বরফে ঢাকা ম্যাপল লিফের কানাডায় দেশে-দুই সপ্তাহের ভ্রমণ

নায়াগ্রা ফলসে লেখকছবি: লেখকের পাঠানো

শৈশবে শুনতাম—দূর উত্তরের এক দেশে শরতের শেষে ম্যাপলপাতায় লেগে থাকে লাল-কমলার রং, আর শীত নামলেই রাস্তাঘাট, পার্ক, ছাদ—সব বরফে ঢেকে যায়। কানাডা তখন ছিল আমার কাছে রূপকথার নাম। বহু বছর পর, পরিবারের হাত ধরে সেই রূপকথার দেশে দুই সপ্তাহ কাটিয়ে বুঝেছি—কিছু গল্প সত্যিই বাস্তবে দেখা যায়।

আকাশপথের রাজকীয় ভ্রমণ–দুবাই থেকে টরন্টো

নভেম্বরের শুরু। ঢাকা থেকে এমিরেটস এয়ারলাইনসে যাত্রা। দুবাইয়ে ট্রানজিটের সময় প্রায়োরিটি পাসে লাউঞ্জে ঢুকে এক কাপ গরম কফি, একটু বিশ্রাম আর কাচের জানালায় সারি সারি বিমান দেখা—সব মিলিয়ে যাত্রার ক্লান্তি অর্ধেক কমে গেল। কানাডা ভ্রমণের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা ছিল দুবাই থেকে টরন্টো পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ারবাস A380-এ যাত্রা। আকাশের রাজপথে চলা বিশাল বিমানটিতে চড়ার মুহূর্ত থেকেই যেন এক অন্য রকম স্বপ্নযাত্রা শুরু হয়েছিল। সুন্দরভাবে সাজানো কেবিন, প্রশস্ত আসন, আরামদায়ক পরিবেশ আর অত্যাধুনিক বিনোদন সুবিধা—সবকিছু মিলিয়ে ভ্রমণটা হয়ে উঠেছিল দারুণ আনন্দময়। ইন-ফ্লাইট সার্ভিস ছিল এককথায় বিশ্বমানের। প্রতিটি খাবার সুস্বাদু এবং বৈচিত্র্যময়, যেন আকাশে বসেই পাঁচতারা হোটেলের আতিথেয়তা উপভোগ করছি।

সবচেয়ে মুগ্ধ করেছে কেবিন ক্রুদের আন্তরিকতা ও হাসিমুখে সেবা। তাঁরা শুধু যাত্রী নয়, প্রতিটি মানুষকে বিশেষ অতিথি হিসেবেই যত্ন নিচ্ছিলেন। আমার মেয়ের জন্য তাঁরা একটি বিশেষ ‘গুডি ব্যাগ’ উপহার দেন, যাতে ছিল খেলনা, রঙিন বই আর ছোট ছোট মজার জিনিস। শিশুর মুখে আনন্দের ঝলক দেখে আমরা অভিভূত হয়েছিলাম। এরপর আরেকটি চমক—মেয়ের জন্য বিশেষভাবে সাজানো একটি ছোট্ট কেক উপহার দেওয়া হয়। আকাশের হাজারো মাইল ওপরে বসে এমন স্নেহমাখা আতিথেয়তা সত্যিই অবিস্মরণীয়। পরিবারের সবাই মিলে কেক খাওয়ার মুহূর্তটি আমাদের যাত্রার সেরা স্মৃতির হয়ে থাকবে। পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পর টরন্টোর প্রথম হাওয়া মুখে লাগতেই বুঝলাম—এখানকার শীত আলাদা। তীব্র নয়, কিন্তু ধারালো; যেন নীরবে বলছে, ‘স্বাগত, কিন্তু সাবধানে থেকো।’

