চন্দ্রগ্রস্ত
ভরা কটাল ও মরা কটাল—ছোটবেলায় অষ্টম শ্রেণিতে বিষয়টা নিয়ে প্রথম পড়েছিলাম। মনে থাকার কারণ, প্রশ্নটা অষ্টম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষায় এসেছিল। আমার জন্ম কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশহরিপুর ইউনিয়নের চরভবানীপুর গ্রামে।
অফিশিয়াল মানচিত্রে পদ্মা নদীর এক পারে কুষ্টিয়া আর বিপরীত পারে পাবনা। কিন্তু একমাত্র আমাদের গ্রামটা ছিল পদ্মা নদীর পাবনার পাড়ে। সময়ের পরিক্রমায় নদী তার গতিপথ বদলায়। তখন এক পাড় ভাঙে আর অন্য পাড়ে চর জেগে ওঠে। এমনই একটা চর হচ্ছে চরভবানীপুর। এখন অবশ্য ফারাক্কা বাঁধের বিষাক্ত ছোবলে পদ্মা নদী মৃতপ্রায়। তাই এর বুকজুড়েই এখন ধু ধু বালুচর।
আমার তখনো সমুদ্র দেখা হয়নি। তাই জোয়ার–ভাটা সম্বন্ধে ন্যূনতম ধারণা ছিল না। অনেক কষ্ট করে তাই ভরা কটাল ও মরা কটালের পার্থক্য মুখস্থ করতে হয়েছিল। এরপর সময়ের পরিক্রমায় একসময় প্রশিক্ষণ নিতে ভারতের গোয়ায় যেতে হয়েছিল। সেখানে গিয়ে সমুদ্র দেখে আমার তো মাথা খারাপ অবস্থা। প্রশিক্ষণের সময়টা ছাড়া বেশির ভাগ সময়ই সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। আমরা যখন গিয়েছিলাম, তখন ছিল বর্ষাকাল। তাই স্থানীয় লোকজন পানিতে নামতে নিষেধ করেছিলেন। আমার মনে পড়ে, বর্ষাকাল এলে আমাদের গুরুজনেরাও বলতেন, পদ্মা নদী এখন পাগল, তাই তোমরা সাবধানে থাকো। মনে পড়ে, তখন রাতে ঘুমের মধ্যেও আমরা পদ্মা নদীর পানির ডাক শুনতে পেতাম।
যাহোক, আমাদের শৈশবে চাঁদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। আমাদের গ্রামে স্বভাবতই বিদ্যুৎ ছিল না। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঘরে কুপি জ্বলে উঠত। আর একটু সচ্ছলদের ঘরে হারিকেন। পূর্ণিমা তিথি তাই আমাদের জন্য অনেক খুশি বয়ে নিয়ে আসত। পূর্ণিমা তিথির দিনগুলোয় ছেলে–বুড়ো সবাই মিলে গ্রামের তেমাথায় জড়ো হয়ে যেতাম। তারপর বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে চলত বিভিন্ন রকমের খেলাধুলা। পূর্ণিমারাতগুলোয় দিনের মতো প্রায় সবকিছু দেখা যেত। তাই সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের দেরি হয়ে যেত। মায়েরা কখনোই আমাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেন না। কারণ, আমাদের পাশাপাশি বড়রাও মোড়ে বসে আড্ডা দিতেন বা কোনো খেলাধুলা করতেন।
বছরের একটা সময় মা–খালারা নানাবাড়িতে নাইওরে যেতেন। সেই সময় আমাদের জন্য ছিল আরও বেশি উপভোগ্য। চাঁদের আলোয় উঠানে খেজুরপাতার পাটির বারোয়ারি বিছানা পাতা হতো। তারপর নানি বিছানায় শুয়ে রূপকথা শোনাতেন। কে নানির পাশে শোবে, এটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি লেগে যেত। তখন নানিই তার সমাধান দিতেন বয়স অনুসারে। এ যেন বইয়ে পড়া শ্লোক বলা কাজলা দিদির আসর। বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠলেই যার কথা মনে পড়ে অবুঝ খোকার। আকাশের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনতে শুনতে আমরা একসময় ঘুমিয়ে যেতাম। তারপর স্বপ্নের মধ্যে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়তাম রাক্ষসপুরী থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে। সোনার কাঠি আর রুপার কাঠির ছোঁয়ায় রাজকন্যার ঘুম ভাঙাতে।
