জ্যাকারান্ডা
কাজে যাবার উদ্দেশ্যে খুবই ভোরে বাসা থেকে বের হতে হয়। দেশে থাকতে এমন ভোরবেলা উঠে কাজে যাওয়ার কথা হাসান কল্পনাতেও ভাবেনি। কিন্তু এখন সেটাই করতে হচ্ছে প্রতিদিন। বাসা থেকে স্টেশন প্রায় আধা ঘণ্টার হাঁটা পথ। তবে তার লাগে বিশ মিনিট। কারণ, তার কদম লম্বা আর ফেলার গতিও দ্রুত। ছোটবেলায় যখন আব্বা কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের গলি থেকে বাজার করে দিত। তখন তাকে ফিরতে হতো রেললাইন ধরে। হেঁটে আসার কারণ, ভ্যান ভাড়া দেওয়ার মতো বাড়তি পয়সা আব্বার কাছে থাকতো না। রেললাইন ধরে গেলে আলাদাভাবে আর রাস্তা মনে রাখতে হতো না। উপরন্তু রেললাইনের স্লিপার থেকে স্লিপারে পা ফেলতে গিয়ে তাকে মোটামুটি লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হতো। ফলে দ্রুতই বাড়ি পৌঁছে যেত। বাড়ি পৌঁছে তৈরি হয়ে আবার স্কুলে রওনা দিতে হতো।
অস্ট্রেলিয়াতে এসে তার এই পুরোনো অভ্যাসটা খুবই কাজে লেগেছে। বাসা থেকে স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে আসা–যাওয়া করতে তার আর তেমন কষ্ট হয় না। তবে সে এখনো এদেশের পোশাকে অভ্যস্ত হতে পারেনি তাই ঠান্ডাটা একটু বেশি লাগে। হাসান গরমের দেশের মানুষ তাই গরম সহ্য করতে পারে। কিন্তু ঠান্ডায় একেবারে কুঁকড়ে যায়। গায়ে টি–শার্টের ওপর জ্যাকেট পরে। কিন্তু পরনে বাংলাদেশ থেকে আনা পাতলা কাপড়ের প্যান্টে শীতের হাওয়া মানে না। আর পায়ে দেশ থেকে কিনে আনা বাটার ছই–অলা স্যান্ডেল। সে দেখেছে এ দেশের মানুষ শীতকালে সব সময়ই কেডস পরে। আর মাথায় থাকে হুডি বা বিনি। এ দেশের মাথার শীতের টুপিকে বিনি বলে।
কিন্তু হাসানের জুতা পরার অভ্যাস নেই। বাংলালিংকের মতো করপোরেট কোম্পানিতে চাকরি করতে গিয়েও সে এটা রপ্ত করতে পারেনি। শুধু অফিসের সময়টুকু কোনোমতে জুতা পরে পার করে দিত। এরপর সে স্যান্ডেল পরেই সাইটে যেত। আর তার কাজ যেহেতু ছিল বাইরে বাইরে, তাই আর জুতা পরা লাগেনি। আর মাথায় টুপি পরার মতো শীত কোনোকালেই ঢাকা শহরে পড়েনি। আর নিজের জেলা কুষ্টিয়াতে শীতের প্রকোপ বেশি হলেও সে মাথায় টুপি কখনো পরেনি। কারণ, তার এতে দমবন্ধ হয়ে আসে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ঠান্ডার জন্য মনে হচ্ছে এসব অসম্ভবকেই সম্ভব করতে হবে।
হেঁটে যাওয়া–আসা করাটা সে উপভোগই করে। কারণ, যাওয়া–আসার পথে অনেক দৃশ্য দেখা যায়। বহু সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়াতে বিভিন্ন দেশের মানুষ বাস করেন। তাদের শারীরিক আকার যেমন ভিন্ন তেমনি তাদের ভাষাও ভিন্ন। আর বাংলাদেশের মতোই অস্ট্রেলিয়ার প্রকৃতিও অনেক বর্ণিল। ঋতুর সাথে তাল মিলিয়ে প্রকৃতির রং বদলায়। তবে সবচেয়ে বর্ণিল এখানকার বসন্তকাল। এখানেও বসন্তকালে কুহু স্বরে কোকিল ডেকে উঠে। কিন্তু দেশের মতো পথঘাট শিমুল আর মান্দার ফুলে ছেয়ে যায় নাই। তার পরিবর্তে এখানে জ্যাকারান্ডা নামে বেগুনি রঙের একটা ফুল ফোটে। বসন্তকালে পথঘাট সব বেগুনি রঙের মাদুরে ঢাকা পড়ে যায়।
হাসান দূর থেকেই বুঝতে পারে কাছাকাছি কোথাও জ্যাকারান্ডা গাছ আছে। কারণ, জ্যাকারান্ডা ফুল থেকে একটা সূক্ষ্ণ ঘ্রাণ পাওয়া যায়। এই ঘ্রাণটা পাওয়ার সাথে সাথে তার গরুর গোয়ালের চুনার গন্ধের কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় তাদের অনেকগুলো গাভি ছিল। তারা পালা করে প্রায় সারা বছরই দুধ দিত। তখন উম্মাত গোয়াল এসে দুধ দুইয়ে নিয়ে যেত। সম্পর্কে উম্মাত গোয়াল তার দাদির চাচাতো ভাই হতো। বাঁশের বাঁকের দুপ্রান্তে রুপার মতো উজ্জ্বল দুটো বড় টিনের পাতিল ঝুলানো থাকত। সে বিভিন্ন বাড়িতে গরু দুইয়ে তার মধ্যে দুধ জমা করতো। এরপর দিন শেষে সেটা শহরে নিয়ে ফেরি করতো।