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

স্কারবোরো: প্রবাসের ভেতরে পরিবারের উষ্ণতা

আমাদের কানাডা ভ্রমণের আশ্রয় ছিল টরন্টো শহরের স্কারবোরো এলাকায় চাচির বাসায়। তবে ‘চাচি’ বলা বোধ হয় কম হয়ে যায়—আমার কাছে তিনি মায়ের মতোই প্রিয়, মমতাময়ী। স্নেহমাখা আলিঙ্গনেই বিদেশের মাটিতেও পেয়েছি আপন ঘরের উষ্ণতা। এটা নিছক কোনো বাড়ি নয়—বিশাল ডুপ্লেক্স বাংলো, যার সামনে বড়সড় সবুজে ভরা ফ্রন্টইয়ার্ড আর পেছনে বিস্তৃত ব্যাকইয়ার্ড। দুপুরের রোদে বা সন্ধ্যার হাওয়ায় সেই উঠান যেন আমাদের সবার মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল। ছাদভরা নীল আকাশ, আরামদায়ক বাতাস আর গাছপালার সবুজ ছায়া—সব মিলিয়ে এই বাড়ি একেবারে অন্য রকম প্রশান্তি এনে দিয়েছিল। বাড়ির ভেতরটাও ছিল প্রশস্ত, পরিচ্ছন্ন ও নান্দনিকভাবে সাজানো। জানালায় টানানো পাতলা পর্দায় বিকেলের কোমল আলো ঢুকে পড়ত, আর সেই আলোয় ঘরের পরিবেশ হয়ে উঠত অপূর্ব শান্তিময়। সেখানে বসে কখনো আড্ডা, কখনো কফির কাপে চুমুক—সবকিছুতেই ছিল একধরনের আপন অনুভূতি।

এলাকাটাও ছিল স্নিগ্ধ—শান্তিপূর্ণ আবহাওয়া, গাছঘেরা রাস্তা আর ভদ্র প্রতিবেশীদের বিনয়ী হাসি যেন প্রতিটি দিনকে বিশেষ করে তুলেছিল। প্রথম সন্ধ্যাতেই হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম কানাডার জনপ্রিয় কফিশপ ‘টিম হর্টনস’-এ। সেখানেই প্রথমবারের মতো চেখে দেখলাম বিখ্যাত ‘ডাবল-ডাবল’ কফি—দুধ-চিনির দ্বিগুণে কোমল এক কফি। নামটা যেমন মজার, স্বাদটা তেমনি আপন। দেশের মিষ্টি দুধ চায়ের মতোই সেই কফি হয়ে উঠল প্রতিদিনের সঙ্গী, ভ্রমণের শেষ দিন পর্যন্ত। স্কারবোরোর এই আশ্রয় কেবল থাকার জায়গা ছিল না—এটা ছিল পরিবারের উষ্ণতা, স্নেহ আর ভালোবাসায় ভরা এক পরিপূর্ণ আবাস। কানাডা ভ্রমণের যত স্মৃতি আছে, চাচির বাড়ি তার মধ্যে সবচেয়ে আপন আর হৃদয়ছোঁয়া হয়ে থাকবে সারা জীবন।

কানাডায় লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো

হুইটবির উষ্ণতা: টরন্টোয় আপন ঘরের খোঁজ

টরন্টো যাত্রার আগে থেকেই আমার কাজিন আর তাঁর স্ত্রী ঠিক করেছিলেন, তাঁদের বাসায় নিয়ে যাবেন। স্কারবোরো চাচির বাড়ি থেকে হুইটবি এক ঘণ্টার পথ। ঠিক নির্ধারিত দিনে কাজিন হাজির আমাদের নিতে। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন ছোটবেলার দিনগুলো ফিরে এল—আড্ডা, গল্প আর হাসিঠাট্টায় মুহূর্তেই ভরপুর হয়ে উঠল পরিবেশ। হুইটবিতে পৌঁছে মনে হলো—এ যেন আরেকটা ঘর, নিজের দেশের বাইরে থেকেও যার ভেতরে আছে আপন গন্ধ। তাঁদের ডুপ্লেক্স বাড়িটি ছোট্ট হলেও ভীষণ সুন্দর, আরামদায়ক ও স্নিগ্ধতায় ভরা। বিশেষ করে আন্ডারগ্রাউন্ডের সাজসজ্জা চোখে পড়ার মতো—সেখানে আমার কাজিন তাঁর গেমিং গিয়ার সাজিয়ে রেখেছেন, আর বিশাল টেলিভিশন যেন পুরো ঘরটিকে অন্য রকম আবহ এনে দিয়েছে।