এ ছাড়াও ধান তোলার মৌসুমে চাঁদের আলোয় চলত মাড়াইয়ের কাজ। ধান মাড়াইকে আমাদের এলাকায় বলে ‘মলন’ দেওয়া। বাড়ির সামনের একটা অংশের ঘাস পরিষ্কার করে লেপে ‘খোলা’ প্রস্তুত করা হতো। তার মধ্যে বৃত্তাকারে ধান ছড়িয়ে দেওয়া হতো। তারপর গরুর গলার দড়ি একটার সঙ্গে অন্যটার বেঁধে তাদের দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মলন দেওয়া হতো। কেন্দ্রের গরুটা ঘুরত সবচেয়ে কম। আর একে একে দূরের গরুগুলো ঘুরত বেশি। গরুর খুরের আঘাতে শিষ থেকে ধান আলাদা হয়ে মাটিতে পড়ত। এরপর গরু সরিয়ে খড়গুলো আলাদা করে নেওয়া হতো। তখন নিচে পড়ে থাকত ঘন বাদামি রঙের আউশ ধান। ধান মাড়াইয়ের কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্যই রাতের বেলাতেও মলন দেওয়ার কাজটা চালিয়ে নেওয়া হতো। পূর্ণিমা রাত হলে সেটা আরও বেশি সহজ হয়ে যেত।
এরপর নদীভাঙনের কবলে পরে আমরা একসময় কুষ্টিয়ার বাড়াদীতে বসবাস শুরু করলাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গড়াই-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের খাল। গ্রামের শেষ প্রান্তে খালের ওপরের কালভার্ট পার হলেই অবারিত খেত। তার মধ্য দিয়ে মাটির উঁচু বাঁধের রাস্তা গ্রামের তিন প্রান্ত থেকে এসে মাঠের মাঝখানে মিলেছে। তারপর সেটা চলে গেছে বারখাদার দিকে। সেই রাস্তার দুই পাশে ছিল সারি সারি বাবলাগাছ। সকাল–বিকেল আমরা সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটাহাঁটি করি। আবার পূর্ণিমারাত এলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি সেই রাস্তা ধরে। দিনের বেলায় দেখা চেনা জায়গাগুলোকেই রাতের বেলায় কেমন অচেনা লাগে। রাস্তায় বাবলাগাছের ছায়া পড়ে এক রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে। মাঝেমধ্যে আমরা আবার চাঁদের আলোয় দল বেঁধে বনভোজন করতাম। আর পাশেই বাকি অন্যরা শীতলপাটি বিছিয়ে বসে যেত তাস নিয়ে। সেই খাবারের স্বাদ অতুলনীয়।
ঢাকায় আসার পর হলের রুমমেট ফরহাদের মাধ্যমে পরিচয় হলো হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে। তাঁর জোছনা নিয়ে বাড়াবাড়িটা একসময় আমাদের মধ্যেও সংক্রমিত হলো। পূর্ণিমারাত এলেই আমি আর ফরহাদ রাতের বেলা চলে যাই হলের ছাদে। এরপর উঠে পড়ি ছাদের ওপরের পানির ট্যাংকের ছাদে। সেখান থেকে রাতের ঢাকাকে দেখি। বিদ্যুতের আলোর কাছে চাঁদের আলোকে কেমন যেন ফিকে লাগে। হঠাৎ হঠাৎ লোডশেডিং হলে চাঁদের আলোয় চারপাশে এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আমি আর ফরহাদ তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতাম কখন লোডশেডিং হবে। শহুরে মানুষদের এত সময় কোথায় যে ল্যাম্পপোস্টের চোখ ফাঁকি দিয়ে পূর্ণযৌবনা চাঁদের দিকে তাকাবে। কিন্তু লোডশেডিং হলে অন্ততপক্ষে সেই সুযোগ তৈরি হতো।
সময়ের পরিক্রমায় একসময় সিডনি চলে আসা। এখানে আসার পর পূর্ণিমারাতে বাসার বাইরে যাওয়াটা অভ্যাসে রূপ নিল। আর এতে আমার সঙ্গী হয়ে গেল ছেলে–মেয়ে দুজনই। এ ছাড়া প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবের মধ্যেও আমার পাগলামি ছড়িয়ে গেছে। পূর্ণিমারাত এলেই বাচ্চাকাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে আমরা বাসায় ফিরি। মাঝেমধ্যে আমরা পুরো পরিবারও সঙ্গে নিয়ে নিই। বিশেষ করে কোভিডকালে যখন চলাফেরার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হলো, তখন আমরা বাসার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যের ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে জোছনাবিলাস করতাম। জোছনার আলোটাই এমন যে চরম যান্ত্রিক মানুষকেও সামান্য সময়ের জন্য কাতর করে তোলে। উপরন্তু, আমরা তো কিছুটা পাগল গোছেরই। তাই পূর্ণিমারাত এলেই আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি।