উম্মাত গোয়াল আসলেই হাসানের ওপর দায়িত্ব পড়ত গরুর বাছুরের দড়ি ধরে রাখা। তা না হলে বাছুরটা সব দুধ খেয়ে ফেলবে। দুই হাতের আঙুলে ভালো করে সরিষার তেল মাখিয়ে সেগুলো দিয়ে প্রথমে দুধের বানগুলোকে তেলতেলে করে দুধ দোয়ানো শুরু করত। সেই দুধ টিনের বালতির মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ছন্দে এসে পড়তো। সব গাভি দোয়ানো শেষ হলে বালতি থেকে দুধ মেপে টিনের পালিতে রাখা হতো। তারপর সাথে আনা বাঁশের কঞ্চির গায়ে দাগ কেটে দুধের পরিমাণের হিসাব রাখা হতো। এরপর আসতো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দাদি দুধের পোয়ার একপোয়া কাঁচা দুধ হাসানের দিকে এগিয়ে দিতেন তার বাছুর ধরে রাখার পারিশ্রমিক হিসাবে। তাই গরুর গোয়ালের চনার গন্ধ হাসানের খুবই চেনা।
জ্যাকারান্ডা ফুলের গাছটার পাতা চিরল চিরল। অনেকটা বাংলাদেশের কৃষ্ণচূড়ার পাতার মতো। শীতের সময় পাতা ঝড়িয়ে পুরো গাছটা শীতনিদ্রায় চলে যায়। তখন মনে হয় যেন গাছটা মারা গেছে। এরপর বসন্ত আসলে সেই মরা গাছের সারা শরীরে একসময় ফুলের কুঁড়ি, এরপর ফুল ফুটে ওঠে। তখন গাছটার জায়গাটা একটা বড় বেগুনি রংয়ের ঝোপের আকার নেয়। গাছের ডালপালা সব ঢাকা পড়ে যায় বেগুনি রংয়ের আড়ালে। আর প্রতিদিন সকালে গাছের তলায় মনে হয় কে যেন বেগুনি রংয়ের মাদুর বিছিয়ে দিয়েছে। আর কংক্রিটের ওপর ফুলগুলো পড়লে সেগুলো পচে গিয়ে রাস্তাটাকে পিচ্ছল করে দেয়। তখন হাসান ফুটপাত বাদ দিয়ে ঘাসের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যায়।
জ্যাকারান্ডা ফুলের মৌসুম আসলেই প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে এক ধরনের বালখিল্যভাব প্রবল হয়ে ওঠে। তারা দেশের মতো করে এখানেও বসন্ত উৎসব করতে উঠেপড়ে লাগে। আর প্রথম বছর একজন শুরু করলে পরের বছর দশটা সংগঠন দাঁড়িয়ে যায় একই উৎসব পালনের জন্য। ব্যাপারটা এমন যে ও যদি আয়োজন করতে পারে, আমি কেন পারব না। আর প্রবাসীদের সংগঠন করা বিষয়ে একটা কথা বহুল প্রচলিত। সেটা হচ্ছে দুজন মানুষ হলে সংগঠন হয় তিনটা। প্রত্যেকে আলাদাভাবে একটা করে সংগঠন আর দুজন মিলে আরেকটা সংগঠন গঠন করে ফেলেন। এসব মানুষ দেশ বদলান রাতারাতি কিন্তু খাসলত আর বদলাতে পারেন না। তাই প্রবাসীদের একজনের পেছনে আরেকজনের কামড় দেয়াটা এখন কিংবদন্তির রূপ নিয়েছে।
এখানেও প্রবাসীদের মধ্যে তারাই মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে উচ্চকিত স্বর যারা চরিত্রগতভাবে অতি দূষিত। হাসান ভেবে পায় না এরা কীভাবে অপদ্রব্য হিসাবে মেইনস্ট্রিমে ঢুকে পড়ে। অবশ্য একটা উত্তরও পেয়েছে, সেটা হলো দেশের মতোই প্রবাসী শিক্ষিতরা রাজনীতির বিষয়ে নাক সিটকায়। অবশ্য এরাই আবার বাংলাদেশি সেইসব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিজেদের অনুষ্ঠানে ডেকে আনেন। হাসান দেখেছে এইসব জনপ্রতিনিধিদের একটাই কাজ। সেটা হলো কোন অনুষ্ঠানে গিয়ে ফিতা কাটা আর ঝাঁজালো একটা বক্তব্য দেয়া। সেটা শেষ করে ফ্রিতে নাস্তা, দুপুরের খাবার বা রাতের খাবার খাওয়া। এর বাইরে এদের আদৌ আর কোনো কাজ আছে কি না, হাসানের বোধগম্য হয় না।