আমাদের যাত্রার সময় কাজিন আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন তাঁদের প্রথম সন্তানের অপেক্ষায়। তবু এই ব্যস্ততার মাঝেও তাঁরা আমাদের সময়টিকে বিশেষ করে তুলতে সব রকম পরিকল্পনা করেছিলেন। শহরের নানা দর্শনীয় স্থান দেখানো থেকে শুরু করে কানাডিয়ান পরিবারের মতো খাওয়াদাওয়া, সবকিছুতেই তাঁরা আমাদের অতিথি নন—পরিবারের সদস্য হিসেবেই দেখেছেন। হুইটবিতে থাকার সময় আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন লেকসাইড পার্কে, যেখানে সূর্যাস্তের লালচে আভা পানির ওপর ছড়িয়ে পড়েছিল অপরূপ দৃশ্য তৈরি করে। টরন্টোর ডাউনটাউন ঘুরে দেখিয়েছেন—উঁচু বিল্ডিং, সরগরম রাস্তা আর সিএন টাওয়ারের কাছাকাছি সেই প্রাণবন্ত পরিবেশ যেন ছবির মতো ফুটে উঠেছিল। কাজিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে, বরং বলা ভালো—তাঁর পরিবার দিবসের ছুটিটা পুরোটা আমাদের জন্য উৎসর্গ করলেন। তিনি চেয়েছিলেন, আমরা যেন কানাডিয়ান জীবনযাত্রা কাছ থেকে অনুভব করি। খাবারের টেবিলে কানাডার নিজস্ব খাদ্যাভ্যাস, ঘরের উষ্ণতা আর স্নেহ—সব মিলিয়ে মনে হলো আমরা কেবল ঘুরতে আসিনি, বরং অন্য এক ঘরে আশ্রয় নিয়েছি।

শহরের দর্শন: জল, কাচ

হারবারফ্রন্টে গিয়ে লেক অন্টারিওর জলরাশি দেখে মনে হলো—নদীর দেশ থেকে এসেছি ঠিকই, কিন্তু এ রকম বিশাল, নীল, স্থিরতা-ভরা জলের সামনে দাঁড়ানো আমার জন্য নতুন। দূরে আইকনিক সিএন টাওয়ার মেঘ ছুঁয়ে থাকা এক অবাক সুইয়ের মতো। রিপলিস অ্যাকুয়ারিয়ামে ঢুকে পড়তেই রঙিন সামুদ্রিক জীবনের রাজ্য যেন চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মতো বয়ে চলল—জেলি ফিশের নরম নাচ, শার্কের রাজকীয় ভঙ্গি, আর টানেল দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাথার ওপর দিয়ে মাছদের সাঁতার। তারপর রেলওয়ে মিউজিয়াম—কানাডার পুরোনো রেলগাড়ির দিনগুলো, কাঠের সিঁড়ি, ধাতব চাকা, ধোঁয়া-গন্ধ; যেন সময়টা একটু থেমে দাঁড়াল। শহরটাকে হাঁটতে হাঁটতেই চিনেছি—ডাউনটাউনের কাচ-ইস্পাতের আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, কামরাঙারঙা সানসেট, ফুটপাতে ছুটে চলা মানুষ আর রাস্তাভরা ভাষার বহর—ইংরেজি, ফরাসি আর আরও কত ভাষা! টরন্টোকে সবাই বলে ‘মাল্টিকালচারাল’; এখানে এসে বুঝলাম, এটা শুধু একটি বিশেষণ নয়—এটা টরন্টোর জীবনরস।

