রুবামণির কাছে খোলা চিঠি

আমরা বড় হয়েছি খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের সিনিয়র কলোনিতে। একসঙ্গে স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা ও কলোনিতে হাঁটাহাঁটি সবই। একটা নতুন ড্রেস বের হলে পরে দেখাতি, অপূর্ব রাজকন্যা, কী যে সুন্দর লাগত তোকে। ছাত্রী হিসেবেও তুই ছিলি অনন্যসাধারণ। ছোট্ট থেকে বড় হওয়ার সব কথাগুলো তোর সঙ্গেই শেয়ার করতাম।

এইচএসসি পর্যন্ত একসঙ্গে পথচলা সব সময়। তারপর তুই চলে গেলি আইন পড়তে আর আমি মেডিকেলে। ১৮তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে বিচার বিভাগে যোগদান করলি, টুকটাক দেখা আর কথা হতো পৃথিবীর দুই প্রান্ত থেকে। সৎ ও পরিশ্রমী তোর সূর্যের দ্যুতি ছড়ানোর খবর জানতাম লোকমুখে।

তখন ঢাকায় পোস্টিং, আব্বু একদিন বললেন জমিসংক্রান্ত কী এক কাজে কোর্টে যেতে হয়েছিল তাঁকে, এজলাস থেকে নেমে এসে নাকি সালাম করেছিলি। কী আশ্চর্য ক্ষণজন্মা মেয়ে এত মর্যাদাসম্পন্ন হয়েও মানুষকে সম্মান দিতে ভুলে যাসনি। যত ল ইয়ারকে তুই রেফার করেছিস ওনাদের, সবাইকে বলেছিস উনি আমার চাচা। একটু খেয়াল করবেন।

২০১৮ সালে তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, প্রটোকল ছাড়াই এসেছিলি আব্বুর বাসায়। আমার কন্যা মা-কে দেখে বলেছিলি ইশ্‌ সত্যজিৎ রায় কেন যে তোর মেয়েকে খুঁজে পেলেন না। ওনার সিনেমার নায়িকা হতো আমার এই মা মণি।

২০১৯ সালের কোনো এক অসম্ভব মন খারাপ করা বিকেলে তোকে ফোন করেছিলাম। বলেছিলাম রুবা নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে চলে যেতে হবে, আমার জায়গা এ সংসারে অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে। ছোট্ট বাবুদের নিয়ে পারব তো? তুই বলেছিলি, পারতে তোকে হবে। আমি পেরেছিলাম সেই ছোট্ট বয়সে চাকরির শুরুতেই, তারপর ইংল্যান্ডে ট্রেনিংসহ সব করেছি একা একা। আমেরিকা চলে যাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যাইনি। দেশের মায়ায়। আমারই তো বন্ধু তুই, তার ওপর বাচ্চা আছে, ওদের জন্য তো সব বাধা পার হয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে। চোখ মুছে ফেল। চোখ মুছে ফেলেছি, তোর কথাগুলো আমার সারা জীবন মনে থাকবে।

কথা ছিল কোনো একবার দেশে গেলে স্কুলের বন্ধুদের নিয়ে গেট টুগেদার করার। হয়নি আর হবেও না কোনো দিন। বন্ধুদের খোঁজখবর রাখা, প্রয়োজনে সাহায্য করা তো ছিল তোর সব সময়ের কাজ। কী কষ্ট, কী কষ্ট! বড় অসময়ে চলে গেলি বন্ধু আমার। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

পরির মতো দেখতে তুই, চলে গেলি বেহেশতের বাগান আলোকিত করতে। তোর ছোট্ট বাবুদের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। ভাই, আল্লাহ এই শোক বইবার শক্তি দিন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোকে খুব মিস করব রুবা। আল্লাহ তোকে বেহেশতের সর্বোচ্চ আসনে আসীন করুন। আমিন।

(খুলনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের দক্ষ বিচারক (ডিস্ট্রিক্ট জজ) দিলরুবা সুলতানা স্মরণে ২০১৫ সালে শিশু রাকিব হত্যা মামলার রায় মাত্র ২১ দিনে সম্পন্ন করে এবং এ রকম অনেক ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করে যিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন)

* ১৯৭৪-২০২৪, মৃত্যুকাল ২০২৪ সালের ৭ এপ্রিল সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে খুলনা সিটি হাসপাতালে