প্রিয় বাংলাদেশ আর আমার ভাবনা

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

প্রায় চার বছর পর খুব সংক্ষিপ্ত সফরে বাংলাদেশ ঘুরে এলাম। বাংলাদেশ যে আসলেই দৃশ্যমান গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের মডেলও বলা যেতে পারে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, কর্ণফুলী টানেল, ডিজিটাল ভিলেজ, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, পেনশন ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্প এখন দৃশ্যমান মেগা প্রকল্প। বিশ্বখ্যাত নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন সম্ভবত তাই বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য বাংলাদেশের আছে।

বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় সাফল্যে আমি সত্যি বিস্মিত হয়েছি। ভূমিসংক্রান্ত আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজ থাকায় এই সেক্টরে ভূমির মৌজা ম্যাপ, খতিয়ান কম্পিউটারাইজেশন, ডিজিটাল ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ, জমির খারিজ, পর্চা, খাজনা—এসব কার্যক্রম অনলাইন হওয়ায় এই খাত দুর্নীতিমুক্ত হবে বলেই বিশ্বাস।

অতি সংক্ষিপ্ত সফরে অনেকগুলো জেলায় তাদের আমন্ত্রণে কিংবা আমার ব্যক্তিগত কাজে আমাকে যেতে হয়েছে। ময়মনসিংহ জেলার ব্রহ্মপুত্র নদ ঠিক আগের মতোই আছে। এ জেলার হোমিওপ্যাথিক কলেজটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সংগ্রহশালা, জাদুঘর, সিলভার প্যালেস, রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি, বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। এ জেলার কুমির খামার, গারো পাহাড় দেখার আমার খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু সময়াভাবে তা দেখা হয়ে ওঠেনি। জেলার জামতলায় এক খালাম্মার আতিথেতায় আমি পুরোপুরি মুগ্ধ। চৈতির আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না। শহরের খুব কাছাকাছি পনঘাগড়া চরখাই গেছি। এখানে নির্মিত বিনোদনের একমাত্র পার্ক, যা মির্জা পার্ক (প্রিয়কুঞ্জ) নামেই খ্যাত।

অবকাঠামোগত তেমন কিছুই চোখে পড়ার মতো নয়, তবে এর কলেবর আরও বাড়ানোর সুযোগ এখানে রয়েছে। যত্রতত্র ময়লা, মাত্রাতিরিক্ত প্রবেশমূল্যের সঙ্গে সেবার মান খুবই নগণ্য বলে মনে হয়েছে।

নরসিংদী জেলার বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মৃতি জাদুঘর দেখেছি, গিরিশচন্দ্র সেনের ভিটা, জমিদার লক্ষ্মণ সাহার বাড়ি, শাহ ইরানি মাজার আমার খুব ভালো লেগেছে। ঢাকার খুব কাছের জেলা মানিকগঞ্জ, শর্ষেখেতের সৌন্দর্য দেখতে হলে এ জেলায় আপনাকে আসতেই হবে। ঝিটকার খেজুরের রস (এখন মৌসুম নয় বলে খেতে পারিনি), তালের রস, আখের রস জগদ্বিখ্যাত, না খেলে আপনি মিস করবেন। গালায় পুলিশ অফিসার ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ সাহেবের বাংলোয় যে দুই ঘণ্টা ছিলাম, মনে হয়েছে, কী নেই এখানে? এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি সব ধরনের আধুনিক ব্যবস্থা তৈরি করে রেখেছেন। এই অঞ্চলের মধু অনন্যগুণে সুস্বাদু। হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা খুবই দৃষ্টিনন্দন একটি জায়গা।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সংক্ষিপ্ত সফরে এবারের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। কিছু সাংস্কৃতিক বিচ্ছুরণ বাদে সবকিছুই আমার কাছে মনে হয়েছে, দেশ এখন সঠিক পথেই চলছে। সমাজ বিকাশে প্রগতি খুব দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির অভাবনীয় প্রসার বাংলাদেশে হচ্ছে। সেই সঙ্গে কিছু দুর্বৃত্তায়নও হচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের ব্যাকুলতা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে, জীবিকাকেন্দ্রিক শিক্ষাই এর জন্য দায়ী। চিকিৎসাবিদ্যা কিংবা প্রকৌশলবিদ্যায় যাঁরা সুযোগ পাচ্ছেন না, তাঁরাই কম্পিউটারবিজ্ঞান ও এমবিএর পেছনে ছুটছেন। পেশাজীবীদের মধ্যে একধরনের অসহিষ্ণুতা ও অস্থিরতা লক্ষ করা যায়।

অনেকগুলো অ্যাজেন্ডার মধ্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষের সঙ্গে দেখা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করার পরও বাংলার প্রতি তাঁর বিস্ময়জ্ঞানে আমার মতো অনেকেই বিস্মিত হবেন। দরিয়াপাড়ের (কক্সবাজার) এই মানুষ অনেক দেশি–বিদেশি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি পেশায় একজন হোমিও চিকিৎসক। তাঁর সঙ্গে দীর্ঘদিন পর আমার দেখা হওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে।

কুমিল্লায় আমার বাপের আদি বাড়ি। এখানেও এসেছি এবার। কুমিল্লার বাটিক কাপড়ের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা এখনো তারা ধরে রেখেছে। এই ঐতিহ্যের নতুন সংযোজনে আমি মুগ্ধ। ময়নামতি পর্যটনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনায় দর্শনার্থীরা আমার মতোই হতাশ বলে মনে হয়েছে।
পরিশেষে দেশে দৃশ্যমান উন্নতি হচ্ছে, এটা এখন দিনের মতো সত্য। আমরা চাই, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে সম্ভবনার এবং স্বপ্নপূরণের মহা অঙ্গীকার। পৃথিবীর একটা স্বর্গ হবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন সফট পাওয়ারের দেশ। যে ১১টি রাষ্ট্র ভবিষ্যতে শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশ তার একটি। এত উন্নয়ন, এত প্রবৃত্তির পরও শিক্ষিত শ্রেণির কর্মসংস্থান আশানুরূপ বাড়েনি। ভবিষ্যতের দিনগুলো হবে প্রযুক্তিনির্ভর। সুতরাং এ খাতে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি। আমাদের সীমিত সম্পদ, তাই বিরাট এই জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনশীল কাজে লাগাতে হবে। কৃষি ও শিল্প খাতে ক্রম রূপান্তর খুব প্রয়োজন। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি, এ লক্ষ্যে একটা সিস্টেমের মধ্যে সবাইকেই আসতে হবে এবং সবাইকে আইন মানার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমাতে হবে। একটা বিপুল জনগোষ্ঠীকে বাইপাস করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়া মোটেও সম্ভব নয়।