কানাডার অন্যতম জনপ্রিয় কফিশপ ‘টিম হর্টনস’-এ সাজানো খাবার
।ছবি: লেখকের পাঠানো

রূপকথার সঙ্গে দেখা: আপেলঝরা বিকেল

শৈশব থেকে শুনে আসছি—কানাডায় নাকি গাছের নিচে পাকা আপেল পড়ে থাকে, কুড়াতেও কেউ আসে না। তখন মনে হতো, এ নিশ্চয়ই কোনো গল্প। কিন্তু টরন্টো ভ্রমণের বিকেলে সেই গল্প যেন হঠাৎ বাস্তবে ধরা দিল। স্কারবোরো থেকে একটু দূরের এক শান্ত আবাসিক এলাকায় হাঁটছিলাম। চারপাশে নিস্তব্ধতা, গাছঘেরা রাস্তা আর পরিচ্ছন্ন বাড়িগুলো যেন শান্তির আবরণে মোড়া। ঠিক তখনই চোখে পড়ল—একটি উঠানে দাঁড়িয়ে আছে পাতায় ঢাকা এক আপেলগাছ। গাছের নিচে পড়ে আছে লালচে-সবুজ আপেল। রোদে সেগুলো ঝলমল করছে, যেন লাল রত্ন ছড়িয়ে রাখা হয়েছে সবুজ ঘাসের গালিচায়। কিছু আপেলের গায়ে ছোট ছোট দাঁতের দাগ, বোঝা যায় আশপাশের কাঠবিড়ালিরা চুপি চুপি স্বাদ নিয়ে গেছে। দৃশ্যটা এতটাই অদ্ভুত অথচ সুন্দর যে আমি এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম হতভম্ব হয়ে। একটি আপেল হাতে তুলতেই ঠান্ডা, মিষ্টি সুবাস নাকে এসে লাগল। সেই গন্ধে যেন ভেসে উঠল শৈশবের গল্পগুলো। সূর্যের নরম আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এসে সেই আপেলের রংকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছিল। মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো রূপকথার পাতায় দাঁড়িয়ে আছি। ভ্রমণের আসল আনন্দ তো এখানেই—যা শুনেছি, যা ভেবেছি, তা একদিন হঠাৎ নিজের চোখে দেখা। সেই আপেলঝরা বিকেল তাই আমার কানাডা সফরের সবচেয়ে মায়াময় স্মৃতির একটি হয়ে থাকবে।

নায়াগ্রা: জল, গর্জন, রংধনু

আমার টরন্টো ভ্রমণের সবচেয়ে গভীর, তীব্র এবং স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখা। ছোটবেলা থেকে বই আর ছবিতে যাকে দেখেছি, সে বাস্তব রূপে সামনে দাঁড়ালে মনে হলো—প্রকৃতির আসল মহিমা আসলে চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। প্রপাতের দিকে এগোতেই প্রথমে যে শব্দটা কানে এল, সেটি নিছক গর্জন নয়—বরং একটানা বয়ে চলা এক গভীর সুর, যেন পৃথিবীর নিজেরই হৃৎস্পন্দন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার ভেতরের সমস্ত নীরবতা ভেঙে গেল, আবার সেই শব্দের ভেতরেই যেন এক অপার শান্তি খুঁজে পেলাম। অজস্র জলধারা একসাথে ছুটে পড়ছে, ছিটকে আসছে চারদিকে। সূর্যের কোমল আলো যখন পানির কণায় খেলে যায়, তখন সেই কণায় বেঁধে যায় রংধনুর সাত রং। দূর থেকে যেমন অপরূপ লাগে, কাছে গিয়ে তেমনই মনে হয়—প্রকৃতি যেন প্রতিটি দর্শকের জন্য আলাদা আলাদা দৃশ্য এঁকে দিচ্ছে।

