণির জনগণের কাছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রিকশাচালকদের সুশৃঙ্খলভাবে আন্দোলনে অংশগ্রহণ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এ দেশের আপামর জনগণ শান্তি চাই, সুশৃঙ্খলভাবে চলতে চাই, সুযোগের সম–অধিকার চাই। যানবাহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষার্থীরা যখন রাস্তায় নেমেছেন, সবাই শৃঙ্খল প্রদর্শন করেছেন। কারণ, সবার আস্থা ছিল শিক্ষার্থীরা কারও সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করবেন না।
বাংলাদেশের জনগণ বিভিন্ন দল, মত, শিক্ষা, পরস্পরবিরোধী নীতি ইত্যাদিতে বিভক্ত। এ বাস্তবতায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি গ্রহণ করা না হলে নেতৃত্বের পদে পদে সৃষ্টি হবে প্রতিবন্ধকতা। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের কারণে অবিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিশেষ কিছু রং দেখলে আস্থার পারদ শূন্যে নেমে আসে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন রং বেছে নিতে হবে, যা সবাই আনন্দচিত্তে শরীরে মাখবে।
কথায় আছে, পথই পথের পথ দেখায়। কেউ যদি গোষ্ঠী–বঞ্চনার পথ গ্রহণ করে, সে বঞ্চনা মহাসড়কে পৌঁছে যাবে এবং বৃহত্তর জনগণ বঞ্চনার শিকার হবে। আমাদের অতীত সব সরকার পরিচালনার ইতিহাস জনগণের বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস।
এ বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র গঠনে নাগরিক অংশগ্রহণের প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত কোনো রং প্রাধান্য পেলে অবিশ্বাস ও বঞ্চনার বীজ বপন হবে। এ জন্য রাষ্ট্রের উন্নয়ন কার্যক্রমে নিরপেক্ষ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী ও অলাভজনক সংগঠনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। টেন্ডার, সামাজিক নিরাপত্তা, সেবা খাত, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রে এই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারলে এদের নেতৃত্বে দেশের সব নাগরিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় বাধা বা বিভেদ সৃষ্টিকারীদের অবশ্যই আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করতে হবে।
লেখক: আলী আশরাফ, সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা, কানাডিয়ান হাইকমিশন, বাংলাদেশ
[email protected]
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]