এ ছাড়া একবার আমরা আর বন্ধু আসাদের পরিবার মিলে এ পার্কে চাঁদের আলোয় রাতের খাবার খেলাম, যেখানে বিদ্যুতের আলোর তেমন চোখরাঙানি ছিল না। সেদিন পূর্ণিমারাত থাকায় চাঁদের আলো ছিল অনেক উজ্জ্বল। খাওয়া শেষ করে বড়রা হাঁটাহাঁটি করল। আর আমাদের ছোটবেলার মতো ছোটরা মেতে উঠল বিভিন্ন ধরনের খেলায়। এভাবে একটা দারুণ সময় আমরা কাটিয়েছিলাম। অস্ট্রেলিয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদন হয় পর্যাপ্ত, তাই লোডশেডিং একেবারেই হয় না বললেই চলে। তাই পূর্ণিমারাতের চাঁদের আলোর মায়াবী রূপটা সেভাবে চোখে পড়ে না। পূর্ণিমারাত এলেই আমার ইচ্ছা করে শহরজুড়ে ব্ল্যাকআউট করে দিতে। তাহলে শহরের মানুষেরা অবাক–বিস্ময়ে দেখতে পেত প্রকৃতির কত অকৃত্রিম উপহার থেকে তারা নিজেদের বঞ্চিত করছে। কিন্তু সেটা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই আমরা মাঝেমধ্যে কয়েক পরিবার মিলে জঙ্গলে চলে যাই জোছনাবিলাসে।
অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর অনেক ধরনের পূর্ণিমার নাম জানলাম। কোনোটা পিংক মুন আবার কোনোটার নাম ব্লু মুন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে নামগুলো দ্রুতই প্রচারও পেয়ে যায়। কিন্তু নাম যেটাই হোক, পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মায়াবী রূপ দেখার অবসর এ শহরের মানুষদের নেই। আর অবসর থাকেলও বিদ্যুতের আলোর ঝলকানির কাছে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ফিকে হয়ে যায়। সভ্যতার অগ্রগতি আমাদের প্রতিনিয়তই রাক্ষুসে, স্বার্থপর ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে গড়ে তুলছে। বিদ্যুতের আলোর ঝলকানিতে আমরা দিশাহারা। আর আমরাও যেন বিদ্যুতের তারের ইলেকট্রনের মতো তাড়া করে চলেছি ঘড়ির কাঁটাকে। আমরা ভুলেই গেছি প্রকৃতির অপার্থিব, অমূল্য সব উপহারের কথা। প্রকৃতি অকৃপণভাবে আমাদের চারপাশে অনেক বিনোদনের উপকরণ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রেখেছে। আমাদের শুধু দরকার একটু অবসর, একটু স্থিরতা। তাহলেই আমরা উপলব্ধি করতে পারব শুধু এই ছুটে চলার নামই জীবন নয়। তাই গতিময়, বিষণ্ন, একাকী ভালো থাকার এই জীবনকে আমাদের নিয়ে যেতে হবে প্রকৃতির কাছাকাছি।
লেখাটা শুরু করেছিলাম ভরা কটাল ও মরা কটাল দিয়ে। সেখানে ফিরে আসা যাক। চাঁদের আকর্ষণে যেমন সমুদ্রে জোয়ার আসে, তেমনি কি আমাদের শরীর ও মনে জোয়ার আসে। ছোটবেলায় শুনতাম, শরীরের কোনো পুরোনো ব্যথা অমাবস্যা–পূর্ণিমা তিথিতে বেড়ে যায়। সেটা খুবই সম্ভব, কারণ আমাদের শরীরের শতকরা ৬০ ভাগই নাকি পানি। আর মানুষের মন তো সব সময়ই তরল। তাই এখনো পূর্ণিমারাত এলেই কেন জানি আমার ঘুম ভেঙে যায়। অনেক সময় এমন হয়েছে, কাজের চাপে পূর্ণিমার কথা ভুলে গিয়েছি। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বাসার পেছনের দরজা খুলেই দেখি মিশু ভাইদের তালগাছটার মাথার ওপর দিয়ে চাঁদমামা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিচ্ছে। আমিও বেরিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি মায়াবী আলোয়। তখন মনে হয়, জীবন আসলেই সুন্দর!