নায়াগ্রার ধারে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবার খেতে খেতে আমার মনে হচ্ছিল—এখানে এসে মানুষ এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার অহংকার ভুলে যায়। এই জল, গর্জন আর রংধনুর মায়াবী মিশ্রণ আমাকে এমন এক অনুভূতি দিয়েছে, যা শব্দে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা অসম্ভব। টরন্টো ভ্রমণ হয়তো নানা দিক থেকেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কিন্তু নায়াগ্রা আমার হৃদয়ে বিশেষভাবে গেঁথে থাকবে আজীবন।

ম্যাপল লিফ হাতে লেখকের মেয়ে
ছবি: লেখকের পাঠানো

অপ্রত্যাশিত এক রাত: হাসপাতালের আলো, বিমার আশ্রয়

এক রাতে হঠাৎ চোখে অস্বস্তি—মনে হলো, যেন ভেতর থেকে কিছু বেরিয়ে আসছে। ব্যথা বাড়তে থাকলে কাজিনরা আমাকে নিয়ে গেলেন নিকটস্থ হাসপাতালে। জরুরি বিভাগে অপেক্ষা—এক, দুই, তিন, চার ঘণ্টা…ভোরের দিকে ডাক্তার এলেন; চোখে আলো ফেলে মিনিটখানেক দেখে এক বোতল আই ড্রপ দিলেন।

কাউন্টারে গিয়ে শুনলাম, এই সামান্য চিকিৎসার বিল—প্রায় এক হাজার কানাডিয়ান ডলার। মুহূর্তে বুক ধক করে উঠল। ভাগ্যিস ভ্রমণের আগে ভালো হেলথ ইনস্যুরেন্স করা ছিল। দেশে ফেরার আগেই বিমা কোম্পানি পুরো টাকাটাই কাজিনের অ্যাকাউন্টে রিফান্ড করে দেয়। সেদিনের শিক্ষা স্পষ্ট—উন্নত দেশে চিকিৎসা ব্যয়বহুল, তাই ভ্রমণ বিমা বিলাসিতা নয়; এটা প্রয়োজন।

টরন্টোর দিনলিপি: উৎসব, মানুষ, খাবার

মাঝখানে ছিল কাজিনের বেবি শাওয়ার—হাসি, আয়োজন, খুঁটিনাটি রীতি; পরিবারের উষ্ণতায় প্রবাসও ঘরের মতো লাগে। ডাউনটাউনের অলিগলি পেরিয়ে হাঁটা, মেট্রো থেকে নেমে স্ট্রিটের শিল্পীদের গান শোনা, আর এক বিকেলে শহরের অভিজাত এলাকায় বিশাল, রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি দেখে বিস্মিত হওয়া—এই সব ছোট্ট মুহূর্তেই শহরকে চিনেছি। খাবারের কথা আলাদা করে না বললেই নয়—গ্রেভি আর চিজের মোলায়েমতা; ম্যাপল সিরাপের স্বাদে মিষ্টি ঠান্ডা সকাল; আর, অবশ্যই, টিম হর্টনসের ডাবল-ডাবল কফি । টরন্টোর মানুষজন—রাস্তার হাঁটায় বিনয়ী ‘সরি’ বলা, দরজা খুলে ধরে রাখা—এই ছোট সৌজন্যগুলো শহরটাকে বড় করে তোলে।

নায়াগ্রা টানেলস
ছবি: লেখকের পাঠানো

ভিসা, ডকুমেন্টেশন ও ট্যুর প্ল্যান—নিজ হাতে

ভ্রমণপিপাসু মানুষ হিসেবে আমি সব সময়ই নিজেই ভিসার আবেদন থেকে শুরু করে সব ডকুমেন্টেশন ও ট্যুর প্ল্যান নিজেই করি। এতে একদিকে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ে, অন্যদিকে বাজেটও থাকে আয়ত্তে। কানাডার ভিসা প্রসেসিং জটিল মনে হতে পারে, কিন্তু সঠিক ডকুমেন্টস, পরিষ্কার ব্যাখ্যা, আর সময়মতো প্রস্তুতি—এই তিনটি জিনিস থাকলে সফলতা পাওয়া খুবই সম্ভব। এটা আমার নিজের অভিজ্ঞতা।