বিভক্তির বিষয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো তো আরও এক কাঠি ওপরে। কে প্রথম, সবাই এটা নিয়েই সারাক্ষণ চিৎকার–চেঁচামেচি করছেন। সারা বছর কোনো কাজের কাজ কিছু নেই। বছরান্তে একটা অনুষ্ঠান। আবার সেই অনুষ্ঠানে দেশ থেকে অতিথি আনার নামে অনেকেই রমরমা আদম ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এইসব রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কুকর্ম দেশে অতটা আলাদাভাবে চোখে না পড়লেও এখানে চোখে পড়ে। কারণ, এখানে বাংলাদেশি কমিউনিটি অনেক ছোট। সবাই সবাইকে মুটামুটি চেনে। পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি সংগঠনের আছে নামকাওয়াস্তে নিজস্ব অনলাইন পত্রিকা। সেখানেও চলে নিজেদের গুণগান আর অন্যসংগঠনের বিষোদ্গার। আর বর্তমান সময়ে শুরু হয়েছে আরেক ফ্যাশন। সেটা হচ্ছে ফেসবুককেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপ। এমনকি অনেকেই পরিচয়ের সময় বলে থাকেন, আমি কলাগাছ গ্রুপের অ্যাডমিন।
আর এখানে যেহেতু ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া খুবই সহজ তাই রাতারাতি অনেকেই নিজেকে সেই গ্রুপের মালিকও ঘোষণা করে বসে। এ এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তবে সুখের খবর হচ্ছে, বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই এসব ধান্দাবাজির বাইরে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এসব অনাচার দেখে তারা চুপ করে থাকে। এতে করে তারা আরও উৎসাহ পেয়ে যায়। ঠিক দেশের মানুষের মতো। যতক্ষণ না নিজে আক্রান্ত হচ্ছে, ততক্ষণ চুপ করে থাকে। আর রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চনার মতো। তাঁরা যেখানেই যান, যেখানেই বসেন, যেখানেই কথা বলেন—আশা করেন সাধারণ লোকজন তাদের হ্যাঁর সঙ্গে হ্যাঁ মিলিয়ে যাবেন। বাস্তবে হয়ও তাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সামনাসামনি হ্যাঁ মিলালেও ঘুরেই কিন্তু গালমন্দ করেন। কারণ, সবাই জানেন তাঁরা মুখ দিয়ে অহরহ আবর্জনা উদ্গীরণ করে চলেছেন। এগুলো দেখে হাসানের আর সহ্য হয় না। তখন তার মনে হয় উপনিবেশ আসলে বাংলাদেশিদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে গেছে। সেটা সোজা হতে কয়েক শ বছর লেগে যাবে।
হাসান কোনো একটা বইয়ে পড়েছিল, একটা জাতির অধঃপতনের সবচেয়ে বড় কারণ সেই জাতির রাজনীতিবিমুখতা। রাজনীতিবিদদের নিয়ে বিষোদ্গার করে যে মানুষটা তাদেরকে দূরে ঠেলে রাখে, সেই মানুষটাই আবার অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য তার কাছে ধরনা দেয়। তাই রাজনীতিবিদরা জানেন দিন শেষে সবাই তাদের কাছেই ধরা। এই ব্যাপারটা দেশে থাকতে হাসানের কাছে অতটা দৃষ্টিকটু লাগেনি, কারণ, পরিবেশটাই ছিল এমন। কিন্তু প্রবাসের এই ছোট কমিউনিটিতে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের কদর্যতাটা বড্ড বেশি চোখে পড়ে। কিন্তু দিন শেষে আবার এরাই বিদেশের মাটিতেও দাপিয়ে বেড়ায়। এই মানুষগুলোর চক্ষুলজ্জা বলে কোনকিছু নেই। তখন হাসানের মনেহয় জ্যাকারান্ডা যেমন দূর থেকে সুন্দর কিন্তু কাছে গেলেই চনার গন্ধ ছড়ায়। তেমনি এই রাজনীতিবিদরা যেন এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চনার মতো, যে পুরো দুধের গুণ নষ্ট করে দেয়।