ফিরে আসা: যে টুকরা মন সেখানেই রয়ে গেল

দুই সপ্তাহ খুব দীর্ঘ সময় নয়। কিন্তু ফেরার বিমানে বসে মনে হচ্ছিল—এত গল্প, এত মানুষ, এত দৃশ্য—সব কি সত্যিই হয়ে গেল? দেশে ফিরে এসেছি, কিন্তু মন পড়ে আছে স্কারবোরোর জানালায় নরম আলোয়, টিম হর্টনসের উষ্ণ কাপে, আর নায়াগ্রার জলকণায় ধরা রংধনুতে।

ভ্রমণ এমনই—শেখায়, বিস্মিত করে, কখনো অবাক করে, কখনো চুপ করায়। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের ভেতরে একটা নতুন মানুষ জন্ম দেয়—যে মানুষটা একটু বেশি ধৈর্যশীল, একটু বেশি কৃতজ্ঞ, আর একটু বেশি সাহসী।

ভ্রমণকারীদের জন্য ছোট্ট পরামর্শ (আমার অভিজ্ঞতা থেকে)—

  • ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স নিন—অবশ্যই। জরুরি সময়ে এটি-ই ভরসা।

  • স্তরভিত্তিক পোশাক রাখুন—নভেম্বর-ডিসেম্বরে লেয়ারিং আপনাকে আরাম দেবে।

  • ডকুমেন্ট গুছিয়ে রাখুন—পাসপোর্ট, ভিসা, বুকিং, ইনস্যুরেন্স—সবকিছুর ডিজিটাল ও প্রিন্ট কপি দুটোই।

  • নিজে পরিকল্পনা করুন—ফ্লাইট, থাকার জায়গা, রুট—নিজ হাতে প্ল্যান করলে খরচ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং স্বাধীনতা বাড়ে।

  • স্থানীয় সৌজন্য শিখুন—একটা ‘সরি’ বা ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ শহরকে আপনার জন্য আরও উষ্ণ করে দেবে।

হারবার পয়েন্ট ও সিএন টাওয়ারের সামনে লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো

শেষ কথা—

কানাডা আমার কাছে এখন আর কেবল দূরের এক দেশ নয়; এটা এমন এক অভিজ্ঞতা, যেখানে প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে ভ্রমণকে পরিণত করে জীবনের পাঠে। নায়াগ্রার গর্জন শিখিয়েছে—প্রকৃতির শক্তির সামনে মানুষ ক্ষুদ্র হলেও সেই ক্ষুদ্রতার ভেতরেই আছে এক গভীর সৌন্দর্য। আবার টিম হর্টনসের এক কাপ ডাবল-ডাবল কফি শিখিয়েছে—ভ্রমণের আসল আনন্দ সব সময় বড় আয়োজনের ভেতর লুকিয়ে থাকে না, বরং ছোট ছোট মুহূর্তেই ধরা দেয় জীবনের আসল উষ্ণতা।

এই সফরে আমি দেখেছি প্রকৃতির অপার রূপ, পেয়েছি পরিবার-পরিজনের সান্নিধ্য আর কাছ থেকে অনুভব করেছি কানাডিয়ান জীবনযাপনের ছন্দ। ভ্রমণ একসময় শেষ হয়, বিমানের চাকা নেমে আসে মাটিতে। কিন্তু তার আসল সৌন্দর্য থেকে যায় স্মৃতির ভাঁজে—গল্প হয়ে, ছবি হয়ে, কখনো আবার নতুন পথে হাঁটার অনুপ্রেরণা হয়ে। আমার কানাডা সফরও তাই শেষ নয়; বরং নতুন ভ্রমণপিপাসার সূচনা মাত্র।

  • লেখক: তারানা তাবাসসুম তুলি